বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো তার ‘Timaeus’ বইয়ে সর্বপ্রথম আটলান্টিসের কথা উল্লেখ করেন। তার মতে, আটলান্টিস প্রাচীন সময়ের খুব উন্নত একটি শহর ছিল। প্রযুক্তি, সামরিক শক্তি ইত্যাদি দিক থেকে তারা বাকি বিশ্বের চেয়ে ছিল বেশ এগিয়ে। কিন্তু, পরবর্তীতে রহস্যজনকভাবে শহরটি চিরতরে পানির নিচে তলিয়ে যায়। একই ঝুঁকিতে রয়েছে নিউইয়র্ক শহরও। তবে নিউইয়র্ক কি তলিয়ে যাবে সমুদ্রে?
বর্তমান সময়ে নিউইয়র্ক বিশ্বের অন্যতম আধুনিক শহরগুলোর মধ্যে একটি। কী হবে যদি নিউইয়র্কেরও আটলান্টিসের ন্যায় সলিল সমাধি হয়? সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে, নিউইয়র্ক সিটি তার সুউচ্চ ভবনগুলির অস্বাভাবিক ওজনের কারণে আংশিকভাবে ডুবে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান সমুদ্র মহানগরটির জন্য বন্যার হুমকিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
নিউইয়র্ক এমন একটি শহর যেটি কখনোই ঘুমায় না। গবেষকদের মতে, নিউইয়র্ক সিটি ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতি বছর নিউইয়র্ক সিটি গড়ে প্রায় ১-২ মি.মি. নিচের দিকে দেবে যাচ্ছে। কিছু এলাকায় এর হার দ্বিগুণ!
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মেরুর বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা আমাদের সবার জানা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব এই ডুবে যাওয়ার হার আরোও বাড়িয়ে তুলছে। ১৯৫০ সাল থেকে নিউইয়র্ক সিটির আশেপাশের পানি প্রায় ২২ সেমি বেড়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ছোটো ছোটো ঘূর্ণিঝড়, এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বন্যার ঘটনা এখনকার তুলনায় চারগুণ বেশি বাড়িয়ে দেবে। জলবায়ু পরিবর্তনই এর পিছনে বিশেষভাবে দায়ী।
জিওফিজিসিস্ট সোফি কোলসনের মতে,
“নিউইয়র্ক সিটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি।“
আট দশমিক চার মিলিয়ন জনসংখ্যার এই শহর বন্যার ফলে বিভিন্ন মাত্রার বিপদের সম্মুখীন হয়। আর্থস ফিউচার জার্নালে প্রকাশিত নতুন গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে।
গবেষকরা একটা হিসাব কষেছিলেন এই নিউইয়র্কে শহরের থাকা ভবনগুলোর কাঠামো নিয়ে। যার মধ্যে বিখ্যাত Empire State Building এবং Chrysler Building ও ছিলো। হিসেবে দেখা যায়, এই অবকাঠামোগুলোর মোট ওজন ১.৬৮ টন পাউন্ড যা কিনা ১৪০ মিলিয়ন হাতির সমান ওজনের।
মার্কিন জিওফিজিসিস্ট টম পারসন জানান,
“এটি নিয়ে এতো তাড়াতাড়ি আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। তবে একরকম চলতে থাকলে শহরটি বন্যায় প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।”
তিনি আরো বলেন,
“মাটি যত নরম হবে, দালানগুলোর চাপে মাটি তত সংকোচিত হবে। নিউইয়র্কে এতো উঁচু স্থাপত্য স্থাপন করা ভুল কিছু না হলেও আপনাকে সবসময় মনে রাখতে হবে আপনি যা-ই নির্মাণ করছেন তা মাটিকে আরো বেশি সংকোচিত করছে।”
নিউইয়র্ক সিটি ইতোমধ্যেই একাধিকবার বন্যার সম্মুখীন হয়েছে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ ২০২১ সালে আঘাত হানা হারিকেন ‘ইডা’। ‘ইডা’ এর প্রভাবে শহর এলাকায় পানি ঢুকে যায়, যা কিছু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। গবেষণায় দাবি করা হয়েছে যে, এভানে বন্যার পানির সংস্পর্শে আসতে থাকলে নিউইয়র্ক সিটির ভবনগুলিতে ব্যবহৃত ইস্পাতগুলোতে মরিচা ধরতে পারে, যা ভবনগুলোর কাঠামো দূর্বল করে ফেলবে।
ভবনের কাঠামো দূর্বল করার পেছনে সমুদ্রের পানি কীভাবে ভূমিকা রাখে?
লোহা (Fe) পানি ও অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ায় লালচে রঙের Hydrated Iron(III)- Oxide(Fe2O3.H2O) তৈরি করে। এটিকেই মূলত আমরা মরিচা পড়া বা জং ধরা বলে থাকি। মরিচা পড়লে লোহার কাঠামো স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটা দূর্বল হয়ে আসে। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি Hydrated Iron(III)-Oxide(Fe2O3.H2O) উৎপন্ন হবার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। আমরা সাধারণত শুনে থাকি পানির সংস্পর্শ পেলেই লোহায় জং/মরিচা ধরে। কিন্তু কথাটি সম্পূর্ণরূপে সঠিক নয়। লোহায় জং ধরবার জন্য পানিতে ধনাত্মক ও ঋণাত্বক আয়ন থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ। তাত্ত্বিকভাবে শতভাগ বিশুদ্ধ পানিতে লোহায় মরিচা ধরবে না।
কিন্তু এর পেছনে কারণ কী?
বিক্রিয়ায় ব্যবহৃত বিক্রিয়কসমূহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কঠিন বা ঘন তরল আকারে থাকে। এমতাবস্থায় তাদের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটানো প্রায় অসম্ভব। যদি এক্ষেত্রে একটি দ্রাবক ব্যবহার হয় তাহলে বিক্রিয়কে থাকা অণুগুলো সেটিতে দ্রবীভূত হয় এবং সেগুলোর মধ্যে বিক্রিয়কের অণুগুলো গতিশীলতা লাভ করে। এই গতিশীলতার ফলে অণুগুলো সহজেই একে অপরের সাথে বিক্রিয়ায় করতে পারে। মরিচা ধরার ক্ষেত্রে যে বিক্রিয়াটি হয় তাতে দ্রাবকের ভূমিকা পালন করে পানি। এ বিক্রিয়াটি একটি জারণ বিক্রিয়া।
জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনের আদান-প্রদান ঘটে। পানি এক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনগুলোর জন্য একটি ব্রিজের মতো কাজ করে। এই ব্রিজের মাধ্যমে ইলেক্ট্রন এক বিক্রিয়ক থেকে আরেক বিক্রিয়কে যায়। কিন্তু ইলেক্ট্রন এমনি এমনি চলাচল করতে পারে না। এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে পানিতে থাকা ধনাত্মক ও ঋণাত্বক আয়নগুলো। আমরা জানি, ইলেক্ট্রন ঋণাত্বক চার্জ বিশিষ্ট। ফলে ইলেক্ট্রন ধনাত্মক আয়নগুলো দ্বারা আকর্ষিত হয় এবং ঋণাত্বক আয়নগুলো দ্বারা বিকর্ষিত হয়। এই আকর্ষণ-বিকর্ষণের ফলে ইলেক্ট্রনগুলো গতিশীলতা পায় এবং নির্দিষ্ট গন্তব্য পৌঁছে বিক্রিয়া সম্পন্ন করে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে আমরা ‘Pinball‘ খেলার সাথে তুলনা করতে পারি।
এভাবে পানিতে থাকা আয়নগুলো লোহায় মরিচা ধরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমাণে আয়ন বিদ্যমান। তাই ইলেক্ট্রন আদান-প্রদান সামুদ্রিক পানিতে দ্রুত হয়। ফলে জংও দ্রুত ধরে যায়। একই কারণে বিশুদ্ধ পানিতে লোহায় জং ধরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
শহরে বন্যার ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোর ৬৭,৪০০ টি ভবন পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, তার মধ্যকার প্রায় ৯০ শতাংশ ভবনই পরিপূর্ণরূপে বন্যাসহনশীল নয়।
তাহলে, আটলান্টিসের ন্যায় নিউইয়র্ক কি তলিয়ে যাবে সমুদ্রের বুকে? নাকি মানুষ শেষমেষ এ বিপর্যয় ঠেকাতে সক্ষম হবে? আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, সিএনএন, গ্লোবাল নিউজ
যৌথ প্রতিবেদক- আতিক হাসান রাহাত, মোঃ শরিফুল ইসলাম এবং মাহমুদুল হাসান