কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জে এক যুবককে ধর্ষণের ঘটনাটি পুরুষদের ওপর যৌন নির্যাতনের মতো একটি গুরুতর বিষয়কে নতুন করে সামনে এনেছে। আমাদের সমাজে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে, পুরুষরা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে নারীদের তুলনায় কম মানসিক আঘাত বা ট্রমার মধ্য দিয়ে যান। নারীদের তুলনায় পুরুষদের প্রতি যৌন সহিংসতা নিয়ে সমাজ কিংবা মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে আলোচনা প্রায় হয়ই না। বাস্তবতা হলো, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেকোনো বয়সী ব্যক্তির ওপর যৌন নির্যাতনের আফটারম্যাথ খুবই ভয়াবহ। আজ কথা হবে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ভুক্তভোগী পুরুষদের নিয়ে।
Male Rape নিয়ে আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষ মোটাদাগে একেবারেই কোনো জ্ঞান রাখেন না। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেরা জানেই না যে তাকে ধর্ষণ করা সম্ভব। বালক, কিশোর, এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রেও নির্যাতনকারী ব্যক্তি ভিক্টিমের পূর্বপরিচিত। পুরুষরা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে অ্যানজাইটি, ডিপ্রেশন, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, ফ্ল্যাশব্যাক বা খাবারে অনিয়মের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেকে নির্যাতনের কথা মনে করিয়ে দেয় এমন মানুষ বা স্থান এড়িয়ে চলতে শুরু করেন, এমনকি বন্ধু-বান্ধব ও পরিবার থেকেও আস্তে আস্তে দূরে সরে যান।
ধর্ষণের ফলে শারীরিক আঘাত, সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ইনফেকশন, ক্রনিক পেইন এবং সেক্সুয়াল ডিসফাংশন তৈরি হতে পারে। ব্যথা ও হীনমন্যতা কমাতে অনেকে মাদক নেওয়া শুরু করেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, নির্যাতনের শিকার না এমন পুরুষদের তুলনায় যৌন নির্যাতনের শিকার পুরুষদের মধ্যে সুইসাইডাল চিন্তাভাবনা ২.৫ গুণ বেশি এবং নির্যাতনের শিকার পুরুষদের ১৬ শতাংশেরও কম লোক কাউন্সেলিং করান! নারীদের মতই পুরুষরাও ইন্টিমেসি ইস্যুর সম্মুখীন হন, নিজেকে আইসোলেট করে ফেলেন এবং অনেকে কখনোই সঙ্গীর সাথে স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কে ফিরে যেতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে ছোটবেলায় নারী কর্তৃক নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার ছেলেরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও মহিলাদের সাথে ঘরে একা থাকতে ভয় পান।
এডাল্ট বয়সে যৌন নির্যাতনের শিকার পুরুষেরা তীব্র লজ্জা এবং সেলফ-ডাউট এ ভোগেন। এর কারণ সমাজে প্রচলিত ‘স্ট্রং ম্যান’ বা ‘পুরুষ মানুষ কাঁদে না’ — এর মত কিছু পপুলিস্ট স্টেরিওটাইপ। ধর্ষিত বা নির্যাতিত হওয়ার পর অধিকাংশ পুরুষ মনে করেন নিজেকে রক্ষা করার জন্য তার যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া উচিত ছিল। কেউ কেউ মনে করেন, তার নিজেরই কিছু বৈশিষ্ট্যের (নারীসুলভ চেহারা বা শারীরিক দুর্বলতা) কারণে নির্যাতনকারী তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।
নির্যাতিত হওয়ার সময় অনেকের ইরেকশন এবং ইজ্যাকুলেশন হতে পারে। এতে তারা বিভ্রান্ত হয়ে পরেন এবং অনেক সময় (বিশেষত, পুরুষ কর্তৃক ধর্ষিত বা নির্যাতিত হলে) নিজের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যান। এর সাইকোলজিক্যাল সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে নির্যাতনকারী, ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। তারা ভিক্টিমকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, সে (ভিক্টিম) ব্যাপারটা উপভোগ করেছে; যেন ভিক্টিম নিজের ধর্ষণের জন্য নিজেকেই দোষারোপ করে এবং সব কিছু গোপন রাখে। তবে, এটি একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া। ভিক্টিমের লিঙ্গ-উত্থান বা বীর্যপাত কোনোভাবেই একটি যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণকে ভ্যালিডেট করে না।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত সবচেয়ে ভ্রান্ত ধারণাটি হচ্ছে একজন নারী কখনো পুরুষকে ধর্ষণ করতে পারে না। অনেকে মনে করেন পুরুষরা সহজাতভাবেই তীব্র যৌনাকাঙ্ক্ষী এবং যৌন আকাঙ্খা ছাড়া একজন পুরুষ উত্তেজিত হতে পারেন না; সুতরাং পুরুষ কেবল স্বেচ্ছায় সহবাস বা যৌনকর্মে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং এ কারণেই একজন পুরুষ কখনো ধর্ষণের শিকার হতে পারেন না। অনেকে ভাবেন যৌনতা এমন কিছু, যা কেবল পুরুষরাই মহিলাদের সাথে করে। এগুলো পুরুষের যৌনতা নিয়ে একইসাথে অত্যন্ত ভুল এবং সেক্সিস্ট ধারণা।
নারী কর্তৃক কোনো পুরুষ ধর্ষিত হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে খবর কখনো মিডিয়াতে আসে না। তবে, জিম্বাবুয়ের একটি ঘটনা মোটামুটি সাড়া ফেলেছিল। ২০১১ সালে তিনজন মহিলাকে এমন এক অভিযোগে আটক হয়, যা শুনে পুরো দেশ রীতিমত হতবাক হয়ে যায়। পুলিশের ধারণা ছিল দেশজুড়ে মহিলাদের একটি সিন্ডিকেট ধনী হওয়া যাবে এমন কোনো রিচুয়ালে স্পার্ম ব্যবহার করার জন্য পরিকল্পিতভাবে পুরুষদের ধর্ষণ করছে। একজন ভুক্তভোগী জানান, লিফট দেওয়ার কথা বলে গাড়িতে তুলে তার মুখে জল ছুঁড়ে মারা হয়। এরপর, এমন কিছু ইনজেকশন দেওয়া হয়, যা তার মধ্যে তীব্র যৌন উদ্দীপনা তৈরি করে। এরপর ওই তিন মহিলা কয়েকবার গাড়ি থামিয়ে তাদের প্রত্যেকের সাথে যৌন সম্পর্ক করতে বাধ্য করে এবং সব শেষে তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় জঙ্গলে ফেলে চলে যায়। পুলিশ ওই মহিলাদের গাড়ি থেকে ৩১টি ব্যবহৃত কনডম উদ্ধার করে, যেখানে তারা স্পার্ম জমা করছিল।
ধর্ষণের শিকার অনেক পুরুষ অন্যদের তুলনায় কম ‘ম্যানলি’ হয়ে যাওয়ার ভয়ে বা ‘পুরুষ’ হওয়ার ইগো থেকে নিজেকে ‘ভিক্টিম’ হিসেবে স্বীকারই করতে চান না। এসব পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং মানসিকতার ফসল। তাছাড়া, একজন পুরুষ যৌন নির্যাতনের শিকার হলে সাধারণত মানুষ সেটাকে হাসি-তামাশার বিষয় বানিয়ে ফেলে। সিনেমা জগতেও গত কয়েক দশক ধরে পুরুষদের ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতন করাকে সাধারণত কমেডি হিসেবেই দেখানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে Mysterious Skin, Sleepers বা The Last Duel এর মত সিনেমাগুলো কিছুটা ব্যতিক্রম। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে যৌন নির্যাতনের ফলে পুরুষের মধ্যে তৈরী হওয়া হীনমন্যতার দিকটি ভিকি জাহেদের পরিচালনায় “চিহ্ন” ছাড়া সম্ভবত অন্য কোনো কাজে উঠে আসে নি। সারা পৃথিবীতে যৌন সহিংসতা নিয়ে নারীকেন্দ্রিক যত ক্রিয়েটিভ কাজ হয়, তার তুলনায় পুরুষদের নিয়ে তৈরী কাজের পরিমাণ নগণ্য।
মূলত ধর্ষণ একটি ক্ষমতার প্রদর্শনের মাধ্যম, এখানে যৌন উত্তেজনা বা আকাঙ্ক্ষার কোনো ভূমিকাই থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তির ওপর কেবল নিয়ন্ত্রণ লাভ ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্যই ধর্ষণ করা হয়, যৌন তৃপ্তির জন্য না। উদাহরণ হিসেবে বিভিন্ন সামরিক অভিযানে পুরুষদের ধর্ষণের করার দিকটি উঠে আসে। অবাক লাগলেও সামরিক অভিযানে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের ধর্ষিত হওয়ার নজির অহরহ।
পেন্টাগনের পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রতি বছর আমেরিকান সেনাবাহিনীতে গড়ে প্রায় ১০,০০০ পুরুষ যৌন নির্যাতনের শিকার হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউএস আর্মি কর্তৃক পুরুষদের ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন একটি স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। চিলি, গ্রীস, ক্রোয়েশিয়া, ইরান, কুয়েত, কঙ্গো, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুগোস্লাভিয়ার মতো দেশগুলোতে পলিটিক্যাল অ্যাগ্রেশন বা যুদ্ধকালীন সময়ে পুরুষদের সাথে অগণিত নৃশংস যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অভিযানে রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে নারীদের পাশাপশি অসংখ্য পুরুষ তীব্র যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
বিশ্বজুড়ে পুরুষদের যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনাগুলোর বিচারে রয়েছে আইনি জটিলতা। আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো অনেক দেশই Male Rape কে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান আইনে কেবল একজন পুরুষ কর্তৃক একজন নারীই ‘ধর্ষিত’ হতে পারেন। একজন পুরুষকে কখন ‘ধর্ষিত’ বিবেচনা করা হবে, তা পেনাল কোডে উল্লেখ করা হয় নি। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী ‘শিশু’ বলতে ১৬ বছরের কম বয়সী যেকোনো ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। যেহেতু, এখানে কোনো লিঙ্গ নির্দিষ্ট করা নেই; সেহেতু, ধর্ষণের শিকার পুরুষ শিশুরাও এই আইনের অন্তর্ভুক্ত এবং এর অধীনে মামলা দায়ের করতে পারেন।
কিন্তু, ২০১৩ সালের শিশু আইনে শিশুর বয়সসীমা ১৮ বছরের কম। এখানে প্রশ্ন ওঠে, ১৬-১৮ বছর বয়সের মধ্যে কেউ ধর্ষিত হলে সে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’ এর আওতায় আসবে কি না?
দুর্ভাগ্যবশত, ১৬-১৮ বছর বয়সী ‘শিশু’ হলেও তাকে এই আইনের আওতায় নাও আনা হতে পারে। সেক্ষেত্রে, এই অপরাধটি ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার অধীনে দায়ের করা যেতে পারে, যা ‘স্বেচ্ছায়’ অস্বাভাবিক যৌন অপরাধ বা সমকামিতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নারায়ণগঞ্জের সেই ২০ বছর বয়সী যুবককে ধর্ষণের ঘটনাতেও সমকামিতার অভিযোগেই মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বলা বাহুল্য যে, দেশের বিদ্যমান ধর্ষণ আইন কোনো অবস্থাতেই পুরুষদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবে না। বিশেষ করে, নারী কর্তৃক ধর্ষিত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব। তবে, শীঘ্রই শুধু পুরুষ কর্তৃক না, বরং যে কোনো ‘ব্যক্তি’ কর্তৃক ধর্ষণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। অনেক দেশই তাদের আইন সংশোধন করে ধর্ষণকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে যেন ধর্ষক এবং ধর্ষিত — উভয়ই লিঙ্গ নির্বিশেষে ‘ব্যক্তি’ হিসেবে আইনের আওতায় আসে।
একজন পুরুষ যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হলে তাকে সাহায্য করার জন্য আগে ব্যক্তিপর্যায়ে আমাদের সহানুভূতিশীল হতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে কিশোর বা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মুখ থেকে নির্যাতনের কথা জানতে পারাটাই একটা বড় ব্যাপার। ঘটনার খুঁটিনাটি জানতে চেয়ে তাকে আরও বিব্রত করবেন না এবং গোপনীয়তা বজায় রাখবেন। যদি সে নিজে থেকে কিছু বলে, তাহলে জাজমেন্টাল না হয়ে মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে হবে। পুরুষদের ক্ষেত্রে সাহায্য চাওয়াটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, নিজ উদ্যোগেই তাকে সাহায্য করুন। তাছাড়া, নারীর পাশাপাশি পুরুষদের নিয়ে প্রচলিত স্টেরিওটাইপগুলোর বিরুদ্ধেও আমাদের কথা বলতে হবে।
ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি নারী হোক বা পুরুষ, তাদের জীবনকে আমরা যেন আরও বিষিয়ে না তুলি। ধর্ষণের দায় কেবল ধর্ষকের উপরই বর্তায়। সমাজে প্রচলিত সকল বৈষম্য দূর করে, প্রতিটি নির্যাতিত নারী-পুরুষ সমান আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা পাবে — এই আমাদের প্রত্যাশা।
প্লাবন গোস্বামী / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: রেইন.অর্গ, ক্যাম ল এলএলপি, ইউসিএনিউজ, বিডি ল.মিনি ল.গভ.বিডি, টিবিএসনিউজ.নেট, বিডিনিউজ২৪.কম, বিবিসি.কম, এনওয়াইটাইমস.কম, দ্য গার্ডিয়ান.কম, সেগপাব.কম, দ্য নিউ হিউম্যানিটারিয়ান.অর্গ