ডোডো পাখির ইতিহাস:
মরিশাসের পূর্ব উপকূল আইল দি অ্যাম্বারে ওলন্দাজ নাবিক ভোলকার্ট ইভার্টসজুন ও তার নাবিকরা পৌঁছানোর আগে খাদ্য ও পানির তীব্র অভাবে অন্ধকার দেখতে শুরু করেন। সংকট এতটাই তীব্র রূপ ধারন করে যে জাহাজের নাবিকরা নিজেদের মূত্র পানেও দ্বিধা বোধ করেননি। হঠাৎ-ই নাবিকরা দেখতে পেলেন দূরের উপকূল আইল দি অ্যাম্বার। ভাবলেন মরীচিকা দেখছেন তীব্র ক্ষুধা ও পিপাসায়। কিন্তু উপকূলে পৌঁছেই বুঝতে পারলেন যে না, ভুল না। সত্যিই স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আর্নহেম জাহাজের নাবিকদের বাচাতে এগিয়ে এসেছেন। নাবিকদের এই ক্ষুধা, পিপাসা মেটানোর মাধ্যমে প্রকৃতির জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার এই যুদ্ধ কাল হয়ে দাঁড়ায় আরেক প্রজাতির প্রাণীর উপর। নাবিকরা অবিরামভাবে ডোডো পাখিকে শিকার করে তাদের ক্ষুধা, পিপাসা মেটানো শুরু করে এবং এক পর্যায়ে বিলুপ্ত হয়ে যায় এই ডোডো পাখি। তবে বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আবারো ফিরে আসছে ডোডো পাখি।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ইভার্টসজুন লিখেছিলেন,
‘‘ওরা আকারে হাঁসের চেয়েও বড় ছিল, কিন্তু উড়তে পারত না। কারণ ওদের ডানাগুলো খুবই ছোটো এবং অগঠিত।’’
১৬৬২ সালের সেই বিশেষ দিনে নাবিকদের তীব্র ক্ষুধাই ছিলো এই পাখি বিলুপ্ত হবার প্রধান কারণ।
ডোডো পাখির বৈশিষ্ট্য:
ডোডো পাখি উড়তে পারতো না। কারন উড়ার মতো প্রয়োজনীয় পাখনার গঠন ও বায়ুথলি এদের ছিলো না। তারা আকার-আকৃতির দিক দিয়ে বেশ বড়ো ছিলো। পাখিটি গড়ে ১ মিটার লম্বা ছিলো এবং ওজনে প্রায় ১০.৬ কেজি থেকে ১৭.৫ কেজির মধ্যে ছিলো। ডোডো পাখির পালক ছিলো ধূসর বাদামী, আর ছিলো হলুদ রঙের পা এবং কালো হলুদ বা সবুজ ঠোঁট। এই পাখিগুলো সাধারনত একবারে একটি করে ডিম দিতো।
ডোডো পাখিকে বোকা পাখি বলেও অভিহিত করা হয় কারন এরা মানুষ দেখলে ভয় না পেয়ে উলটো কাছে আসতো। এর ফলে সেসময় নাবিকদের জন্য তাদেরকে শিকার করা ছিলো খুবই সহজ। তাছাড়াও জাহাজে করে আসা শূকর ও ইদুর খাদ্য হিসেবে ডোডো পাখির ডিম বেছে নেয়ায় মাত্র ৩ মাসের মাথায় এই সম্পূর্ণ প্রজাতি ধরণীর বুক থেকে বিদায় নেয়।
বিস্তারিত পড়ুন: ডোডো পাখিকে কেন বোকা পাখি বলা হয়?
যেভাবে ফিরে আসতে পারে ডোডো পাখি:
বিজ্ঞানীরা ৩৬১ বছর আগের বিলুপ্ত ডোডো পাখিকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি কলোসাল বায়োসাইন্সের গবেষকরা ডোডো পাখিকে ফিরিয়ে আনতে ১৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের প্রজেক্টে অংশ নিয়েছেন। প্রথমবারের মতো জিন এডিটিং টেকনোলজি -এর মাধ্যমে ডোডো পাখির জিনোম সংগ্রহ করে এর নিকট আত্মীয় কবুতরের মধ্যে ব্যবহার করে ডোডো পাখিকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব বলে জানায় ‘দ্য গার্ডিয়ান‘ সংবাদ মাধ্যম। কলোসাল কোম্পানি দাবি করে যে, CRISPR (জিন এডিটিং টেকনোলজি) ব্যবহার করে তারা ডোডো পাখির নিকটবর্তী নিকোবার পাখির প্রাচীন জিন ব্যবহার করে ডোডো পাখির ডিম ও শুক্রানু তৈরি করা সম্ভব। ফলে, আস্তে আস্তে গবেষণার ফলে ডোডো পাখি সদৃশ কোন পাখি তৈরী করতে সক্ষম হবে। আর এভাবেই ফিরে আসছে ডোডো পাখি; বলছেন গবেষকরা।
ড. শাপরিও বলেন,
“প্রাচীন ডিএনএ এর জেনেটিক অগ্রগতির উপর ফোকাস করে ডোডো পাখির জিনোম ক্রমানুসারে বিলুপ্তি থেকে পুনরুদ্ধার পর্যন্ত কলোসাল ও মরিশাসের জনগণদের সাহায্য করতে পেরে আমি আনন্দিত।”
বর্তমানে কলোসাল বায়োসাইন্স এর আরেকটি টিম ৪০ জন বিজ্ঞানী নিয়ে ম্যামথ পুনরুদ্ধার করতে কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রফেসর ইওয়ান বার্নেই বলেন,
“এতে কোন সন্দেহ নেই যে ডোডো পাখি একটি অসাধারন প্রজাতি। তবে আমার কোন ধারনা নেই যে এই পুরো প্রক্রিয়া টি ডোডো পাখির উপর কাজ করবে কিনা যেমনটা তারা দাবি করেন। তবে প্রশ্নটি এটি নয় যে আপনি কি এটি করতে পারবেন? বরং প্রশ্নটি হচ্ছে আপনার কি এটি করা উচিত?”
কী হতে পারে যদি ফিরে আসে ডোডো পাখি?
ডোডো পাখি ফিরে আসলে এই পাখি দেখা বা পালনের নিয়মকানুনে বেশ অনেক ধরনের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। যেমন তাদেরকে শিকার করা সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ করা হবে। সম্ভবত নিরাপত্তা বেষ্টিত কোন স্থানে এদের লালন-পালন করা হবে এবং গবেষণার জন্য রাখা হবে। পরবর্তীতে হয়তো তাদেরকে নির্দিষ্ট পরিমানে বাজারজাত করার চেষ্টা করা হতে পারে, তবে তা সফল হবার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ তৎকালীন নাবিকদের থেকে শোনা যায় যে ডোডো পাখির মাংসের স্বাদ ভালো ছিলো না। তবে প্রোটিনের খুব ভালো উৎস হতে পারে এই পাখি, কারণ একটি পাখি-ই ১০ থেকে ১৭ কেজি ওজনের হয়ে থাকে। তবে যাই হোক না কেনো, এটুকু বলা যেতেই পারে যে, ডোডো পাখির প্রত্যাবর্তন জেনেটিক্স এর জগতে নতুন এক দরজা খুলে দিবে এবং এই পদ্ধতিটি অন্যান্য বিলুপ্ত প্রানীদের আবার পৃথিবীর বুকে ফিরে আসার এক অনন্য সুযোগ হতে পারে।
ডোডো পাখির ফিরে আসা নিয়ে তর্ক বিতর্ক থাকতে পারে। তবে ডোডো পাখির ফিরে আসলে কী হতে পারে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার কোন অভাব নেই। যতদিন না পর্যন্ত ডোডো পাখি পুনরুদ্ধার হয়, ততদিন আমরা আশা নিয়ে বসে থাকতেই পারি এবং আমাদের আশে পাশের যত প্রানী আছে তাদের প্রতি যত্ন নিতে পারি যেন, ৩৬১ বছর আগের ডোডো পাখির মতো করুণ অবস্থার সম্মুখীন তাদেরও না হতে হয়।
নাফিস কামাল/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: Telegraph.co.uk, Bloomberg.com, Wikipedia