২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি সৌদি আরবের যুবরাজ “দ্য লাইন” নামের একটি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী নগর গড়ে তোলার ঘোষণা দেয় যা নগর জীবনের ধারণাকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার কথা ভাবাচ্ছে। বৃহত্তর NEOM প্রকল্পের অংশ হিসেবে, দ্য লাইন অতীতের করা শহরগুলোর সবচেয়ে জরুরি সমস্যাবলি যেমন যানজট, পরিবেশ দূষণ এবং অদক্ষ অবকাঠামো সমাধান করার লক্ষ্য নিয়ে একটি টেকসই, দক্ষ এবং মানব-কেন্দ্রিক নগর পরিবেশ তৈরির জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে।
একটি বৈপ্লবিক নগর ধারণা
দ্য লাইনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হলো এর টেকসই এবং শূন্য কার্বন নির্গমনের (zero carbon emissions) প্রতিশ্রুতি। সম্পূর্ণরূপে পুনর্ব্যবহার ও নবায়নযোগ্য শক্তি দ্বারা চালিত শহরটি জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা দূর করতে চায় যা উল্লেখযোগ্যভাবে তার কার্বন পদাঙ্ক (carbon footprint) কমিয়ে দিবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং স্মার্ট সিস্টেমের সংযোজন শক্তি খরচ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জলের ব্যবহারকে অপ্টিমাইজ করবে, সবুজ নগর উন্নয়নের জন্য একটি নতুন আদর্শ স্থাপন করবে।
মানব-কেন্দ্রিক নগর জীবন
বিশ্বের স্বনামধন্য সব স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদের সহায়তায় একটি আদর্শ শহররূপে দ্য লাইন শহরটিকে ডিজাইন করা হবে। এই শহরটি লোহিত সাগর থেকে তাম্বুক শহর পর্যন্ত বিস্তৃত যেখানে জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০ লক্ষ। এর ক্ষেত্রফল হবে মাত্র ৩৪ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ, এই শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব হবে প্রায় ২৬০০০০। উল্লেখ্য, ঢাকা শহরের মোট ক্ষেত্রফল ৩০৬ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৮০০০!
কিন্তু এই বিপুল জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও এই শহরে থাকবেনা কোনো বড় সড়ক বা যানবাহন। শহরটিতে যানবাহন চলাচলের চেয়ে মানুষের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এর ১৭০ কিলোমিটার সীমানার মধ্যে কোনও রাস্তা বা গাড়ি থাকবে না বরং এর পরিবর্তে ভূগর্ভস্থ ও উচ্চ-গতির ট্রানজিট সিস্টেম দ্বারা প্রদান করা হবে পরিবহন সেবা যা মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে শহরের দৈর্ঘ্য ভ্রমণ করতে পারে। কারণ এই ১৭০ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকা সম্পূর্ণভাবে একত্রিত নয়। একে বিভক্ত করা হয়েছে ১৪০টি অঞ্চলে যাদের বলা হয় মডিউল । মডিউলগুলোর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা যথাক্রমে ৮০০ মিটার, ২০০ মিটার ও ৫০০ মিটার।
পুরো শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মাত্র ২০ মিনিটে যাতায়াতের জন্য থাকবে বিশেষ ট্রেন । এই নির্বিঘ্ন এবং দক্ষ গণপরিবহন নেটওয়ার্কটি নিশ্চিত করবে যে সমস্ত প্রয়োজনীয় সেবা এবং সুযোগ-সুবিধা যেমন খাদ্য, চিকিৎসা, উচ্চশিক্ষা সবকিছুই শহরের যেকোনো স্থান থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটার মধ্যে থাকে।
দ্য লাইনকে একাধিক স্তরে বিভক্ত করে প্রতিটি স্তর একটি ভিন্ন উদ্দেশ্যে তৈরি করা হবে। বিভিন্ন স্তরের মধ্যে পৃষ্ঠ বা সর্বোচ্চ স্তরটি হবে পথচারী এলাকা যা সবুজ স্থান, পার্ক এবং পাবলিক এলাকায় পূর্ণ যা সামাজিক সম্পৃক্ততা এবং সম্প্রদায়ের বন্ধন গড়ে তোলার জন্য ডিজাইন করা হবে। পুরো শহরটির বাইরের দেয়াল থাকবে কাঁচ দিয়ে আবৃত কিন্তু ভেতরে থাকবে স্বাভাবিক বায়ু চলাচল ব্যবস্থা।
এই প্রকল্পটির অন্যতম লক্ষ্য হলো প্রকৃতি রক্ষা করা, যার কারণে শূন্য কার্বন নিঃসরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে NEOM প্রকল্প। এর অভ্যন্তরে প্রাকৃতিকভাবে বছরের বিভিন্ন সময়ের তাপমাত্রা বজায় রাখা হবে। শহরের বাসিন্দাদের খাদ্যের যোগানও এখান থেকেই হবে। যার জন্য ভারটিক্যাল ফারমিং এর মতো উন্নত সব কৃষি প্রযুক্তিও প্রয়োগ করা হবে। এই বিপুল সংখ্যক জনগণের পানি সরবরাহের জন্য লোহিত সাগর থেকে পানি এনে তা লবনমুক্ত ও পরিশোধিত করে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হবে। এছাড়া বিদ্যুৎ ও অন্যান্য শক্তির চাহিদা নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস থেকে মেটানো হবে।
উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির বিশ্বায়ন
দ্য লাইন কেবল একটি আবাসিক শহরই নয় এটি উদ্ভাবন বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য একটি বৈশ্বিক কেন্দ্র হিসাবে কল্পনা করা হচ্ছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জায়ান্ট কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করে দ্য লাইন গবেষণা, প্রযুক্তি এবং উদ্যোক্তার জন্য একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। শহরটি উন্নত সুবিধা যেমন ডিজিটাল ফাইন্যান্স, উন্নত উৎপাদণ এবং টেকসই শক্তির মতো শিল্পগুলোর জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সরবরাহ করবে।
তাছাড়া লাল সাগরের বরাবর দ্য লাইনের কৌশলগত অবস্থান এটিকে বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং সরবরাহ নেটওয়ার্কগুলোর একটি মূল ‘নোড’ হিসাবে গড়ে তুলবে। সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০ এর অর্থনীতির বৈচিত্র্য এবং তেল ও খনিজ সম্পদ থেকে আয়ের উপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যগুলোর সাথে একত্রিত করে অত্র অঞ্চলের ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট গঠনে দ্য লাইনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে ।
পরিবেশবাদী ও বহির্বিশ্বের সমালোচনা
দ্য লাইন প্রকল্পটি সবাইকে অবাক করলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তি মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এটিকে ব্যাপকভাবে সমালোচিতও করেছে। প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় সাইবার আক্রমণে পুরো শহর হঠাৎ অকার্যকর হয়ে যেতে পারে বলে মার্কিন বিশেষজ্ঞদের ধারণা। অনেকের মতে এখানে মানব সমাজের থেকে প্রযুক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। তাদের ভাষ্যমতে সমাজ কাঠামোর যে বাস্তব প্রয়োগ দরকার তার অনেকটাই এখানে অনুপস্থিত।
কারণ এই শহরের বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত হওয়ার মতো নমনীয়তা নেই। শূন্য কার্বন নিঃসরণের বিষয়ে অধ্যাপক Philip Oldfield হিসাব করে দেখান এই শহর তৈরিতে কার্বন নিঃসরণ হবে ১.৮ গিগাটন যা যুক্তরাজ্যের বাৎসরিক কার্বন নিঃসরণ থেকে প্রায় ৪ গুণ বেশি। এছাড়া মরুভূমির ঝড় মোকাবেলা করে এই পুরো স্থাপনা টিকে থাকতে পারবে কি না তাও এখনও সন্দেহাতীত।
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যদিও দ্য লাইন ভবিষ্যতের নগর জীবনের জন্য একটি সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করছে, কিন্তু নির্মাতাদের কাছে এখনও এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রকল্পের মাত্রা এবং জটিলতার জন্য উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জন্য প্রতিনিয়ত পরিকল্পনা চলছে। এখন অবধি প্রকল্পের সম্পূর্ণ বাজেট ধরা হয়েছে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার! বিভিন্ন সিস্টেমের নির্বিঘ্ন সংহতকরণ নিশ্চিত করা এবং উন্নয়ন ও পরিবেশগত সংরক্ষণের মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখা এর সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।
এতসব জটিলতা ও সমালোচনার মধ্যেও টেকসই, মানব কল্যাণ এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে দ্য লাইন তৈরির কাজ চলছে তার আপন গতিতে। ২০৩০ সালে উন্মুক্ত হবে বসবাসের জন্য। তখন হয়ত বলতে পারা যাবে এ প্রকল্প ২১ শতকের নগর উন্নয়নের জন্য একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করতে পারবে নাকি শুধুই মরীচকা হয়ে থাকবে।
আদনান মেহমুদ সম্রাট / অতিথি প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ আরাবিয়ান বিজনেস.কম, জেটসেটি.কম, সৌদিপিডীয়া.কম, নিউম.কম