বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন প্রতিনিয়ত নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত কে উন্মোচন করছে। গবেষকদের প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টার ফলে মানবজীবন হচ্ছে সহজতর। এবারে মানবসৃষ্ট সবচেয়ে ছোট ঘটনার জন্ম দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিনজন গবেষক পিয়েরে আগোস্টিনি, ফেরেঙ্ক ক্রাউস এবং অ্যান ল’হুইলিয়ার। অ্যাটোসেকেন্ড ফ্ল্যাশ অর্থাৎ, সবচেয়ে কম সময়ের আলোক ঝলক যা ব্যবহার করে ইলেকট্রন পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।
অ্যাটোসেকেন্ড হলো এক সেকেন্ডের ১×১০১৮ ভাগের একভাগ সময়। অর্থাৎ ১ এর পরে ১৮ টি শূন্য দিলে যেই সংখ্যা হবে সেই সংখ্যা দিয়ে এক সেকেন্ডকে ভাগ করলে যেই সময় পাওয়া যাবে সেটাই হলো অ্যাটো সেকেন্ড। ইলেকট্রনের স্থিরচিত্র দেখতে হলে ইলেকট্রনের উপর এই সামান্য পরিমাণ সময়ের জন্য আলো নিক্ষেপ করতে হবে। তবে ইলেকট্রনকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি স্থিরচিত্র পাওয়া সম্ভব।
বিষয়টা অনেকটা ক্যামেরার শাটার স্পিড এর মত। যখন ক্যামেরার মাধ্যমে কোনো ছবি তোলা হয় তখন ক্যামেরার শাটার উপরে উঠে যায় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেন্সরে আলো প্রবেশ করার পর শাটার পুনরায় নিচে নেমে যায়। যেই ক্যামেরার শাটার স্পিড যত বেশি হবে সেই ক্যামেরায় তত কম সময়ের জন্য আলো যাবে। ফলে গতিশীল বস্তুর নিখুঁত চিত্র তোলা হবে অনেক সহজ। শাটার স্পিড কম হলে গতিশীল কোনো বস্তুর ছবি ঝাপসা আসবে।
অর্থাৎ, মূল খেলাটা এখানে যত কম সময়ের জন্য গতিশীল বস্তু হতে দৃশ্যমান আলোক গ্রহণ করা যায় তার ওপর নির্ভর করছে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য ক্যামেরাগুলোর একটি শাটার সম্পন্ন হতে এক সেকেন্ডের দশ হাজার ভাগের এক ভাগ সময় নিলে তা গতিশীল কোনো বস্তুর (হতে পারে কোনো যানবাহন) নিখুঁত ছবি তোলার অন্য যথেষ্ট বলা যায়। প্রসঙ্গটা যখন ইলেকট্রনের তখন আরো অনেক গতিশীল শাটার সম্পন্ন ক্যামেরার প্রয়োজন। কিন্তু কোনো ক্যামেরার শাটার কে যান্ত্রিক ভাবে এত দ্রুত চালনা করা সম্ভব নয়।
গবেষকেরা এখানেই নিয়ে এসেছেন এক অভিনব পন্থা। সেই পদ্ধতিটি হলো অতি স্বল্প সময়ের লাইট ফ্ল্যাশ। সেটা অনেকটা অন্ধকার কোনো রাতের বেলায় বিদ্যুৎ চমকানোর মতো। যখন রাতের বেলা চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকে এবং প্রায় কিছুই দেখা যায় না তখন অতি অল্প সময়ের জন্য বিদ্যুৎ চমকালে চারপাশের পরিবেশ সেই বিদ্যুৎ চমকানো সময়ের জন্য দেখা যায়।
সেই সময় যদি আশপাশে কোন চলন্ত গাড়ি থাকে তখন সেই গাড়িটির একটি স্থিরচিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অনেকটা শাটার ব্যবহৃত ক্যামেরার লেন্সের মতোই অল্প সময়ের জন্য চোখ আলো গ্রহণ করে। ১৮৭৮ সালে এই পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে এডওয়ার্ড মায়োব্রিজ দেখান, দৌড়ানো অবস্থায় অতি অল্প সময়ের জন্য ঘোড়ার চারটি পা একই সাথে মাটির উপরে থাকে। অর্থাৎ, ঘোড়াটা শূন্যে ভাসতে থাকে।
কোনো চলন্ত বস্তুর উপর এভাবে অল্প সময়ের জন্য আলো ফেললে তার একটি স্থিরচিত্র পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ইলেকট্রনের জন্য সেই অতি অল্প সময়টা এতটাই অল্প যে কল্পনা করাও কঠিন। এই সময়ের পরিমাণই হলো অ্যাটোসেকেন্ড।
অত্যন্ত গতিশীল ইলেকট্রনের একটি নিখুঁত এবং স্থিরচিত্র পেতে বিজ্ঞানীরা অ্যাটোসেকেন্ড পরিমাণ সময়ের জন্য আলোকরশ্মি নিক্ষেপ করেছেন। অ্যাটসেকেন্ড পরিমাণ সময়ের জন্য আলো উৎপন্ন করার প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্যই ফেরেঙ্ক ক্রাউস, অ্যান ল’হুইলিয়ার এবং পিয়েরে অ্যাগোস্টিনি এই তিনজন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ইনফ্রারেড লেজারকে যখন পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ করে দেওয়া হয় তখন ওয়েবসমূহের যে অংশগুলো সমদশা সম্পন্ন হয় সেই অংশগুলোতে তরঙ্গের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। ফলে সেই সব স্থানের তরঙ্গের শীর্ষবিন্দু সবচেয়ে বেশি উঁচু হয় এবং তরঙ্গের পিক অংশ তৈরি হয়। অনেকটা পানিতে বিভিন্ন আকারের ঢেউ একত্রিত হয়ে বড় বড় ঢেউ তৈরি করার মতোন।
তরঙ্গগুলোর মাঝে এরকম যোগাযোগ এর ফলে কিছু কিছু অংশে আলোর পরিমাণ হয় অনেক বেশি আর কোন কোন অংশে আলো একেবারেই থাকে না। সব আলোকশক্তি একটি ক্ষুদ্রস্থানে একত্রিত হয়। এরূপ আলোক রশ্মিকে কোনো একটি স্থানে ফেললে তা অতি অল্প সময়ের জন্য সে স্থানটিকে উজ্জ্বল করে তোলে ।
এই সময় পরিমাণ হলো এক ফ্যামটোসেকেন্ড (১ এর পর ১৫ টি শূন্য দিলে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সেই সংখ্যা দিয়ে এক সেকেন্ড কে ভাগ করলে যে পরিমাণ সময় পাওয়া যায় তাকে এক ফ্যামটোসেকেন্ড বলে)। ১৯৮০ এর দশকে এক ফ্যামটোসেকেন্ড পরিমাণ সময়ের জন্য আলোকরশ্মি উদ্ভাবন করেন মিশরে জন্মগ্রহণ করা ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গবেষক আহমেদ এইচ জেওয়াইল। ফ্যামটোসেকেন্ড ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য ১৯৯৯ সালে তিনি রসায়নে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। কিন্তু ইলেকট্রনের স্থিরচিত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে এক ফ্যামটোসেকেন্ডও অনেক বেশি সময়। ইলেকট্রনের স্থিরচিত্র পাওয়ার জন্য এর চেয়ে কম সময়ের জন্য আলোক রশ্মি নিক্ষেপ করতে হবে।
পাশাপাশি তরঙ্গের পিক অংশের শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে হতে হবে যেন তা পরমাণুতে থাকা ইলেকট্রনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে পারে। তার জন্য এই একই ফ্যামটোসেকেন্ড ডিউরেশনের আলোকরশ্মিকে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মধ্য দিয়ে চালনা করা হয়। ফ্যামটোসেকেন্ড ডিউরেশনের আলোকরশ্মি যখন নিষ্ক্রিয় গ্যাস (যেমন নিয়ন গ্যাস) এর মধ্য দিয়ে চালনা করা হয় তখন ফোটন ইমিশন নামক এক ধরনের ঘটনা ঘটে। ফোটন ইমিশনের মাধ্যমেই হাই-ফ্রিকোয়েন্সির অ্যাটোসেকেন্ড ডিউরেশনের আলোর ফ্ল্যাশ উৎপন্ন করা সম্ভব।
কোন পরমাণুতে যখন তরঙ্গ আকারে শক্তি প্রয়োগ করা হয় (আলোকশক্তি) তখন তা ইলেকট্রন এ আঘাত করলে ইলেকট্রন এক শক্তিস্তর থেকে অন্য শক্তিস্তরে চলে যায়। শক্তি শোষণ করলে ইলেকট্রন নিম্নতর কক্ষপথ থেকে উচ্চতর কক্ষপথে স্থানান্তরিত হয়। আবার যখন ইলেকট্রন এই শক্তি ত্যাগ করে বা ছেড়ে দেয় তখন নিম্নতর স্তরে ফিরে যায়। ইলেকট্রন পুনরায় নিম্নতর শক্তিস্তরে ফিরে যাওয়ার সময় তা থেকে বিকিরিত শক্তি তথা আলোকরশ্মির কম্পাঙ্ক বা ফ্রিকোয়েন্সি অনেক বেশি হয়। এই আলোকরশ্মির ডিউরেশন হয় অনেক কম। এই আলোকরশ্মিই উচ্চ ফ্রিকুয়েন্সির অ্যাটোসেকেন্ড ফ্ল্যশ হিসেবে বের হয়ে আসে। এবং এভাবেই তৈরি হয় মানব সৃষ্ট পৃথিবীর সবচেয়ে কম সময়ের ঘটনা।
প্রথমে লেজার রশ্মিকে একটি সেমি-রিফলেক্টর এর মধ্য দিয়ে চালনা করা হয় যার ফলে আলোকরশ্মি দুইটি অংশে বিভক্ত হয়। তার একটি অংশ নিষ্ক্রিয় গ্যাসের দিকে চলে যায় এবং অন্য অংশ আরো কয়েকটি প্রতিফলকের মধ্য দিয়ে যায়, পরবর্তীতে দুটি আলোকরশ্মি একত্রে মিলিত হয় এবং ইলেকট্রনের উপর পড়ে। এক্ষেত্রে যে আলোক রশ্মিটি গ্যাসের মধ্য দিয়ে যায় না তার সাপেক্ষে মূলত অ্যাটোসেকেন্ড ফ্ল্যাশটির সঠিক ডিউরেশন নির্ণয় করা হয়।
২০০১ সালে সর্ব প্রথম পিয়েরে অ্যাগোস্টিনি ২৫০ অ্যাটোসেকেন্ডের ফ্ল্যাশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একই সালে ফেরেঙ্ক ক্রাউস ৬৫০ অ্যাটোসেকেন্ডের ফ্ল্যাশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ২০০৩ সালে অ্যান ল’হুইলিয়ার ও তার দল সবচেয়ে কম সময়ের ফ্ল্যাশ ১৭০ অ্যাটোসেকেন্ডের আলোকরশ্মি তৈরি করতে সক্ষম হন।
তিনজনই একইসাথে ২০২৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ। অ্যাটোসেকেন্ড ফ্ল্যাশ এর মাধ্যমে যে একেবারে সরাসরি ইলেকট্রনকে দেখা যায় তাও কিন্তু নয়। মূলত এই অ্যাটোসেকেন্ড ফ্ল্যাশ প্রয়োগের মাধ্যমে তা ইলেকট্রনের উপর কি ধরনের প্রভাব বিস্তার করে সে সম্পর্কে জানা যায়।
আলবার্ট আইনস্টাইনের দেয়া ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্টকে (ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্ট বা আলোক তড়িৎ ক্রিয়া কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোন বস্তুর ওপর রঞ্জন রশ্মি বা দৃশ্যমান আলো পড়লে তা থেকে শক্তি শোষণ করে ইলেক্ট্রনের নির্গমন হয়) মূলত পর্যবেক্ষণের জন্য অ্যাটোসেকেন্ড ফ্ল্যাশ ব্যবহার করা হয়। তবে এই অ্যাটোসেকেন্ড সায়েন্স এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
ভবিষ্যতে এই উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্স জগতে আরো উন্নত গবেষণা এবং উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে। রসায়ন, জীববিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞানে পারমাণবিক পরিসরে গবেষণা চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। যা প্রাণিজগৎ, চিকিৎসা, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মতো জটিল সব উদ্ভাবনকে এগিয়ে নেয়া যাবে বহুদূরে।
জুম্মান আল সিয়াম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, কোয়ান্টাম ম্যাগাজিন