সম্প্রতি ‘চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্স’ এর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সাংহাই মহাকাশ গবেষণা একাডেমি’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এর সাহায্যে একটি নতুন প্রক্রিয়ায় নক্ষত্রের বিবর্তন নিয়ে গবেষণার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা প্রকাশ করেন। প্রফেসর জি জিয়ান এর নেতৃত্বে গবেষক দল কোয়াসার বর্ণালির তথ্য থেকে সৃষ্টি দূর্বল সিগন্যাল নিয়ে অনুসন্ধান করার সময় এমন তথ্য উঠে আসে।
‘রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’র প্রকাশিত মাসিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, নক্ষত্রের গঠন এবং বিবর্তন নিয়ে গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে Neutral Carbon Absorber বা নিরপেক্ষ কার্বন শোষক। নিরপেক্ষ কার্বন শোষক হলো মহাবিশ্বের ধূলিকণায় উপস্থিত ঠান্ডা গ্যাস থেকে গঠিত হওয়া নিরপেক্ষ কার্বন পরমাণু। দূরবর্তী কোন অতি প্রাচীন নক্ষত্রের মধ্যে জমে থাকা ধূলিকণা প্রায়শই কার্বন পরমাণু দ্বারা পূর্ণ থাকে। এর ফলে গবেষণার একটি বিশেষ সুযোগ তৈরি হয়েছে, আর তা হলো কোনোভাবে বিজ্ঞানীরা যদি এসব নক্ষত্রের শূন্যস্থান পূরণকারী কার্বন পরমাণু চিহ্নিত করতে পারেন তাহলে খুব সহজেই ঐ নক্ষত্রের অতীত সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যেতে পারে। এসব শূন্যস্থান ভর্তি কার্বনের সংযোগকে বিজ্ঞানীরা নিরপেক্ষ কার্বন শোষক নামে অবিহিত করেন। কিন্তু সমস্যা হলো এসব শোষক থেকে নির্গত সিগন্যাল অত্যন্ত দূর্বল এবং তা আধুনিক রাডারে ধারণ করা তুলনামূলক জটিল।
বিজ্ঞানীরা সাধারণত পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে কোয়াসার বর্ণালির ডাটাসেটে নিরপেক্ষ কার্বন শোষক শনাক্ত করেন। কিন্তু এই পদ্ধতি অনেক বেশি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। জি জিয়ান জানান, “এটি অনেকটা খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতো ব্যাপার।”
তবে ২০১৫ সালে Sloan Digital Sky Survey বা সংক্ষেপে SDSS প্রোগ্রামের আওতায় ৬৬ টি নিরপেক্ষ কার্বন শোষকের আবিষ্কার করা হয়, যা ছিল তখন পর্যন্ত আবিষ্কার হওয়া সবচেয়ে বড় নমুনা।
উক্ত গবেষণায় প্রফেসর জি জিয়ান ও তার দল গবেষণার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এর মাধ্যমে ‘ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্ক’ এর একটি মডেল তৈরি করেন। ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্ক হল এক ধরনের কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক, যা মানব মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি করা হয়। অতঃপর বাস্তবে প্রাপ্ত কার্বন শোষকের উপর ভিত্তি করে সিমুলেট করা কার্বন শোষকের নমুনা দ্বারা উক্ত মডেলকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
পরবর্তীতে ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্ক এর মডেলটি Sloan Digital Sky Survey-III বা সংক্ষেপে SDSS-III প্রোগ্রামের অধীনে গবেষণার কাজে ব্যবহার করেন। গবেষকরা উক্ত গবেষণায় ১০৭ টি অতিমাত্রায় দুর্লভ কার্বন শোষকের আবিষ্কার করেন, যা ২০১৫ সালে প্রাপ্ত সংখ্যা থেকে প্রায় দ্বিগুণ। এতে করে বিজ্ঞানীদের দাবি, আগে সূক্ষ্ম ও দুর্বল সিগন্যালগুলো বিজ্ঞানীদের নজর এড়িয়ে গেলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে এসব সিগন্যাল আবিষ্কার সহজ হয়েছে যা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিগোচরেই ছিল।
প্রাপ্ত সকল সূক্ষ্ম বর্ণালি সিগ্যালের উপর পরীক্ষা চালিয়ে গবেষণা দল ধূলিকণায় বিভিন্ন উপাদান খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়াও ধুলোর কারণে গ্যাসের ধাতু হারানোর পরিমাণও সরাসরি পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। এসব ফলাফল এটিই ইঙ্গিত করছে যে, প্রাগৈতিহাসিক কালের গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে যাদের নিরপেক্ষ কার্বন শোষক বিদ্যমান তারা খুব দ্রুত ভৌত ও রাসায়নিক বিবর্তন এর মধ্য দিয়ে গেছে। আর তখন মহাবিশ্বের বয়স ছিল আনুমানিক প্রায় তিন বিলিয়ন বছর। এটি উল্লেখ্য যে মহাবিশ্বের বর্তমান বয়স ১৩.৭৫ বিলিয়ন বছর। যে-সব গ্যালাক্সি বিবর্তন পর্যায় ও মিল্কিওয়ের মতো স্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজমান তাদের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ ভারী ধাতু তেরি করে। এছাড়াও কিছু পরিমাণ ধূলিকণাও সৃষ্টি হয়। আর ঠিক এই কারণেই এসব নক্ষত্রের মেঘ দেখতে লাল রং এর হয়ে থাকে। আর এমন গ্যালাক্সি মহাকাশে প্রচুর পরিমাণে লক্ষণীয়।
আর আগে সম্প্রতি এযাবৎ কালে তৈরি সর্ব বৃহৎ টেলিস্কোপ ‘জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ’ বা JWST-র দিয়ে একই ধরনের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন বিজ্ঞানীরা। JWST গবেষণা দল দাবি করেন যে প্রাচীন গ্যালাক্সিগুলো হীরার মতো কার্বন ধূলিকণা দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল এবং তা খুব দ্রুতই বিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থানে আসছে। আর কিছু গ্যালাক্সি স্বাভাবিকের তুলনায় অত্যন্ত দ্রুত বিবর্তিত হয় যা মূল ধারার গ্যালাক্সি মডেলকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এবারের নতুন গবেষণা JWST’র গবেষণাকেই সমর্থন করে।
তবে JWST গবেষণা এবং চায়নার গবেষণা দলের প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। যেখানে JWST গ্যালাক্সি থেকে নিঃসৃত বর্ণালি পরীক্ষা করে তার বিবর্তন ও পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা দেয় সেখানে নতুন এই গবেষণা নক্ষত্রের ফাঁকা জায়গায় বিরাজমান নিরপেক্ষ কার্বন শোষক থেকে আসা দুর্বল বর্ণালি সিগন্যাল পরীক্ষা করে ফলাফল দেয়। তাই সহজ ভাষায় বলা চলে দুটি পদ্ধতি একটি অপরটির পরিপূরক এবং তুলনামূলক ভাবে নতুন পদ্ধতি সাশ্রয়ী। উল্লেখ, JWST তৈরি এবং মহাকাশে প্রেরণ ছিল এযাবৎ কালের সবচেয়ে বেশি খরচে মিশনের একটি।
নতুন গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা দলের প্রধান জি জিয়ান বলেন,
“কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এর সাহায্য আমাদের আরোও উদ্ভাবনীমূলক অ্যালগরিদম তৈরি করা প্রয়োজন, যার ফলে মহাকাশের তথ্যে প্রাপ্ত বিশাল পরিমাণ দুর্বল, সূক্ষ্ম ও বিরল সিগন্যাল নিয়ে খুব সহজে ও দ্রুত পরীক্ষা চালানো সক্ষম হবে।”
গবেষণা দল বর্তমানে নতুন এই গবেষণা পদ্ধতি সকলের কাছে পরিচিত করে তোলা এবং ব্যবহার প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের আশা এর ফলে সূক্ষ্ম ও দুর্বল সিগন্যাল পরীক্ষা সহ বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা আরো সহজ হবে।
এস এম ইফতেখার আলম/নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ফিজিক্স.অর্গ, সাংহাই অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারবেটরি