মহাকাশের এই বিশালতায় নীহারিকা একটি বিস্ময়ের নাম। বিভিন্ন গল্পে বা মুভিতে নীহারিকা বা নেবুলার কথা প্রায়ই শোনা যায়। ‘নেবুলা‘ একটি লাতিন শব্দ এবং এর আভিধানিক অর্থ ‘কুয়াশা বা মেঘ’। নেবুলা বা নীহারিকা হলো মহাকাশে ঘনীভূত ধুলো এবং গ্যাসের একটি বিশাল মেঘ। কিছু নীহারিকা একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ তথা মৃত নক্ষত্রের বিস্ফোরণ দ্বারা নিক্ষিপ্ত গ্যাস এবং ধুলো থেকে তৈরি হয়। অন্যান্য নীহারিকা এমন অঞ্চল থেকেও তৈরি হতে পারে যেখানে নতুন কোন নক্ষত্র তৈরি হতে শুরু করেছে। তাই বলা যায় নীহারিকা হলো নক্ষত্রের জন্মস্থান এবং একই সাথে মৃতস্থানও।
মহাকর্ষের টানে গ্যাসীয় কণাগুলো একত্র হয়ে ধীরে ধীরে গঠন হয় নীহারিকা। এটি বিভিন্ন আকারের হতে পারে, যেমনঃ- রিং, হেলিকেল (পেঁচানো বা সর্পিল আকৃতির) , স্টেলার (তারকা বা নক্ষত্রের মতো আকৃতি), ডিস্ক, বাইপোলার, চতুর্মুখী এবং আরও অনেক কিছু। নক্ষত্রের জন্ম ও মৃত্যুর সাক্ষী, এই বিশাল গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘ জ্যোতির্বিদদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আসছে।
সম্প্রতি, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে সাউদার্ন রিং নেবুলার অপ্রত্যাশিত গঠন আবিষ্কার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই আবিষ্কার কেবল একটি নীহারিকার গঠন রহস্য উন্মোচন করেনি, বরং নক্ষত্রের বিবর্তন ও নীহারিকা গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের আরও নিখুঁত ধারণা দিচ্ছে!
প্রায় ২,০০০ আলোকবর্ষ দূরে, সাউদার্ন রিং নেবুলা অবস্থিত যাকে আবার অনেকে NGC-3132 নামেও চিনে থাকবেন। এটি একটি প্লানেটারি নেবুলা, এসব নেবুলা একটি জ্বলন্ত বলয় বা বুদবুদ আকৃতির গ্যাস এবং ধূলিকণার মেঘ যা মৃত নক্ষত্রের অবশিষ্টাংশ থেকে তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা এই নীহারিকাটির মাঝে একটি ডবল-রিং কাঠামো খুঁজে পেয়েছেন যা প্রমাণ করে যে একটি নয়, বরং এটির কেন্দ্রে তিনটি তারকা রয়েছে!
২০২২ সালের ডিসেম্বরে, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) এই নীহারিকার উচ্চ-রেজোলিউশন ছবি তোলে, যা বিজ্ঞানীদের এর আগে অজানা বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ করে। তাঁরা সেখানে নীহারিকাটির “বহিঃকঙ্কাল” বা বাইরের স্তরে আণবিক হাইড্রোজেন গ্যাসের উপস্থিতি লক্ষ করেন। এটি প্রায় ১০০০ কেলভিন বা ৭২৬.৮৫o সেলসিয়াস পর্যন্ত উত্তপ্ত হতে পারে। এই এক্সোস্কেলটন শুধু নীহারিকার আণবিক গ্যাসের একটি ছোট অংশকেই প্রতিনিধিত্ব করে।
রচেস্টার ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (RIT) জোয়েল কাস্টনারের নেতৃত্বে, বিজ্ঞানীদের একটি দল নীহারিকাটির আরও আণবিক গ্যাসের অনুসন্ধান করেছিল। তারা সাবমিলিমিটার অ্যারে (SMA) (সাবমিলিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্য পর্যবেক্ষণের জন্য ইন্টারফেরোমিটার হিসাবে সাজানো আটটি ৬-মিটার ব্যাসের রেডিও টেলিস্কোপ এর একটি গ্রুপ যা হাওয়াইয়ের Mauna Kea নামক একটি নিষ্ক্রিয় আগ্নেয়গিরিতে বসানো হয়েছিল) ব্যবহার করে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের সন্ধান করেছিল। নীহারিকার অভ্যন্তরে কার্বন মনোক্সাইড এর সাথে হাইড্রোজেন ও অন্যান্য গ্যাসের মিশ্রণ পাওয়া যায়। যাইহোক কার্বন মনোক্সাইড পর্যবেক্ষণ করা বা অন্যান্য কোন গ্যাস শনাক্ত করা খুবই জটিল একটি ব্যাপার। তবে SMA দ্বারা কার্বন মনোক্সাইড অণুর বণ্টন এবং বেগ উভয়ই পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছিল, যা দ্বারা বোঝা যায় কোন অংশগুলো সৌরজগৎ দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং কোনটি দূরে সরে যাচ্ছে।
কাস্টনার একটি প্রেস বিবৃতিতে বলেন,
“JWST আমাদের হাইড্রোজেনের অণুগুলি দেখিয়েছে এবং কীভাবে সেগুলো আকাশে স্তূপ করে থাকে, যখন SMA আমাদের কার্বন মনোক্সাইড দেখায় যা এতটাই শীতল যে আপনি JWST ছবিতে দেখতে পারবেন না।”
সাউদার্ন রিং-এর নাম থেকেই বোঝা যায়, এটি প্রাথমিকভাবে আংটি আকৃতির (আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে)। SMA পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখা যে এই বলয়টি প্রসারিত হচ্ছে, যা প্রত্যাশিত, কারণ সকল নীহারিকা বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। যাইহোক,এর মাধ্যমে ক্যাস্টনারের দল নীহারিকাটির আণবিক এক্সোস্কেলটনের একটি ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়।
গবেষকরা কেবল এটিই দেখাতে সক্ষম হননি যে একটি রিং হিসাবে যা দেখা যায় তা কেবল একটি দ্বিমেরু নীহারিকার (এমন এক ধরনের নীহারিকা যা একটি কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের উভয় পাশে দুটি লোব দ্বারা গঠিত। প্রায় ১০-২০% গ্রহের নীহারিকা বাইপোলার) প্রান্তে থাকা একটি লোব, বরং বিজ্ঞানীরা প্রথমটির সাথে লম্বভাবে একটি দ্বিতীয় রিংও খুঁজে পেয়েছিল!
“যখন আমরা পুরো নীহারিকাটিকে 3D তে ঘুরিয়ে দেখছিলাম, তখন আমরা দেখতে পেলাম যে এটি সত্যিই একটি রিং আকৃতির ছিল, এবং তারপরে আমরা অবাক হয়েছিলাম যে সেখানে আরও একটি রিং ছিল,” কাস্টনার বলেন।
পুরো ঘটনাটি দ্বারা এটিই প্রমাণিত হয় যে নীহারিকাটির কেন্দ্রে একটি নয়, দুটিও নয় বরং তিনটি নক্ষত্রের বিন্যাস রয়েছে। এই নক্ষত্রত্রয়, যদি তিনটিই সত্যিই থেকে থাকে, তবে সম্ভবত একে অপরের খুব কাছাকাছি অথবা এতটাই ক্ষীণ যে এদের আলাদাভাবে শনাক্ত করা খুবই কঠিন একটি কাজ, এমনকি JWST দ্বারাও।
সাউদার্ন রিং নেবুলার একটি লোব সরু এবং অপরটি ঘন্টাঘড়ির মতো চোঙাকৃতির। যা বাইনারি স্টার সিস্টেম (দুটি নক্ষত্রের এমন একটি সিস্টেম যা মহাকর্ষীয়ভাবে একে অপরের চারপাশে কক্ষপথে আবদ্ধ হয়ে ঘুরছে) দ্বারা গঠিত যেখানে আবর্তনরত একটি নক্ষত্র তার জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটি একটি প্লানেটারি নেবুলার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এই বাইনারি নক্ষত্রদ্বয় একটি মৃত তারকার উপাদানকে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়, যা পরে দুটি লোব তৈরি করে। JWST এর ইনফ্রারেড পর্যবেক্ষণও এই ধারণাকে সমর্থন করে।
সুতরাং, এর দ্বারা প্রথম রিং এর ব্যাখ্যা ও দ্বিতীয় রিং এর উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। অন্যান্য রিং-আকৃতির গ্রহীয় নীহারিকা, যেমন হেলিক্স নেবুলাও (NGC 7293) দ্বি-লোব আকৃতির।
সাউদার্ন রিং নেবুলার দ্বিতীয় রিং আবিষ্কারের পর কি এখন এটিকে সাউদার্ন রিংস নেবুলা, বহুবচনে বলা উচিত নয়? নতুন এই আবিষ্কারটি এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কে সেই অন্যান্য সুপরিচিত রিং আকৃতির নীহারিকাগুলোর সম্পর্কেও দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে যে এখন কি সেসব সুপরিচিত নীহারিকাগুলোর মাঝেও দ্বিতীয় রিং খুঁজে বেড়াতে হবে নাকি?
এক কথায় বললে গ্রহের নীহারিকাগুলো কেবল নাক্ষত্রের মৃত্যুকেই বোঝায় না। তারা নতুন জীবনের প্রতিশ্রুতিরও আশ্বাস দেয়।
“মহাবিশ্বের কার্বন, অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন এর মতো গ্যাস কোথা থেকে আসে?” কাস্টনার প্রশ্ন করেন। “আমরা জানি এসব গ্যাস সূর্যের মতো নক্ষত্রের মৃত্যুর পর তৈরি হয়”। একটি গ্রহীয় নেবুলা যা অসীম মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, আণবিক গ্যাস মহাকাশে ছড়িয়ে দেয় যা ভবিষ্যতে মেঘের মতো জমাট বেঁধে গ্রহ বা নক্ষত্রের সৃষ্টি করে।
কাস্টনার বলেছেন,
“এসবের মধ্যে অনেক আণবিক গ্যাস গ্রহের বায়ুমণ্ডলে চলে যাবে এবং এই বায়ুমণ্ডল জীবন ধারণ করতে সক্ষম হবে।”
প্রকৃতপক্ষে, হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের চেয়ে ভারী পৃথিবীর সমস্ত উপাদান নক্ষত্রের অভ্যন্তর থেকে উদ্ভূত হয়েছিল এবং সেই নক্ষত্র পরে মারা গেলে গ্যাস গুলো পরে মহাকাশে ছড়িয়ে পরে।
আমিনুল ইসলাম সিয়াম/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: স্পেস.কম, ফিজিক্স.অর্গ