নিউরালিংক এলন মাস্ক কর্তৃক পরিচালিত এমন একটি প্রজেক্ট যা মূলত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করে থাকে। এটি বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন কিছু মাইক্রোচিপস নিয়ে সুদূরপ্রসারী গবেষণা চালাচ্ছে যা মানুষের ব্রেইনে ব্যবহারযোগ্য হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সম্প্রতি নিউরালিংক একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে ‘ম্যাকাক’ জাতের একটি বানর তার বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে ‘পং‘ নামক একটি ভিডিও গেমস খেলেছে।
প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত বিভিন্ন প্রাণীর উপর নিউরালিংক পূর্বেও গবেষণা চালিয়ে এসেছে; তবে তার আদ্যোপান্ত সম্পর্কে জনসম্মুখে প্রকাশ এইবারই প্রথম। ২০১৯ সালে একটি উপস্থাপনা চলাকালীন এলন মাস্ক বলেছিলেন, নিউরালিংক সংস্থাটি একটি ম্যাকাক জাতের বানরকে নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছে; আর যার ফলস্বরূপ আমরা দেখতে পেলাম বানরটি তার মস্তিষ্কের সাহায্যে একটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। উল্লেখ্য, নিউরালিংক ২০২০ সালের আগস্টে ‘জেট্রুড’ নামের একটি শূকরের ওপরও গবেষণা জনসম্মুখে লাইভ টেলিকাস্টের মাধ্যমে প্রদর্শন করেছিল।
‘পেজার’ নামক বানর-টির মস্তিষ্কে ছয় সপ্তাহ আগেই একটি নিউরালিংক চিপ বসানো হয়েছিল বলে সংস্থাটি মন্তব্য করেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, বানরটি একটি জয়স্টিকের সাহায্যে নিখুঁতভাবে রঙিন বর্গ ঘরের মধ্যে প্রতিবার কার্সরকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। যখন সে সফলভাবে কার্সারটিকে রঙিন বর্গঘরে নিয়ে যায়, প্রতিবারই তখন তাকে একটি নল দিয়ে কলার জুস দেওয়া হয় যাতে সে খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করতে পারে।
পেজার নামক বানরটি যখন জয়স্টিক ব্যবহার করতে থাকে, নিউরালিংক তখন তার মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ চিপটির মাধ্যমে রেকর্ড করে কম্পিউটারে প্রেরণ করতে থাকে যাতে কম্পিউটার পুরো ব্যাপারটিকে বিশ্লেষণ করতে পারে। জয়স্টিকটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও বানর কার্সর ঘুরিয়ে গেমটির পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজের মধ্যে আয়ত্ত্ব করে ফেলে আর তারপর খেলতেই থাকে। আর তখনই বানরের মস্তিষ্কের পাঠানো ফিরতি সিগন্যালগুলো নিউরালিংক চিপ ভিন্নভাবে কম্পিউটারে ট্রান্সমিট করে যাতে পুনরায় গবেষণার ফলাফল রেকর্ড করা যায়।
তাত্ত্বিকভাবে, একই নিউরালিংক প্রযুক্তি ব্রেইন ইমপ্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে মানুষকে সিনথেটিক অঙ্গগুলির নিয়ন্ত্রণ দিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। বৃহস্পতিবার একটি টুইট বার্তায় মাস্ক বলেছেন যে, এই প্রথম নিউরালিংক চিপের মাধ্যমে কোনো পক্ষাঘাতগ্রস্থ ব্যক্তিকে ক্ষুদ্র একটি স্মার্টফোনের মাধ্যমেই দেহের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে যা এক প্রকার অকল্পনীয় আবিষ্কার হতে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নিউরোসায়েন্স বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু জ্যাকসন বলেছেন, নিউরাল ইন্টারফেসের মাধ্যমে প্রাইমেট বর্গের প্রাণী কর্তৃক ভিডিও গেমগুলি নিয়ন্ত্রণের জন্য গবেষণা মোটেও নতুন কিছু না। এমনই পরীক্ষা ২০০২ সাল থেকেই করা হয়েছে। তবে তিনি আরো ব্যক্ত করেন, টেকনোলজির ব্যবহারের মাধ্যমে এমন একটি গবেষণা করে সফল হওয়াটা আসলেই খুব বড় একটা অর্জন এবং এটি দারুন একটি পরীক্ষা ছিল।
তিনি আরো বলেন, “আপনি যদি কোনো টেলিস্কোপ উদ্ভাবন করে থাকেন তবে প্রথমেই এটিকে আপনি এমন কোনো জিনিসের দিকে তাক করবেন যার ব্যাপারে আপনি আগে থেকেই অবগত আছেন, তাইনা? নিউরালিংক সংস্থাটি তাদের গবেষণায় প্রাপ্ত মাইক্রোচিপকে বৈধতা দেওয়ার জন্য খুবই সংবেদনশীল পথ অনুসরণ করছে।
আমি নিশ্চিত যে এই ডিভাইসটি ভবিষ্যতে নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলিতে এক বিরাট অবদান রাখবে (বিশেষত যদি তারা এটি বিজ্ঞানীদের কাছে সহজলভ্য করে তুলতে পারে); পাশাপাশি নিউরাল ইন্টারফেস নামক উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার পক্ষাঘাতগ্রস্থ মানুষদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে এক প্রকার আশার আলো বয়ে আনতে পারে।” জ্যাকসন আরো মন্তব্য করেন, “ডিভাইসটির ইঞ্জিনিয়ারিং, পেজার নামক বানরের খুলিতে ওয়্যারলেস চিপ স্থাপন করা বিজ্ঞানের জন্য অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রযাত্রা ছিল।”
জ্যাকসন বলেছিলেন, “স্পষ্টতই নতুন এবং উদ্ভাবনী বিষয়টি হল ওয়্যারলেস প্রযুক্তি; অর্থাৎ বানরটির শরীরের মধ্যে কোনো ধরনের ওয়্যার বা তারের প্রবেশ ঘটানো হয়নি এবং এর মস্তিষ্কে পাঠানো সংকেতগুলো ওয়্যারলেস ভাবেই প্রেরণ করা হচ্ছে। এটাই আমার কাছে বিজ্ঞানের সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার এক উৎকৃষ্ট উদাহরন এবং এক্ষেত্রে প্রাণীর সেইফটির ব্যাপারটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে (কেননা ত্বকের মধ্য দিয়ে কোনো তার প্রবেশ করানো হলে তা অবশ্যই যেকোনো জীবাণু কর্তৃক সংক্রমণের সম্ভাব্য পথ হয়ে দাঁড়াবে) এবং নিউরোসায়েন্স গবেষণায় ব্যবহৃত প্রাণীদের কল্যাণের জন্যেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এদিক দিয়ে নিউরালিংক অবশ্যই এই বিষয়ে ভেবেচিন্তেই গবেষণা করে সফল হতে পেরেছে।”
এছাড়াও, লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের বায়োইঞ্জিনিয়ারিং গবেষক রাইলি গ্রিনও পেজার নামক বানরটির অগ্রগতি দেখে প্রশংসা করেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, “ভিডিওটি দেখে আমি যে ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি তা হলো ম্যাকাক বানরটি অবাধে চলাফেরা করতে পারছে। এর সাথে কোনো দৃশ্যমান ওয়্যার সংযুক্ত নেই। আমি অবশ্যই বলব এটি বিজ্ঞানের জন্য এক অভাবনীয় অগ্রগতি।”
হাসান সৈকত/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ জেরুজালেম পোস্ট, ডেইলি মেইল ইউকে, পপুলার মেকানিক্স
+1
+1
2
+1
+1
+1
2
+1
+1
1