দিন দিন প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি মানুষের বেড়েই চলেছে। অফিস কিংবা স্কুল ঘরে বাহিরে মানুষ একটুখানি অবসর পেলেই ঢু মারছে প্রযুক্তির এই জগতে। এর মধ্যে রয়েছে ইউটিউব, ফেসবুক, কিংবা মুভি স্ট্রিমিং সাইট নেটফ্লিক্স, আ্যমাজন প্রাইম।কিন্তু এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কিংবা আসক্ত হওয়ার পেছনে এমন কারণটা কি আমরা ভেবে দেখেছি কখনো?
আজ থেকে প্রায় দু দশক আগেও কিন্তু দু-চারজনের সম্মিলিত আড্ডায় মূলবিষয় বস্তুু ছিলো, বই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিত্তিক আলোচনা। কিন্ত বর্তমানে তা গিয়ে ঠেকেছে প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তনে কে কতো বেশী লাইক পেলো কিংবা সামান্য হাস্যরসাত্বক মিমস শেয়ারে কে বেশী মানুষ হাসাতে পারলো তার চটকদার আলোচনা!
মানুষের এই আমূল পরিবর্তন কিন্তু খুব অল্প সময়তে ঘটেনি কিংবা কোন আকস্মিকতাও নেই এই পরিবর্তনের মাঝে বরং এর পেছনে রয়েছে এমন দুজন মানুষের হাত যাদের প্রতিষ্ঠিত মায়াজালে আমরা আটকে যাচ্ছি এই প্রযুক্তির দুনিয়ায়!
টি ডাল্টন কম্বস এবং র্যামজি ব্রাউন নামের এই দুজন নিউরোসায়েন্টিস্ট আমেরিকার ক্যালফোর্নিয়া শহরে “ডোপামিন ল্যাব” নামক একটি গবেষণা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান চালু করে। টি কম্বস সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউরো ইকোনমিকস থেকে পিএইচডি করেছেন এবং প্রতিষ্ঠানটির চীফ এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত আছেন। ঠিক একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোকেমেস্ট্রি বিষয়ে থেকে পিএইচডি করেছেন র্যামজি।
ঠিক কি নিয়ে ডোপামিন ল্যাব কাজ করে তা এখনো বলা হয়নি। আপনি যখন এই নিউজটির শিরোনাম দেখেছেন আপনার কাছে অদ্ভুত ঠেকেছে কি করে একটি প্রতিষ্ঠান মানুষকে প্রযুক্তি দুনিয়ায় মোহগ্রস্ত করে রাখছে? বলে রাখা ভালো, এই শিরোনামটা পড়ে সংবাদ টি বিস্তারিত দেখার আগেই কিন্তু আপনার মস্তিষ্কের ডোপামিন ক্ষরিত হয়েছে এবং আপনাকে উৎসাহিত করেছে লিংকে প্রবেশ করার জন্য।
ঠিক এমন পন্থাই অবলম্বন করে থাকে ডোপামিন ল্যাব। প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা র্যামজি বলেন আমরা প্রযুক্তি দুনিয়ায় চটকদার কিছু দেখলেই তার প্রতি আকর্ষিত হই সেটি ভালো কিংবা খারাপ তা আমাদের মাথায় তখন কাজ করেনা। বিশেষ করে যখন কোন রঙিন জিনিস আমাদের রেটিনায় প্রতিফলিত হয়। এই ক্ষেত্রে নিউরোট্রান্সমিটারগুলো সেই জিনিসটির প্রতি সাড়া প্রদান করে থাকে সাদাকালো কিংবা এক রং এর জিনিস থেকে তূলনামূলক দ্রুততম সময়ে।
টি কম্বস জানান, যেকোন কিছু আপনার ব্রেনে একবার প্রশান্তি আনলে বা রিওয়ার্ড ফিলিং মানে পুরষ্কারপ্রাপ্তির মত অনুভূতি আনতে পারলে আপনার ব্রেইনে ডোপামিন হরমোন নিঃসৃত হয়। সেই ডোপামিন কে ধরার জন্য কিছু রিসেপ্টার থাকে ব্রেইনে। কোন কাজে বেশি ও ঘন ঘন ডোপামিন নিঃসৃত হতে থাকলে এই রিসেপ্টর এর সংখ্যা কমে যায় কারণ শরীর হরমোন আর রিসেপ্টার এ একটা ব্যালেন্স রাখতে চায়। একটা বাড়লে আরেকটা কমে।
একবার যে কাজে অধিক ডোপামিন বের হবে সে কাজে আমাদের নেশা জন্মে তাই ব্রেন বার বার সেই কাজটি করতে চায়। এভাবেই নিজেদের অজ্ঞাতে মিউজিক, প্রেম, সিনেমা, ড্রাগ, খেলা, পর্ন, হস্তমৈথুন বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের আসক্তি হয়। এই নেশা যদি ২১ দিন ক্রমাগত চলতে থাকে তবে ব্রেন এটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয় তখন নেশাটাই অভ্যাস হয়ে যায়।
এই ক্ষেত্রে তাঁরা প্রতিনিয়ত ভিন্ন ভিন্ন মানুষ ভেদে তাদের আগ্রহের বিষয় বা পছন্দের জিনিস গুলোকে খুঁজে যাচ্ছে। এ জন্য তারা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক ইউটিউব কে ব্যবহার করছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ইউটিউবে কোন মিউজিক ভিডিও দেখার পর আরো অন্যন্য মিউজিক ভিডিও সাজেস্ট করা হয় এবং জানতে চাওয়া হয় এই ভিডিও কি আপনার পছন্দের সাথে মানানসই কি না। ঠিক এভাবেই মানুষের উপর জরিপ চালিয়ে তাদের আগ্রহের বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করানোর মাধ্যমে আসক্ত করা হচ্ছে আপনাকে।
র্যামজি জানান তাদের প্রথম সেবা গ্রহীতা ছিলো রুট বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ডোপামিন ল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সংক্রান্ত অনলাইন ব্যাবস্থা সহ যাবতীয় বেশ কিছু জিনিস উন্নতি ঘটানোর পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেখতে পায় তাদের শিক্ষার্থী উপস্থিতি পূর্বের তূলনায় প্রায় ৯% বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়া টালা(tala) নামক একটি অর্থলগ্নি কারী প্রতিষ্ঠান ডোপামিন ল্যাবের সেবা গ্রহণ করার পরবর্তী সময়ে তাঁদের প্রান্তিক মুনাফা প্রায় ১৪% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। “ব্রাইটেন” নামক একটি প্রতিষ্ঠান দেখতে পায় ডোপামিন ল্যাবের এপিআই সেবা গ্রহণের ফলে অবিশ্বাস্য ভাবে তাদের গ্রাহক ১৬৭% বৃদ্ধি পায়!! এই তালিকায় নেটফ্লিক্স, ফেসবুক সহ আরো বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুলো রয়েছে যারা প্রতিনিয়ত তাদের গ্রাহক বাড়ানোর কাজ করে যাচ্ছে।
প্রযুক্তি দুনিয়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তাঁদের গ্রাহক বাড়িয়ে দেওয়ার কাজেই সীমাবদ্ধ নয় প্রতিষ্ঠানটি
বিভিন্ন স্টার্টআপে সিড ফান্ডিং (প্রাথমিক মূলধন) কে ত্বরান্বিত করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। উদাহরণ স্বরূপ কেউ একটি নতুন ব্যবসা শুরু করেছে, তার কাছে সেই ব্যবসাটির আইডিয়া রয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কোন বিনিয়োগকারী তাঁর ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে রাজি হচ্ছেনা; সেই ক্ষেত্রে কাজে নেমে পড়ে র্যামজি ও তার দলবল।
মেট মাজেয়ো যখন তার প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক বিনিয়োগের জন্য যখন কোন বিনিয়োগ কারীকেই খুঁজে পাচ্ছিলো না তখনই দ্বারস্থ হয় ডোপামিন ল্যাবের। র্যামজির প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক ডিজাইন আইডিয়া এপিআই সিস্টেমের কার্যকরীতায় খুব অল্প সময়ের মাঝেই মাজেয়ো আড়াই লক্ষ ডলারের অনুদান পেতে সক্ষম হয়।
এতোক্ষণ এসব পড়ার পর আপনার নিশ্চয়ই মনে হবে ভার্চুয়াল জগৎ এর আড়াল থেকে আপনাকে প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে নিউরোলজিতে পিএইচডি করা কিছু মানুষ আর আপনি ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছেন নিজেকে। র্যামজির মতে এখনকারদিনে ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, ফেসবুক সহ বিভিন্ন ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েই চলেছে। এবং কয়েকবছরের গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মোবাইল আসক্ত মানুষের মস্তিষ্কের গঠনে এসেছে আমূল পরিবর্তন। যেটির প্রভাবে মানুষের নিউরট্রান্সমিটারের চলাচল হ্রাস পেয়েছে এবং মানুষের মাঝে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়া গণণা কিংবা সৃজনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে।
এমতাবস্থায় র্যামজি এবং তার প্রতিষ্ঠান এমন একটি এপস বানিয়েছে যা আপনাকে সর্বক্ষণ দূরে রাখতে সাহায্য করবে প্রযুক্তি দুনিয়া থেকে। কম্বসের মতে তাঁদের এপসটির ইউআই এমনভাবে ডিজাইন করা যা একজন ব্যবহারকারীকে মোবাইল ব্যবহার সম্পর্কে অনুৎসাহিত করে যাবে। স্পেচ নামক এই অ্যাপটি ইতোমধ্যে উন্মুক্ত হয়েছে প্লে স্টোরে।
চাইলে আপনিও ভার্চ্যুয়াল জগৎ এর আসক্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে ডাউনলোড করে নিতে পারেন এপসটি। কে জানে এর মাধ্যমেই হয়তো কমে যেতে পারে হয়তো টেক জায়ান্ট গুলোর দীর্ঘদিনের ব্যবসা!
এ এন এম নাঈম/ নিজস্ব প্রতিবেদক