প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর ধরে ভূ-পৃষ্ঠে রাজত্ব করলেও সবশেষে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপে টিকে থাকতে পারছে না পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন শ্যাওলা তাকাকিয়া। জলবায়ুর পরিবর্তনেরর হারের সাথে তাল মেলাতে না পেরে বিলুপ্তির মুখে বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত শ্যাওলার সবচেয়ে দ্রুত বিকশিত এই প্রজাতি।
তাকাকিয়া হলো দুই প্রজাতির পূর্ব গণ যা উত্তর আমেরিকার পশ্চিমে এবং মধ্য ও পূর্ব এশিয়াতে পাওয়া যায়। একে শ্যাওলাদের মধ্যে একটি পৃথক পরিবার, ক্রম এবং শ্রেণী হিসাবে স্থাপন করা হয়। এটি হিমালয়ে আবিষ্কৃত হয় এবং ১৮৬১ সালে উইলিয়াম মিটেন এর বর্ণনা দেন। সেসময় তাকাকিয়া কে বিদ্যমান বংশগুলোর মধ্যে সামান্য একটি নতুন লিভারওয়ার্ট প্রজাতি হিসাবে বর্ণনা করা হয় ফলে এটি দীর্ঘদিন উপেক্ষিত ছিল।
Marchantiophyta পর্বের ৯,০০০ বা তার বেশি প্রজাতির উদ্ভিদকে বলা হয় লিভারওয়ার্ট। এগুলো নন-ভাস্কুলার উদ্ভিদ তাই এরা ভূমির সমতল বরাবর বৃদ্ধি পায়। এটি লিভারওয়ার্টসমূহের আর্দ্র পরিবেশ পছন্দ করার প্রধান কারণ।
ভূমি উদ্ভিদের যত পরিচিত গণ বর্তমানে বিদ্যমান তাকাকিয়া তাদের মধ্যে প্রাচীনতম। এরা নাইট্রোজেন ফিক্সেশন (একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেন অ্যামোনিয়ায় রূপান্তরিত হয়) ও মাইকোরাইজা (উদ্ভিদ ও ছত্রাকের মধ্যকার পারস্পরিক মিথোজীবী সম্পর্কের বন্ধন) এর সাথে সংযুক্ত অনুজীব বিশিষ্ট মাইক্রোবায়োম তৈরির জন্য মিউসিলেজ নিঃসরণ করে।
মাইক্রোবায়োম হলো একটি নির্দিষ্ট স্থানের বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাক সম্বলিত পরিবেশ। উদ্ভিদ দেহের মাইক্রোবায়োম কৃষিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জৈব সম্পদ কারণ উপকারী অণুজীবসমূহ উদ্ভিদের বৃদ্ধি বাড়ায় ও পুষ্টি গ্রহণকে সহজ করে।
তাকাকিয়া বরফ যুগে বাস করেছে, যুগের পর যুগ সহ্য করেছে প্রকৃতির উষ্ণতা এবং শীতলতা। ডাইনোসর হারিয়ে গেলেও তাকাকিয়া টিকে গেছে, সাক্ষ্মী হয়েছে যখন প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণীরা পৃথিবীর বুকে হাঁটে।
এমনকি ৫০ মিলিয়ন বছর আগে হিমালয়ের হিংস্র জন্মতে যখন তৎকালীন ভারতের দ্বীপ এশিয়ায় বিধ্বস্ত হয়েছিল এবং পাহাড়গুলোকে মাটি থেকে গড়ে তুলেছিল তখনও শ্যাওলাটি বেঁচে গিয়েছিল। এটি আজও বেড়ে ওঠে সেই পাহাড়ের চূড়ায়; পৃথিবীর সবচেয়ে ঠান্ডা এবং কঠোরতম পরিবেশে। লক্ষ লক্ষ বছরের পরিক্রমায় বাহ্যিকভাবে এর খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীনতম তাকাকিয়া জীবাশ্মটি ১৬৫ মিলিয়ন বছর আগের – যা দেখতে অনেকটা আধুনিক তাকাকিয়া এর মতোই।
গবেষকদের একটি দল বিগত এক দশক ধরে ৩৯০ মিলিয়ন বছর বয়সী এই শ্যাওলার উপর অধ্যয়ন করছেন। এটি মূলত তিব্বত মালভূমির বরফ এবং বিচ্ছিন্ন চূড়াগুলোতে জন্মে। হিমালয়ের চারপাশে অবস্থিত এই প্রত্যন্ত অঞ্চলটি বিশ্বের সর্বোচ্চ এবং বৃহত্তম মালভূমি যাকে “বিশ্বের ছাদ” নামে ডাকা হয়। তিব্বতের মালভূমিই পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে তাকাকিয়া শ্যাওলার উভয় প্রজাতি সহাবস্থান করে।
এক দশক দীর্ঘ অভিযানের পর, বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো এর ডিএনএ বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছেন যে কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন এর প্রজাতি এবং আবাসস্থলকে প্রভাবিত করছে। প্রাচীন শ্যাওলাটি হিমালয় এর চেয়ে ১০০ মিলিয়ন বছর পুরোনো ছিল। ফলে এর সৃষ্টিতে এটি দ্রুত অভিযোজন প্রক্রিয়া শুরু করে।
জার্মানির ফ্রেইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ জৈবপ্রযুক্তিবিদ রাল্ফ রেস্কি বলেন, “আমরা একটি জীবন্ত জীবাশ্মের বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করতে বেরিয়েছি।”
হিমালয়ের উচ্চ উচ্চতা এবং বৈরি আবহাওয়ার কারণে অভিযানটি মোটেও সহজ ছিল না। উদ্ভিদ জীববিজ্ঞানী এবং এই অভিযানের সহ-নেতা রুয়াং হু বলেছেন, “এই স্থানের আবহাওয়া এক দিনের মধ্যে চারটি ঋতু অতিক্রম করতে পারে”।
তিনি আরও বলেন, “পাহাড়ের পাদদেশে আবহাওয়া রৌদ্রোজ্জ্বল এবং পরিষ্কার। আপনি যখন অর্ধেক পথ পৌঁছান তখন সবসময় হালকা বৃষ্টি হয় – মনে হয় মেঘের মধ্যে হাঁটছেন। এবং আপনি যখন শীর্ষে পৌঁছান, তখন তুষারপাত হয় এবং প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে যায়।”
দলটি দেখেছে যে এই চরম আবহাওয়ার কারণে তাকাকিয়া নিজের ভাঙা ডিএনএ ঠিক করতে এবং অতিবেগুনি ক্ষয় থেকে পুনরুদ্ধারে পারদর্শী হয়ে গেছে। যার জন্য এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিবর্তিত হচ্ছে। এরকম প্রতিকূল অবস্থার সাথে লড়াই করে টিকে থাকার কারণে শ্যাওলাটি অভিযোজিত হয়ে যেকোনো স্থানে টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করেছে।
২০০৫ সালে চীনের গবেষকদের একটি দল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩,০০০ ফুট উপরে অবস্থিত তিব্বত মালভূমির একটি দক্ষিণ কোণে তাকাকিয়া আবিষ্কার করেন। তারা এই অঞ্চলে একটি চলমান অধ্যয়ন কেন্দ্র স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। গবেষকরা বছরে দুবার সেখানে পরিদর্শন করে সে অঞ্চলের মাটির গঠন, তাপমাত্রা এবং অন্যান্য পরিবেশগত তথ্য সংগ্রহ করেন। তারা দেখতে পান যে কয়েক দশক ধরে ওই এলাকায় তাপমাত্রা বাড়ছে। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তাপমাত্রা আকাশচুম্বী পরিমাণে বেড়েছে যা প্রতি বছর গড়ে প্রায় ০.৭৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এটি বিশ্বের যে কোনো স্থানে এত উচ্চতায় রেকর্ডকৃত দ্রুততম তাপমাত্রা বৃদ্ধি। তারা উল্লেখ করেছেন কিছু গাছপালা সময়ের সাথে সাথে পাহাড়ের আরো উঁচুতে সরে গিয়ে উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়।
রেস্কি বলেন, “কিন্তু তাকাকিয়া সম্ভবত এটি করতে সক্ষম হবে না। অন্তত মানব সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যথেষ্ট দ্রুত নয়।”
গবেষণা দল জলবায়ু সংকট কীভাবে উদ্ভিদকে প্রভাবিত করছে তা জানার জন্য প্রথমবারের মতো তাকাকিয়ার ডিএনএ ক্রমের নমুনা সংগ্রহ করে। “আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের কী বলতে পারে তা দেখার জন্য প্রথম ভূমি গাছের ইতিহাসের যতটা সম্ভব গভীরে যাওয়া”, রেস্কি বলেছেন। “আমরা দেখতে পেয়েছি যে তাকাকিয়া বর্তমানে সর্বাধিক সংখ্যক দ্রুত-বিকশিত জিনোম ধারণ করে। এটি জেনেটিক স্তরে খুব সক্রিয়।”
তাকাকিয়ার পরিবেশের উপর গবেষণা চালানোর পর দলটি দেখতে পায় পৃথিবীর জলবায়ু ক্রমাগতভাবে উষ্ণ হচ্ছে। ফলে হিমবাহগুলো গলে যাচ্ছে যা শ্যাওলাটিকে অতিবেগুনী বিকিরণের এমন উচ্চ স্তরে উন্মুক্ত করছে যার সম্মুখীন হওয়ার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা তাকাকিয়ার ছিল না। গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে তিব্বতে তাকাকিয়ার জনসংখ্যা তাদের অধ্যয়নের সময়কালে বার্ষিক প্রায় ১.৬% হ্রাস পেয়েছে। হু ভবিষ্যদ্বাণী করেন, “২১ শতকের শেষ নাগাদ তাকাকিয়ার বসবাসযোগ্য অবস্থা সারা বিশ্বে মাত্র ১,০০০-১,৫০০ বর্গ কিলোমিটারে নেমে আসবে।”
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা এই প্রজাতির বেঁচে থাকাকে সংরক্ষণ ও দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানী ইকুন হি বলেন, “উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা অলসভাবে বসে থাকতে পারেন না। আমরা পরীক্ষাগারে কিছু গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছি যা পরবর্তীতে তিব্বতে আমাদের পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে প্রতিস্থাপন করছি”।
ইকুন আরো বলেন, “পাঁচ বছরের একটানা পর্যবেক্ষণের পর পাওয়া গেছে যে কিছু প্রতিস্থাপিত গাছপালা বেঁচে থাকতে পারে এবং বিকশিতও হতে পারে। যা আমাদের কাছে তাকাকিয়ার জনসংখ্যার পুনরুদ্ধারের একটি হাতিয়ার – বা অন্তত এর বিলুপ্তির স্থগিতকরণের একটি মাধ্যম।”
তাকাকিয়াকে বাঁচানোর লক্ষ্যে করে যাওয়া এই গবেষণা ও সে অনুযায়ী নেয়া পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট হবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এর বর্তমান দুর্দশা কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দান করে যে কিভাবে মানুষের অযাচিত কর্মকান্ড পৃথিবীর পরিবেশের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। “তাকাকিয়া ডাইনোসরদের আসতে এবং যেতে দেখেছে, এটি আমাদেরকে মানুষ আসতে দেখেছে এবং এখন আমরা এই শ্যাওলা উদ্ভিদ থেকে স্থিতিস্থাপকতা এবং বিলুপ্তি সম্পর্কে কিছু শিখতে পারি,” রেস্কি বলেন।
“তাকাকিয়ার মাধ্যমে আপনি আমাদের জীবন ও তারও আগের পুরো ইতিহাস এবং ভবিষ্যতের দিকে ফিরে তাকাতে পারেন। এই কোণ থেকে এটি খুব আকর্ষণীয় কারণ এটি আমাদের আশা দেয় যে হয়তো একে বাঁচাতে আমরা কিছু করতে পারি।”
শাহলীন রাহনুমা / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ সাইন্টিফিক আমেরিকান, দ্য গার্ডিয়ান, ফ্রন্টিয়ারসিন
+1
+1
+1
+1
+1
+1
+1
1