কেমন হতো যদি আমাদের কাছে থাকা যেকোনো ধাতুর ফাটল স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবার আগের রূপে ফিরিয়ে আনা যেত? হ্যাঁ, অসম্ভব মনে হলেও স্যান্ডিয়া ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ এবং টেক্সাস এ এন্ড এম ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এমন একটি ধাতুর আবিষ্কার করেছেন যে ধাতু নিজের ফাটল নিজে সারিয়ে তুলতে সক্ষম।
বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো এমন একটি ধাতব ফাটলের সন্ধান পেয়েছেন যা মানুষের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই আপনা-আপনি ধাতু নিজের রূপে আবার ফিরে গিয়েছে। ঘটনাটি বিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্বগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। যদি নতুন আবিষ্কৃত ঘটনাটিকে বাস্তব জীবনে ব্যবহার করা যায় তবে এটি একটি প্রকৌশল বিপ্লবের সূচনা করতে পারে।
যেমন: এর মাধ্যমে স্ব-নিরামেয় ইঞ্জিন, সেতু এবং উড়োজাহাজ সহ আরো নানান কিছু তৈরি করা যাবে যা বজ্রপাত এবং পানি দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতিকে স্বয়ংক্রিয় ভাবে সারিয়ে তুলতে পারে। এর মাধ্যমে এই সকল বস্তুকে আরো নিরাপদ এবং দীর্ঘস্থায়ী করে তোলা সম্ভব।
স্যান্ডিয়া ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ এবং টেক্সাস এ এন্ড এম ইউনিভার্সিটির গবেষকরা কিছুদিন পূর্বে তাদের নেচার জার্নালে এই ফলাফল প্রকাশ করেছেন।
ধাতু বিজ্ঞানী ব্র্যাড বয়েস বলেছেন,
“এই ধরনের ঘটনা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমরা অবশ্যই এমন কোন ফলাফল আশা করছিলাম না। আমরা যা নিশ্চিত করেছি তা হল যে ধাতুগুলোর নিজস্ব অভ্যন্তরীণ ফাটল নিরাময় করার প্রাকৃতিক ক্ষমতা রয়েছে, অন্তত ন্যানোস্কেলে তা কার্যকর।”
ন্যানোস্কেল বলতে বারবার চাপ বা গতির কারণে যে মাইক্রোস্কোপিক ফাটল তৈরি হয় তাকে বোঝানো হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে এই ফাটলগুলো বৃদ্ধি পায় এবং ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফিশার বয়েস এবং তার দল দেখতে পান যে ছোট ছোট ফাটলগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। যদিও তা অতি ক্ষুদ্র পরিমাণে, কিন্তু ফাটলগুলোর মধ্যকার ক্ষত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পূর্ণ হয়েছিল এবং এটি ন্যানোমিটারে পরিমাপ করা হয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা এর পূর্বেও কিছু স্ব-নিরাময়কারী ধাতু তৈরি করেছেন, তবে তার বেশিরভাগই প্লাস্টিক। যদিও স্ব-নিরাময়কারী ধাতুর ধারণাটি মূলত বিজ্ঞান ভিত্তিক কথাসাহিত্য থেকে নেয়া হয়েছে। মানুষ সহ অন্যান্য অসংখ্য জীব আঘাত সেরে তোলা এবং অসুস্থতা থেকে নিজেকে সুস্থ করার বিভিন্ন উপায় আয়ত্ত করেছে।
তবে কৃত্রিম বস্তুদের এই-ধরনের স্ব-নিরাময় ক্ষমতা তৈরি করা একটি সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। কিছু পদার্থ, যেমন: প্লাস্টিক এবং সিরামিকের আংশিক স্ব-নিরামেয় ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেছিলেন যে ধাতুগুলোর স্ব-নিরামেয় ক্ষমতা আরো বেশি। যা ক্ষতগুলোকে সম্পূর্ণ রূপে মেরামত করতে সক্ষম হতে পারে।
ধাতু বিজ্ঞানী বয়েস ধাতুগুলোর ব্যাপারে বলেন যে,
“ধাতুগুলোতে ফাটলগুলো শুধু বড় হওয়ার আশাই করা হয়েছিল, ছোট নয়। এমনকি ঘটনাটি কিছু মৌলিক সমীকরণের বিপরীতে কাজ করে।”
মাইকেল ডেমকোভিচ এবং এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ গুওকিয়াং জু ২০১৩ সাল একটি যৌথ গবেষণায় এমন একটি প্রক্রিয়ার উপস্থাপন করেছিলেন যা ধাতব ন্যানোক্র্যাক নিরাময় করতে পারে। তারা একটি মাদারবোর্ডের উপর এই প্রক্রিয়ার পরীক্ষা করেন। তারা নিশ্চিত ছিলেন না কীভাবে পরীক্ষাগারে হাইপোথিসিসের ব্যবহার করা হয়।
তিনি কম্পিউটার সিমুলেশনের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে একটি নতুন তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন। যে নির্দিষ্ট শর্তে ধাতু পরিধান এবং টিয়ার দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের মধ্যকার ফাটলকে ঢালাই করতে সক্ষম।
ইউনিভার্সিটি অফ টেনেসি এর একজন সহযোগী অধ্যাপক খালিদ হাত্তার এবং পারমাণবিক শক্তি বিষয়ক বিজ্ঞানী ক্রিস বার গবেষণা চলাকালীন সান্ডিয়াতে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন৷ তারা প্রতি সেকেন্ডে 200 বার ধাতব প্রান্তে চাপ সৃষ্টির জন্য একটি বিশেষ ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে প্লাটিনামের একটি ন্যানোস্কেল টুকরার মাধ্যমে কীভাবে ফাটল তৈরি এবং ছড়িয়ে পড়ে তা মূল্যায়ন করতে চেয়েছিলেন।
আশ্চর্যজনকভাবে, পরীক্ষা শুরু হওয়ার প্রায় ৪০ মিনিটের মধ্যে তারা যা আশা করছিলেন তার বিপরীত হওয়া শুরু করলো। ফাটলের এক প্রান্ত আবার একত্রিত হতে শুরু করলো যেন এটি তার পূর্বের রূপে ফিরে যাচ্ছে। এটি এতোটাই সূক্ষ্ম ছিল যে ফাটলের কোনও চিহ্ন অবধি রেখে যায়নি। সময়ের সাথে সাথে ফাটলটি একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
বয়েস আরও জানান যে,
“আমাদের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সোল্ডার জয়েন্ট, আমাদের গাড়ির ইঞ্জিনগুলো থেকে শুরু করে আমরা যে সেতুগুলো দিয়ে গাড়ি চালাই, এই কাঠামোগুলো প্রায়শই অতিরিক্ত চাপের কারণে অপ্রত্যাশিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ছোট ছোট ফাটল তৈরি হয় যা শেষ পর্যন্ত ফ্র্যাকচারের রূপ নেয়।
যখন এই অবকাঠামো গুলো বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় তখন আমাদের প্রতিস্থাপনের ব্যয়বহুল খরচ, সময়ের অপচয় এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রাণহানিরও সম্মুখীন হতে হয়। এর ফলে আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিরও সম্মুখীন হতে হয়। এ-ধরনের বিপর্যয়ের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বছর শত শত বিলিয়ন ডলার ক্ষয়ক্ষতি হয়।”
এই গবেষণার ফলাফল জানতে পেরে ডেমকোভিজ বলেন,
“আমি কিছুটা শঙ্কার মধ্যে ছিলাম যে কীভাবে এটি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলোও ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। আমি মনে করি দল সত্যিই অনেক প্রশংসার দাবিদার।”
স্ব-নিরাময় প্রক্রিয়া সম্পর্কে এখনো অনেক কিছুই অজানা হয়ে আছে, যার মধ্যে এটি একটি প্রাথমিক আবিষ্কার মাত্র।
ডেমকোভিচ বলেছেন,
“আমার আশা হলো এই যে আবিষ্কারটি গবেষকদের এই বিষয়ে আরো গবেষণা করতে উৎসাহিত করবে। সঠিক পরিস্থিতিতে উপকরণগুলো এমন কিছু অসাধ্য সাধন করতে পারে যা আমরা পূর্বে কখনো আশাও করিনি।”