কেমন হতো যদি নারীদের আর কখনো নিজেদের গর্ভে সন্তান জন্ম নিতে না হতো? অথবা কেমন হতো যদি আপনারা হাসপাতালে আপনাদের শুক্রাণু, ডিম্বাণু জমা দিয়ে আসার ৯ মাসের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেলো আপনাদের একদম নিজেদের সন্তান? তাও আবার কোন প্রকার নারী গর্ভের সাহায্য ছাড়াই! আপাতদৃষ্টিতে শুনতে অসম্ভব মনে হলেও, এই টেস্টটিউব বেবি নিয়ে বিস্তর গবেষণা বর্তমানে চলছে, যার ফলে অদূর ভবিষ্যতে এমনটা ঘটলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।
কৃত্রিম গর্ভ ব্যবহার করে ডাক্তাররা ইতোমধ্যে ২২ সপ্তাহের প্রিম্যাচিউর বেবি বাঁচিয়ে রাখতে সফলতা লাভ করেছেন। ক্লেইরি হর্ন তার বই ‘ইভ’ এ মন্তব্য করেন,
“আমরা কৃত্রিম গর্ভে একটি বাহ্যিক গর্ভাবস্থা তৈরীতে খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি।”
সূচনা:
২০১৭ সালে একদল আমেরিকান গবেষক একটি এমনিওটিক তরলের ব্যাগের মাধ্যমে অত্যন্ত প্রি-ম্যাচিউর ভ্রূণ কে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্যদিকে ২০২০ সালে ইজরায়েলি বিজ্ঞানী ইঁদুরের ভ্রূণকে কৃত্রিম গর্ভে স্থাপন করে ফিটাস পর্যন্ত বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হন।
ক্লেইরি হর্ন দাবি করেন যে,
“উপরোক্ত দুই প্রক্রিয়ার সমন্বয় ঘটলেই আমরা এক্টোজেনেসিস প্রক্রিয়া অর্জন করবো, যাকে ১৯২৩ সালে বায়োলজিস্ট JBS HALDEN নামকরণ করেন এবং যা বাহ্যিক গর্ভাবস্থা (external gestation) হিসেবেও পরিচিত।”
টেস্টটিউব বেবি কী?
যেসব শিশু ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন প্রযুক্তি (IVF) ব্যবহারের মাধ্যমে জন্ম নেয় তাদেরকে টেস্টটিউব বেবি বলা হয়। মূলত এরা মাতৃগর্ভের বদলে কৃত্রিম গর্ভে ভ্রুণ হিসেবে বেড়ে ওঠে।
ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন প্রযুক্তি (IVF) এর ইতিকথা:
অনেকেই অবাক হতে পারেন যে কৃত্রিম গর্ভে ভ্রূণ জন্ম দেওয়া কীভাবে সম্ভব! কিন্তু এই অসম্ভবকে বহু আগেই বিজ্ঞানীরা সম্ভব করেছেন। IVF প্রযুক্তিতে নারীদেহের ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয়। অতঃপর ডিম্বাণু কে ল্যাবরেটরি ডিশে শুক্রাণুর সাথে নিষেক ঘটিয়ে তৈরি করা হয় ভ্রূণ। বলে রাখা ভালো যে IVF প্রযুক্তি শুধু ভ্রূণ তৈরি করতেই সক্ষম। তাই পূর্বে IVF পদ্ধতিতে ভ্রূণ গঠনের পর তা মাতৃগর্ভে প্রতিস্থাপন করতে হতো পরবর্তী ৯-১০ মাসের জন্য। কৃত্রিমভাবে এই মানবশিশু জন্ম দিতে হলে দরকার এক্টোজেনেসিস প্রক্রিয়া।
এক্টোজেনেসিস কী?
মানবভ্রূণ কে নারীদেহের বাইরে অর্থাৎ কোন কৃত্রিম পরিবেশ, যেমন ইনকিউবেটরে বিকাশ ঘটানোর ধারনা কে এক্টোজেনেসিস বলে। অর্থাৎ, এ পদ্ধতিতে নারীর গর্ভাশয় ব্যতীত শুধুমাত্র ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু এর মাধ্যমেই জন্ম দেয়া সম্ভব একটি পূর্ণাঙ্গ মানবশিশুর!
যেভাবে কাজ করে এক্টোজেনেসিস:
প্রথমেই (IVF) প্রযুক্তির সাহায্যে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মাধ্যমে ভ্রূণের বিকাশ ঘটানো হয়। এরপর সেই ভ্রূণকে কৃত্রিম পরিবেশে, যেমন ইনকিউবেটরে স্থাপন করা হয়। সেখানে অবিকল অমরার মতো টিউব সিস্টেম রয়েছে যার মাধ্যমে ভ্রুণ দেহে পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। তাপমাত্রা, আর্দ্রতার মতো বিষয়গুলোও অত্যন্ত সাবধানতার সাথে নিয়ন্ত্রন করে কৃত্রিম পরিবেশেটি। এর মাধ্যমে মাতৃগর্ভের মতোই একটি পরিবেশ তৈরী হয় ভ্রূণটির বিকাশের জন্য। ভ্রূণটি যত বড়ো হতে থাকে ততই কাছ থেকে লক্ষ্য করা হয় ভ্রূণটিকে, যেন কোন জটিলতা না থাকে ভ্রুণের দেহে। ভ্রূণটি দৈহিক বিকাশের একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে পৌঁছে গেলে সিজারিয়ান সেকশন অথবা অন্যান্য মেডিক্যাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুটিকে জন্ম দেয়া হয়।
সমাজ ও মাতৃত্বের উপর এক্টোজেনেসিসের ইতিবাচক প্রভাব:
- সমাজে আমাদের আশেপাশেই অনেক দম্পতি শারীরিক জটিলতার কারনে সন্তান জন্ম দিতে পারছেন না। এক্টোজেনেসিস তাদের জীবনে একটি আশীর্বাদ হয়ে আসবে। এই প্রক্রিয়ায় তারা শুধু শুক্রাণু ও ডিম্বাণু দান করেই এক্টোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম পরিবেশে সন্তান জন্মদানে সক্ষম হবেন।
- এক্টোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম পরিবেশে মানবশিশুর জন্ম হলে প্রিম্যাচিউর শিশু জন্মদান থেকে বিরত থাকা যাবে। এর ফলে অসংখ্য শিশুদের স্বাস্থ্যজনিত জটিলতা সহজেই এড়ানো সম্ভব হবে।
- প্রতিবছর অনেক মা, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রাণ হারান। এক্টোজেনেসিসের ফলে মা এবং সন্তান দুজনেরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
সমাজ ও মাতৃত্বের উপর এক্টোজেনেসিসের নেতিবাচক প্রভাব:
- এক্টোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় মানবশিশু জন্ম দেয়া কে বিভিন্ন সমাজ ও জাতি প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। এক্টোজেনেসিস প্রক্রিয়াটি কতটুকু নৈতিক সে ব্যাপারেও প্রশ্ন থাকতে পারে অনেকের। আবার একে প্রকৃতির বিরুদ্ধে এবং অমানবিকও বলা হতে পারে।
- কৃত্রিম গর্ভে বেড়ে উঠা শিশুকে সমাজ সাদরে গ্রহন নাও করতে পারে। সামাজিক অবমূল্যায়নের সম্মুখীন হতে পারে শিশু এবং শিশুটির পরিবার।
- এক্টোজেনেসিস এর ফলে পুরুষ ও নারীর স্বাভাবিক জেন্ডার রোল এর ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। এবং অন্যদিকে নারীকে সামাজিক ভাবে স্বাভাবিক উপায়ে জন্মদানে বাধাদান করা হতে পারে।
- মা এবং শিশুর মাঝে যে চিরাচরিত আত্নিক সম্পর্ক ও ভালোবাসা রয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
- একসময় সন্তান জন্মদান একটি ব্যবসা রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এর ফলে মানবশিশুর সাথে পণ্যের ন্যায় আচরণ করা হবে।
- প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হতে পারে।
সবকিছুরই আসলে কিছু ভালো এবং কিছু ঝুঁকির দিক আছে। তা স্বত্বেও এক্টোজেনেসিস প্রক্রিয়ার ফলে টেস্টটিউব বেবির জন্ম সফল ভাবে সম্পন্ন হলে সমগ্র পৃথিবীর বুকে এটি আলোড়ন তৈরি করবে। মেডিক্যাল সাইন্স ও বিজ্ঞানীদের জন্য এটা হবে এক অনন্য মাইলফলক। এবং অনেক সন্তানহীন দম্পতির মুখে হাসি ফোটাবে এই এক্টোজেনেসিস প্রক্রিয়া ও টেস্টটিউব বেবি।
নাফিস কামাল/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: Telegraph.UK, Ectogenesis, In vitro fertilisation