নারকোলেপ্সি (Narcolepsy) এক ধরনের স্নায়বিক ব্যধি যার ফলে মানুষের ঘুমের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে। এই রোগে আক্রান্ত মানুষের দিনের বেলাও ঘুম ঘুম ভাব লাগে, মাথা ঘুরায়, হঠাৎ করে প্রচণ্ড ঘুম পায়। যাদের নারকোলেপ্সি আছে তাদের একটানা অনেকক্ষন জেগে থাকতে সমস্যা হয়, অনেকসময় তারা কোনো কাজের ভিতরও ঘুমিয়ে পড়েন।
নারকোলেপ্সি এর ফলে একজন মানুষ ঘুম এবং জাগরণ এর মাঝে পার্থক্য করতে পারেন না, যার ফলে ঘুমের ভিতর যেসব জিনিস হতে পারে তা জাগ্রত অবস্থায় দেখা দেয়। এর ফলে তাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বেশিরভাগ রোগীই বুঝতে পারেন না যে তারা নারকোলেপ্সিতে আক্রান্ত। নারকোলেপ্সি রোগটি বিশ্বে অনেক বেশি ছড়িয়ে আছে। আমেরিকাতে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। বিশ্বব্যপী প্রায় ২০০০ জনে ১ জন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়।
নারকোলেপ্সির লক্ষণঃ-
নারকোলেপ্সির লক্ষণ প্রথম প্রথম তেমন প্রকাশ না পেলেও ধীরে ধীরে কয়েক বছরের মাঝে প্রকটভাবে দেখা দেয়। নারকোলেপ্সির লক্ষণগুলো হলো:
১. অসময়ে অতিরিক্ত ঘুম: যাদের নারকোলেপ্সি আছে তারা যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় হঠাৎ করে ঘুমিয়ে পড়েন। যেমন দেখা গেলো আক্রান্ত ব্যক্তি তার বন্ধুদের সাথে গল্প করছেন বা কোনো কাজে ব্যস্ত আছেন, এমন সময়ে হঠাৎ করে ঘুমিয়ে গেলেন। এই ঘুম কয়েক মিনিট থেকে আধা ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। আবার ঘুম থেকে উঠে অনেক সতেজ লাগলেও কিছুক্ষণ পর আবার ঘুমিয়ে পড়েন তারা।
২. হঠাৎ শরীর অবশ: নারকোলেপ্সি ব্যধিতে আক্রান্ত মানুষের হঠাৎ করেই পেশী দুর্বল ও অবশ হয়ে পড়ে। একে বলে ক্যাটাপ্লেক্সি। ক্যাটাপ্লেক্সি এমন এক ধরনের সমস্যা যার ফলে হঠাৎ হাসলে, রেগে গেলে বা উত্তেজিত হলে রোগী তার মাংপেশির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন, হাঁটু দুর্বল হয়ে পড়ে যার ফলে মাটিতে পড়ে যান। ক্যাটাপ্লেক্সি এর ফলে কথা অস্পষ্ট হয়ে যায় এবং কথায় জড়তা দেখা দেয়। তবে সব নারকোলেপ্সি রোগীর ক্ষেত্রে ক্যাটাপ্লেক্সি দেখা যায়না।
৩. স্লিপ প্যারালাইসিস বা অসাড়তা: নারকোলেপ্সিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই ঘুম থেকে জেগে উঠার পর কিছুক্ষণের জন্য হাটাচলা বা কথা বলতে পারেন না। এটা সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়। এর ফলে দম বন্ধ হয়না তবে এটি অনেক ভয়াবহ অবস্থা কারণ এই সময় দেহের উপর নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। এই ধরনের স্লিপ প্যারালাইসিস এর সাথে ঘুমের র্যাপিড আই মুভমেন্ট (আরইএম) পর্যায়ের অস্থায়ী প্যারালাইসিস এর সাথে মিল আছে। তবে স্লিপ প্যারালাইসিস হলেই যে নারকোলেপ্সি হবে এমন কোনো কথা নেই।
৪. হ্যালুসিনেশন: নারকোলেপ্সি এর ফলে মানুষের দৃষ্টিবিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন হতে পারে। যদি ঘুমের ভিতর হ্যালুসিনেশন হয় তবে তাকে hypnagogic হ্যালুসিনেশন বলা হয়। আর যদি কেউ হাঁটাচলা করার সময় তার হ্যালুসিনেশন হয়ে তবে তাকে বলে hypnopompic হ্যালুসিনেশন। যেমন: রোগীরা অনুভব করেন তাদের ঘরে কোন অচেনা লোক আছেন কিন্তু আসলে তাদের ঘরে কেউই নেই। আবার অনেক সময় যখন রোগীরা পুরোপুরি ঘুমের ভিতর থাকেন না তখন রোগীদের হ্যালুসিনেশন হয় যার ফলে সব স্বপ্ন বাস্তব মনে হয়।
৫. ঘুমের আরইএম পর্যায়ের পরিবর্তন: সাধারণত ঘুমের র্যাপিড আই মুভমেন্ট বা আরইএম পর্যায়ে আমরা স্বপ্ন দেখি। নারকোলেপ্সিতে আক্রান্ত রোগীদের দিনের যেকোনো সময় আরইএম ঘুম হতে পারে। রোগীরা ঘুমিয়ে পড়ার ১৫ মিনিটের মধ্যেই ঘুমের আরইএম পর্যায়ে প্রবেশ করেন।
৬. মনোযোগ কমে যাওয়া: রাতে ভালো করে ঘুমানোর পরেও দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব এর ফলে যেকোনো কাজের প্রতি মনোযোগ ও ফোকাস কমে যায় যা ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
অন্যান্য লক্ষণঃ-
নারকোলেপ্সিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ঘুম সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যাধি হতে পারে। যেমন: স্লিপ অ্যাপনিয়া, রেস্টলেস লেগ সিন্ড্রোম, এমনকি ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রা পর্যন্ত হতে পারে। তাছাড়াও নারকোলেপ্সিতে আক্রান্ত ব্যক্তি গাড়ি চালাতে চালাতে, কথা বলতে বলতে, এমনকি খেতে খেতেও হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়তে পারেন এবং তারা ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই এইসব কাজ করতে থাকেন। আবার ঘুম থেকে জেগে উঠার পর তারা ঘুমিয়ে কি করেছেন তা মনে করতে পারেন না। এর ফলে অনেকের সাথে বড় রকমের দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। নারকোলেপ্সিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।
সাধারণ ঘুম ও নারকোলেপ্সিঃ-
ঘুমিয়ে যাওয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া শুরু হয় নন রেপিড আই মুভমেন্ট (এন-আরইএম) পর্যায়ের মাধ্যমে। ঘুমের এই পর্যায়ে আমাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গগুলি তুলনামূলক ধীরে ধীরে চলে। এন-আরইএম ঘুমের প্রায় এক ঘন্টা বা তার বেশি সময় পর আমাদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ পরিবর্তন হয় এবং ঘুমের আরইএম পর্যায় শুরু হয়। ঘুমের আরইএম পর্যায়েই আমরা সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখি।
অন্যদিকে নারকোলেপ্সি এর ক্ষেত্রে একজন মানুষ হঠাৎ করে রাতের বা দিনের যেকোনো সময় ঘুম চলে আসে। ঘুমানোর পর মস্তিষ্ক এন-আরইএম পর্যায়ে প্রবেশ না করে প্রথমেই আরইএম পর্যায়ে প্রবেশ করে। নারকোলেপ্সির কিছু লক্ষণ যেমন: ক্যাটাপ্লেক্সি, স্লিপ প্যারালাইসিস, হ্যালুসিনেশন ইত্যাদির সাথে ঘুমের রেম পর্যায়ের পরিবর্তনের সাথে মিল রয়েছে। তবে পার্থক্য হচ্ছে নারকোলেপ্সি এর ক্ষেত্রে মানুষ এইসব আধো ঘুম-আধো জাগরনে অনুভব করে।
নারকোলেপ্সির কারণঃ-
নারকোলেপ্সি হওয়ার সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। নারকোলেপ্সি দুই ধরনের হতে পারে, টাইপ-১ ও টাইপ-২। নারকোলেপ্সি এর পাশাপাশি ক্যাটাপ্লেক্সি হলে তাকে বলে টাইপ-১ নারকোলেপ্সি আর ক্যাটাপ্লেক্সি বাদে নারকোলেপ্সি হলে তাকে বলে টাইপ-২ নারকোলেপ্সি। টাইপ-১ নারকোলেপ্সিতে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিদের হাইপোক্রেটিন নামক রাসায়নিকের ঘাটতি থাকে।
এই হাইপোক্রেটিন মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিউরোকেমিক্যাল যা ঘুম, জাগরণ, ঘুমের আরইএম পর্যায় ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। এটি ঘাটতির ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েন বা জেগে যান।
যাদের ক্যাটাপ্লেক্সি হয় সাধারণত তাদের মাঝেই হাইপোক্রেটিনের মাত্রা কম থাকে। তবে কোন কারণে মস্তিষ্কের হাইপোক্রেটিন উৎপাদনকারী কোষ কমে যায় তা এখনো অজানা। তবে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন যে অটোইমিউন প্রতিক্রিয়ার কারণে এই রাসায়নিক এর মাত্রা কমে যায়।
তাছাড়া নারকোলেপ্সি এর জন্য জিনগত কিছু কারণও ভূমিকা রাখে। তবে এই রোগ পিতামাতার থেকে সন্তানে স্থানন্তর হওয়ার সম্ভাবনা ১ শতাংশ। গবেষণায় এও দেখা গিয়েছে যে সোয়াইন ফ্লু (H1N1 ফ্লু) ভাইরাস এবং H1N1 ভ্যাক্সিন এর প্রভাবেও এটি হতে পারে।
নারকোলেপ্সির আরো কিছু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
বয়স: নারকোলেপ্সি সাধারণত ১০ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে দেখা যায়।
পারিবারিক ইতিহাস: কোনো ব্যক্তির পরিবারের কোনো সদস্যের যদি নারকোলেপ্সি থাকে তবে সেই ব্যক্তির নারকোলেপ্সি হওয়ার সম্ভাবনা ২০ থেকে ৪০ গুণ বেশি।
নারকোলেপ্সির চিকিৎসাঃ-
একজন মানুষের মধ্যে যদি নারকোলেপ্সি এর লক্ষণগুলো প্রকটভাবে দেখা দেয় তবে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
নারকোলেপ্সি নির্ণয়ের জন্য সাধারণত দুটি পরীক্ষা করা হয়। এগুলো হলো: পলিসমনোগ্রাম ও মাল্টিপল স্লিপ ল্যাটেন্সি টেস্ট। এছাড়াও আধুনিক গবেষণায় মস্তিষ্কের তরলে হাইপোক্সেটিন এর মাত্রা পরিমাপ করেও নারকোলেপ্সি নির্ণয় করা হয়। দুঃখজনক হলেও এটি সত্যি যে, নারকোলেপ্সি রোগটির সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করা সম্ভব নয়। তবে ঔষধ এবং জীবনযাপন পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন করলে এই রোগটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। যেমন: অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের সাহায্যে ক্যাটাপ্লেক্সি, হ্যালুসিনেশন, ঘুমের মধ্যে অসাড়তা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
নিশাত তাসনিম/ নিজস্ব প্রতিবেদক