সময়মতো সকালের খাবার না খাওয়ার অভ্যাস ডিমেনশিয়া বা ভুলে যাবার রোগ হবার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয় 4 গুণ!
আমরা অনেকেই দৈনন্দিন জীবনের কর্মব্যস্ততার মাঝে সব কাজ করার সময় পেলেও খাবার খাওয়ার সময়টাই যেন আমাদের হাতে থাকে নাহ। আবার কেউ কেউ তো খাচ্ছি খাবো করতে করতে, সকালের খাবার খাই দুপুরে। শুধু যে সকালের খাবার খাওয়ার প্রতিই আমাদের অনীহা কাজ করে তা না, রাতের খাবার খাওয়ার বেলাতেও আমরা সময় মত খাবার খাই না। তরুণ প্রজন্মের মাঝে খাবারের প্রতি এ অনীহা বেশি দেখা যায়।
বেশিরভাগ তরুণই সকালে দেরি করে খাবার খান বা না খেয়ে সকাল পার করেন। সম্প্রতি এক গবেষণায় চাঞ্চল্যকর একটি তথ্য উঠে এসেছে তা হল, সকালে যারা দেরি করে খাবার খান বা না খেয়ে সারা সকাল পার করেন তাদের ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ)-তে আক্রান্ত হবার প্রবণতা সাধারণের তুলনায় প্রায় 4 গুণ বেশি। এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কি এই ডিমেনশিয়া? ডিমেনশিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগে, সময়মতো খাবার গ্রহণ না করলে কি কি সমস্যা হতে পারে এবং সকালে খাবার খাওয়া কেন এত জরুরি সে সম্পর্কে জেনে নেই।
দুপুর-রাত অপেক্ষা সকালে খাবার গ্রহণ করা কেন এত জরুরি?
গবেষণা বলছে কী খাওয়া উচিত আর কতটা খাওয়া উচিত তার থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল কখন খাওয়া উচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, সকালবেলার খাবারই সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করে। আর সেই সকালের খাবার খাওয়াতেই আমাদের কিনা এত গড়িমসি। কিন্তু সকালে খাবার খাওয়া এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? সকালের খাবারের ওপর নির্ভর করছে সারা দিনের শরীরের হালচাল, কাজের গতি। দিন যত গড়ায় বিভিন্ন কাজের জন্য শক্তির চাহিদা বাড়তে থাকে। আর শক্তির এই চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই শরীরের পরিপাক হারও তত বাড়তে থাকে। সেজন্য একটি ভালো সূচনা দিয়ে দিনকে শুরু করতে, দুপুর বা রাতের চেয়ে সময়মতো সকালের খাবার অনেক বেশি প্রয়োজনীয়।
অনিয়মিত খাবারদাবার ও বেশি রাত করে রাতের খাবার খাওয়ার বিরূপ প্রভাব:
ডায়াবেটিস ঝুঁকি বৃদ্ধি: আপনি যখন বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকবেন, তখন মস্তিষ্কে গ্লুকোজ সরবরাহ কমে যাবে, এতে করে মনোযোগ, স্মৃতিশক্তিও কমে যায় কিছুটা। আর না খেলে লিভারে ইনসুলিন হরমোন কাজ করতে পারে না। এতে করে এক পর্যায়ে শরীরে উৎপন্ন অতিরিক্ত গ্লুকাজ রক্তে জমে টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন আপনি।
মন মেজাজের উপর প্রভাব: সঠিক সময়ে খাবার না খেলে পর্যাপ্ত পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হবেন আপনি। ব্লাড সুগার মাত্রা এলোমেলো হয়ে আপনার মন মেজাজের উপর কুপ্রভাব পরবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জীববিজ্ঞানী গিরিশ মেলকানি তাঁর এক গবেষণাপত্রে লিখেছেন,
সময়মতো খাবার গ্রহণ করার ফলে কম বয়সে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া ও হার্টের যে সমস্যা হয় তাও দূর হয়।
বোস্টনের ব্রড ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সময়মতো খাবার খাওয়া আপনাকে গ্যাস্ট্রিক, আলসার, স্থূলতা সহ মারাত্মক কিছু রোগ থেকে রক্ষা করে, সুস্থ, সবল ও সতেজ রাখবে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ কি?
ডিমেনশিয়া বা ভুলে যাবার রোগ এমন একটি মানসিক অবস্থা যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির বুদ্ধি, স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব ক্রমান্বয়ে লোপ পায়। ফলে তার আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা লক্ষিত হয়। সাধারণত প্রাপ্তবয়স্করা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। হঠাৎ করে অনেক কিছুই মনে করতে পারেন না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের নিউরনের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমতে থাকে। ডিমেনশিয়া আছে এমন অধিকাংশেরই আলজেইমারস ডিজিজ থাকে। আলজেইমারসের প্রাথমিক পর্যায়ে নতুন নিউরন বৃদ্ধির সংখ্যা প্রতি মিলিমিটারে ৩০,০০০ থেকে কমে দাড়ায় ২০,০০০ এ। ড. লরেন্স-মার্টিন এর মতে, “রোগটির একদম শুরুতে এই হ্রাসের পরিমাণ থাকে ৩০%।”
ডিমেনশিয়া কাদের হয়:
আমরা সবাই মাঝে মাঝে বিভিন্ন জিনিস ভুলে যাই, যেমন কোথায় আমাদের চাবি রেখে এসেছি। এটার মানে এই নয় যে আমাদের সবার ডিমেনশিয়া আছে। ৬৫ বছরের বেশি বয়স্কদের ক্ষেত্রে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বেশি। তবে পুরুষদের চেয়ে নারীরা ডিমেনশিয়ায় বেশি ভোগেন। তাছাড়া কিছু ফ্যাক্টর যেমন: ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল, বিষণ্নতা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হবার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দেয়।
ডিমেনশিয়ার লক্ষণ:
- সাম্প্রতিক ঘটনা, নাম ও চেহারা ভুলে যাওয়া।
-
প্রায়শই অল্প সময়ের মধ্যে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করা।
-
জিনিসপত্র ভুল স্থানে রাখা।
-
মনোযোগ ধরে রাখা বা সরল সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন হয়ে উঠা।
-
দিনের তারিখ বা সময় সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া।
-
হারিয়ে যাওয়া, বিশেষ করে নতুন নতুন স্থানে।
-
সঠিক শব্দ ব্যবহার বা অন্যদের কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়া।
-
অনুভূতিতে পরিবর্তন, যেমন সহজে বিমর্ষ ও মর্মাহত হয়ে পড়া, বা কোন কিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
ডিমেনশিয়ার লক্ষণগুলো খারাপের দিকে যেতে থাকলে রোগীর জন্য স্পষ্ট করে কথা বলা ও তার প্রয়োজন বা অনুভূতি সম্পর্কে কাউকে জানানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাদের জন্য নিজে থেকে খাওয়া ও পান করা, কোন কিছু ধোয়া ও পোশাক পরা এবং অন্যদের সাহায্য ছাড়া শৌচাগারে যাওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
এর কোন নিরাময় আছে কী?
দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে এখন পর্যন্ত ডিমেনশিয়ার কোন নিরাময় পাওয়া যায়নি না এবং এ রোগ ঠেকানোর কোন ওষুধ নেই। তাই সময়ের সাথে সাথে রোগীদের অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। তবে কিছু গ্রুপ অ্যাক্টিভিটি রয়েছে যেগুলোতে রোগীরা অংশ নিতে পারে, যা তাদের লক্ষণগুলো নিয়ে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। এই ব্যাপারে চিকিৎসকের দিকনির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ।
কীভাবে ডিমেনশিয়া থেকে বাঁচতে পারি?
আপনার ডিমেনশিয়া বা ভুলে যাবার এই রোগ হওয়া রোধ করার কোন নিশ্চিত উপায় নেই, তবে কিছু জিনিস আছে যা করলে আপনার তা হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে যেতে পারে।
- আপনার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে আপনার হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান, সেই সাথে রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রাও নির্ণয় করে নিন এবং তা উচ্চমাত্রার হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন।
-
যদি আপনার ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন।
-
ধূমপান পরিহার করুন।
-
শুধু সকালের খাবার খেলেই হবে না, সঠিক সময়ে যথাযথ খাবারও খেতে হবে। অর্থাৎ, সুষম খাদ্যাভাস গড়ে তুলুন।
-
আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
-
কায়িক পরিশ্রম করুন, লম্বা সময় ধরে বসে থাকা থেকে বিরত থাকুন।
-
আপনার মস্তিষ্ককে কাজে লাগান– আপনার পছন্দের কোন অ্যাক্টিভিটি বা সামাজিক গ্রুপের মাধ্যমে।
তবে রোগটি শনাক্ত হওয়ার আশঙ্কা করলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। রোগটি নিয়ে মুশকিল হলো, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ভুলে যাবেন- এমনটি ধরেই নেওয়া হয়। ফলে রোগটি সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষ সচেতন নন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগী আসেন একেবারে শেষ পর্যায়ে। তবে রোগীর প্রত্যহিক জীবনের মান বাড়ানো, তাকে যথাযথ সম্মান, সঙ্গ এবং সেবা দেয়া, রোগী ও তার স্বজনদের প্রাত্যহিক কর্মতালিকার সমন্বয় রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি-পাওয়াকে কমায়।
ডিমেনশিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব ডিমেনশিয়া সচেতনতা দিবস‘ পালিত হয়।
নিজস্ব প্রতিবেদক/ মোঃ গালীব হাসান
তথ্যসূত্র: Times of India, এক্সপ্রেস ইউকে, উইকিপিডিয়া, জার্নাল রেফারেন্স