ডিএনএ কে বলা হয় প্রাণীজগতের বংশগতির ধারক ও বাহক। ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক প্রোক্যারিয়ট (অনুন্নত জীব যাদের মধ্যে সুগঠিত ডিএনএ পাওয়া যায় না, যেমন ব্যাকটেরিয়া) হতে শুরু করে বৃহৎ ইউক্যারিওট, (যারা উন্নত) সকল প্রাণীর জীবনধারণের কার্যাবলীর মূল একক হচ্ছে ডিএনএ। এই ডিএনএর ভেতর থাকে ফাংশনাল কিছু একক যাদেরকে বলা হয় জিন। এরাই মূলত আমাদের দেহের প্রত্যেকটা বৈশিষ্ট্য এবং শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলীর প্রকাশ বা নিয়ন্ত্রণ করে।
তো ধরুন এবার আপনাকে একটি ডিএনএর স্ট্রাকচার কল্পনা করতে বলা হলো। আপনি নিশ্চয়ই সেই বহুল পরিচিত প্যাঁচানো সিঁড়ির মত দ্বি-সূত্রক কাঠামোটির কথাই ভাববেন, তাই না?
কারণ ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান বই কিংবা বিভিন্ন ছবি, ভিডিও ইত্যাদি সব জায়গায় আমরা ডিএনএর সেই বহুল পরিচিত কাঠামোটিকেই দেখে আসছি। কিন্তু ডিএনএ নিয়ে পূর্ববর্তী যে সমস্ত ধারণা ছিল, নতুন নতুন গবেষণায় এর জটিলতা সম্পর্কে দিন দিন ধারণা কে আরও বেশি বদলে দিচ্ছে। বাস্তবে জানেন কি, ডিএনএর এই পরিচিত স্ট্রাকচার বা কাঠামোটি এর সার্বজনীন আকৃতি নয়। মূলত ডিএনএর স্ট্রাকচারাল অর্গানাইজেশন বা আকৃতিগত বিন্যাস আরো অনেক বেশি ডায়নামিক বা গতিশীল।
জার্নাল অব নিউরোসায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণায় প্রফেসর টিম ব্রেডি ব্যাখ্যা করেন,
“ডিএনএ মূলত বিভিন্ন আকৃতিগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে পারে যা আমাদের কোষীয় বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”
অন্তত ২০ ধরনের ডিএনএর আকৃতির সম্পর্কে জানা গিয়েছে এখন পর্যন্ত। যাদের প্রত্যেকেই শরীরের বিভিন্ন জিনের প্রকাশের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ক্রিয়া করে নির্দিষ্ট ভাবে ভূমিকা রাখছে। সহজ ভাষায় জিনগুলো হচ্ছে ডিএনএর ফাংশনাল একক, অর্থাৎ শরীরের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বা বিভিন্ন ধরনের অভ্যন্তরীণ কাজ প্রকাশ পাবে বা ক্রিয়া করবে নাকি বন্ধ থাকবে তার নিয়ন্ত্রণ করে।”
কুইন্সল্যান্ড ব্রেইন ইন্সটিটিউট কর্তৃক পরিচালিত এই গবেষণায় আলোকপাত করা হয়েছে এমন একটি নির্দিষ্ট ডিএনএর স্ট্রাকচার বা কাঠামোর উপর যা মানুষের মস্তিষ্কে স্মৃতির অনুলিপন বা মেমোরি ফরমেশনের সময় সরাসরি ক্রিয়া করে।
আর নতুন এই গবেষণা অনুযায়ী, আলোচ্য সেই G-quadraplex DNA বা (G4-DNA), (প্রচলিত দ্বি-সূত্রক কাঠামো হতে ভিন্ন, মূলত চারটি সূত্রক দ্বারা গঠিত এই ডিএনএর স্ট্রাকচার) মস্তিষ্কে লম্বা সময়ের জন্য যে সকল স্মৃতির অনুলিপন ঘটে সেগুলো এই ডিএনএর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।
এই G4-DNA স্ট্রাকচারটির উপর পূর্বে যে সকল গবেষণা হয়েছে তা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এটি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে জিনের অন অথবা অফের নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। তবে মস্তিষ্কে মেমোরি ফর্মেশন বা স্মৃতির অনুলিপন এর পেছনে যেই জিন ক্রিয়া করে তার সাথে এই ডিএনএর কোন সম্পর্ক আছে কিনা, ইতঃপূর্বে সে ব্যাপারে জানা ছিল না।
ইঁদুরের উপর চালানো আলোচ্য এই সমীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে যে এই নির্দিষ্ট ডিএনএ স্ট্রাকচারটি মস্তিষ্কের কোষগুলোতে তখনই তৈরি হয় যখন মানুষ কোন কিছু শেখার প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে।
গবেষকরা বলছেন যে মানুষ যখন কোন কিছু শিখে বা শিখার প্রক্রিয়ায় থাকে, মস্তিষ্কে এর উপর ভিত্তি করে মেমোরি ফর্মেশন করার জন্য জিনের ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে এই নির্দিষ্ট ডিএনএ।
G4-DNA যেভাবে স্মৃতির নিয়ন্ত্রণ করে
অত্যাধুনিক ক্রিসপার ভিত্তিক জিন এডিটিং টেকনোলজির (আধুনিক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্দিষ্ট জিনের মধ্যে এডিটিং তথা পরিবর্তন করে কোন আকাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য অর্জন করা অথবা কোন খারাপ বৈশিষ্ট্য বাদ দেয়া যায়) ব্যবহারের মাধ্যমে দলটি উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে মস্তিস্কে কীভাবে এই G4-DNA এর নিয়ন্ত্রণ হয়।
আমরা যখন কোনো কিছু শেখা বা অভিজ্ঞতার মধ্যে থাকি, আমাদের সক্রিয় নিউরনগুলোয় G4-DNA ক্ষণস্থায়ীভাবে জড়ো হতে থাকে এবং স্মৃতিগুলোর কোডিং এ ভূমিকা রাখে। প্রক্রিয়াটি ঘটতে থাকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত।
প্রফেসর টিম ব্রেডি আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন,
“এই সমীক্ষার প্রাপ্তি সামনে আমাদের বুঝার পরিধিকে আরো অনেক প্রসারিত করবে, যে কীভাবে ডিএনএ আমাদের স্মৃতির সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে সুনিপুণভাবে কাজ করে চলেছে।”
সা’দ ইবনে ওমর / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: মেডিকেল এক্সপ্রেস, রিসার্চ ক্যারিয়ার