ডিমেনশিয়া শব্দটি এমন কিছু রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যা মূলত স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনা এবং দৈনন্দিন কাজকর্মকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ ডিমেনশিয়া এর কারণে মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপসহ সমস্যা সমাধান ও চিন্তন করার দক্ষতা হ্রাস পায়। এটি কোনো মানসিক রোগ নয় বরং এটি মস্তিষ্কের একটি অবস্থা।
মস্তিষ্ক মানুষের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র যা মানুষের সকল প্রকার চিন্তনদক্ষতা নিয়ন্ত্রণ করে। যখন কোনো অসুস্থতার কারণে মানুষের মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা কমে যায় তখন মানুষের কথা বলা, বোঝা এবং নতুন কোনো দক্ষতা অর্জনে সমস্যা হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে দাবানল ও কৃষিকাজের কারণে যেসব কণা বায়ুতে ছড়ায় তা মানুষের মধ্যে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
দাবানল বায়ু দূষণের একটি প্রধান উৎস যা বায়ুতে প্রচুর পরিমাণে কণা এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক দূষক পদার্থ নির্গত করে। এই দূষক পদার্থগুলো অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে এবং আশেপাশের অঞ্চলে বাতাসের গুণমানকে প্রভাবিত করতে পারে। আবার কৃষিকাজের সময় বাতাসে ধূলিকণা, কীটনাশক এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থগুলো বায়ুতে ছেড়ে দেয়। একটি সমীক্ষায় গবেষকরা দেখেছেন যে যারা শহুরে এলাকায় বসবাস করে তাদের তুলনায় যারা কৃষি এলাকার কাছাকাছি বসবাস করেন তাদের ডিমেনশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল।
একটি গবেষণায় ২৭,৮৫৭ জন অংশগ্রহণকারী ছিল। ১৯৯৮-২০১৬ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অংশগ্রহণকারীদের ১৫% ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে যাদের মধ্যে বেশিরভাগ পার্টিকুলেট ম্যাটার (যেমন, ধুলোবালি) দূষণযুক্ত এলাকায় কাজ করতো।
পার্টিকুলেট দূষণ (PM= Particulate matter) পিএম ২.৫ বলতে জলীয় বাষ্পে ভাসমান কোনো তরল কণা বা কঠিন কণাকে বুঝায়। এটি প্রধানত কয়লা বা প্রাকৃতিক গ্যাস চালিত গাড়ি, কৃষিতে ব্যবহৃত কীটনাশক, নির্মাণ কাজ চলছে এমন রাস্তাঘাট ও এর আশেপাশের অঞ্চলের বায়ুতে উপস্থিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথের পরিবেশ বিষয়ক মহামারী গবেষক এডার বলেছেন,
“আমরা আমাদের মস্তিষ্কের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে বুঝতে পেরেছি যে কৃষিকাজে প্রচুর কীটনাশক এর ব্যবহার এই ডিমেনশিয়ার কারণ।”
তিনি আরো বলেন,
“কীটনাশকগুলো মানুষের জন্য নিউরোটক্সিন হিসেবে কাজ করছে, এই কীটনাশক এর অতিরিক্ত ব্যবহার পার্টিকুলেট দূষণ ঘটায় এবং মানুষের নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করে মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন করছে। তাছাড়া শুধু দাবানল এর ধোঁয়া নয় বরং বাড়িঘর, গ্যাস স্টেশনেও যে আগুন লাগে তা পার্টিকুলেট দূষণ ঘটায়।”
পার্টিকুলেট দূষণ খুবই মারাত্মক কারণ পিএম ২.৫ এতো সুক্ষ্ম কণা যা মানুষের চুলের প্রস্থের ১/২০ অংশ। ফলে এটি মানুষের শরীরের সব অংশে সহজে প্রবেশ করে এবং স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।
এমনকি মানুষ যখন নিঃশ্বাস ফেলে তখনও এটি বের হয়না বরং এটি মানুষের ফুসফুসে গভীরভাবে আটকে থাকে যা পরবর্তীতে রক্তস্রোতে চলে যেতে পারে। অর্থাৎ এই পার্টিকল/কণাগুলো ফুসফুসে জ্বালাপোড়া ও প্রদাহের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে দীর্ঘমেয়াদী পার্টিকেল দূষণ ক্যান্সার, বিষণ্ণতা, শ্বাসজনিত সমস্যা এবং বিভিন্ন ধরণের হৃদরোগের কারণ হতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথের পরিবেশ বিষয়ক মহামারী গবেষক এডার বলেছেন,
“আমরা আমাদের গবেষণায় দেখেছি যে সমস্ত বায়ু দূষক স্মৃতিশক্তি হ্রাসসহ নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়েছে, তবে কৃষিকাজ ও দাবানলের দ্বারা উৎপন্ন বায়ু দূষক বিশেষ করে মস্তিষ্কের জন্য খুবই বিষাক্ত।”
ইংল্যান্ডের একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে যে যেখানে গড়ে পার্টিকল দূষণ এর পরিমাণ বেশি থাকে সেখানের মানুষদের অন্য দূষণমুক্ত এলাকার মানুষের তুলনায় ১.৪ গুণ বেশি ডিমেনশিয়ার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি গবেষণায় প্রকাশিত হয় যে দূষণযুক্ত এলাকার মানুষের মস্তিষ্ক স্ক্যানে দেখা যায় যে মস্তিষ্কের এলাকাগুলো সংকুচিত হয়ে থাকে। ফলে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে থাকে এবং মানুষ আলজাইমার / ডিমেনশিয়া নামক রোগে আক্রান্ত হয়।
অন্যান্য গবেষণায়ও পার্টিকল দূষণ এবং ডিমেনশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ২০১৬ সালে ৬.৬ মিলিয়ন মানুষের উপর চালানো কানাডার একটি গবেষণায় জানা গেছে যারা ৯৮৪ ফুট উচ্চতায় বসবাস করে তাদের তুলনায় যারা ১৬৪ ফুট উচ্চতায় বসবাস করে তাদের ডিমেনশিয়া হওয়ার সম্ভাবন ৭% বেশি ছিলো। কারণ ৯৮৪ ফুট উচ্চতায় ক্ষুদ্র পার্টিকল কণার মাত্রা দশগুণ নিম্ন ছিল। অনেক দেশ এখন আবহাওয়া দূষণ কমাতে বিভিন্ন আইন তৈরি করেছে কিন্তু সারা বিশ্বের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ এমন আবহাওয়ায় শ্বাস নিচ্ছে যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আবহাওয়ার গুণমান সীমা অতিক্রম করেছে।
যদিও বায়ু দূষণ এবং ডিমেনশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে বোঝার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন, তবুও এই গবেষণাগুলো পরামর্শ দেয় যে বায়ু দূষণের মাত্রা হ্রাস করা ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। দাবানল কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। চাষাবাদের পদ্ধতি উন্নত করতে হবে।
এডার বলেছেন,
“আমরা অনুসন্ধানের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি যে পার্টিকেল / কণা পদার্থের বায়ু দূষণের মাত্রা কমিয়ে মানুষের শেষ বয়সের ডিমেনশিয়াও প্রতিরোধ করা সম্ভব।”
মাইশা নিজাম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সিএনএন, লাইফ টেকনোলজি, ডিজিটাল জার্নাল
+1
+1
1
+1
+1
+1
4
+1
+1
3