“আপনি যদি কোনো তথ্যকেও দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন করেন, তবে তথ্যও যে কোনো কিছুই স্বীকার করবে।”
যে মানুষটিকে টর্চার করা হচ্ছে সে মানুষটি যদি সত্যিই আপনাকে সব কিছু বলে দেয়, তাহলে বুঝবেন কিভাবে যে সেই মানুষটি আসলেই সত্যি বলছে কি না!
আমরা সিনেমার দৃশ্যে দেখেছি, অপরাধীর কাছ থেকে তথ্য উদ্ধার করার ক্ষেত্রে টর্চার (Torture) একটি দুর্দান্ত মাধ্যম। কিন্তু, প্রশ্ন হলো নির্যাতনের চূড়ান্ত মাত্রা প্রয়োগের সময় অপরাধীর কি আসলেই তার বর্তমান বা ভবিষ্যতে যে নেতিবাচক পরিকল্পনাগুলো রয়েছে তা খেয়াল থাকে? অপরাধী কি ঐ নির্যাতনের সময় ভাবে যে, সে পরবর্তীতে কার খুন কীভাবে করবে নাকি তার চিন্তার বিষয় হয়- সে এই অত্যাচার থেকে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবে?
তারপর সিনেমাতে আমরা দেখি, জিজ্ঞাসাবাদকারীরা এতই প্রশিক্ষিত যে, তারা নির্দোষকে দোষী থেকে আলাদা করতে সক্ষম এবং তারা কেবল দোষীদের উপরই অত্যাচার করে। কেউ একজনের নখ উপড়ে ফেলার সময় “তুমি খুন করেছ?”, প্রশ্নের উত্তরে, “হ্যা” বলা-ই কি সাধারণ না? নাকি নিজের নখ উপড়ে ফেলতে দেখেও অপরাধী “আমি খুন করি নি” বলবে?
এবং যখন কোনও হত্যাকান্ড বা গন্ডগোল দেখা দেয় এবং অপরাধীরা ধরা পড়েন, তখন তথাকথিত প্রশিক্ষিত নির্যাতনকারীরা তাদের কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকবে এবং ঠান্ডা মাথায় ধাপে ধাপে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে তথ্য আদায় করবে?
অবশেষে, যখন তথাকথিত প্রশিক্ষিত নির্যাতনকারীদের দিনের কাজ শেষ হবে, তখন তারা ঘরে ফিরে আসবে, একটি স্বাভাবিক এবং সুন্দর ঘুম উপভোগ করবে এবং পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে আনন্দ-ফূর্তিও করবে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কারো উপর নির্যাতন করে, সন্ধ্যায় বাসায় এসে সুখে শান্তিতে সংসার করা এতই সহজ?
সর্বোপরি, আমরা বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে বার বার দেখতে পাই: নির্যাতনের মাধ্যমেই সত্য উঠে আসছে, শহর-নগর, নির্দোষ মানুষেরা রক্ষা পাচ্ছে এবং নির্যাতনকারী (নায়ক) সুখে জীবন যাপন করে। আসলেই কি এতটা সহজ সত্য উদঘাটন?
সত্যি বলতে কি, নির্যাতন বা অত্যাচার তথ্য আদায়ের জন্য কার্যকর কোনো মাধ্যম না। কেন এটি কার্যকরী না তার কিছু কারণ রয়েছে। “Why Torture Doesn’t Work” এর লেখক শেন ও’মারা, যিনি কিনা আয়ারল্যান্ডের ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের Experimental Brain Research এর অধ্যাপক, তিনিই এই সম্পর্কে লিখেছেন।
নৈতিকতাকে একপাশে রেখেই, শেন জানতে চেয়েছিলেন এমন কোনও বিশ্বাসযোগ্য বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে কিনা, যা আসলেই নির্যাতনের কার্যকারিতা দেখায়। উত্তর হলো, না। বাস্তবতা হলো “নির্যাতনের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য এতটাই তুচ্ছ, এর বিশ্বাসযোগ্যতার অনুপাত এতই কম যে, নির্যাতনের সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া উচিত।”
নির্যাতনের কার্যকারিতা সম্পর্কে ব্যবহারিক কোনো গবেষণা নৈতিকভাবে ঘৃণ্য হবে। কেননা কারো উপর নির্যাতন করে আপনি এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে পারেন না। তবে একাকীত্ব, মারাত্মক ব্যথা, ভয়, চরম ঠান্ডা, ঘুম সল্পতা, কারাবন্দী এবং পানিতে ডুবে যাওয়ার মানসিক এবং শারীরবৃত্তীয় প্রভাবগুলি সম্পর্কে হওয়া বিভিন্ন গবেষণা থেকে এ সম্পর্কিত প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়।
নির্যাতিত যেসব মানুষ বেঁচে আছেন, তাদের উপর অত্যাচারের মারাত্মক ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্পর্কে, পুলিশ-জিজ্ঞাসাবাদ কৌশলগুলির কার্যকারিতা নিয়েও কিছু পরিমাণে তথ্য রয়েছে, যা মিথ্যা স্বীকারোক্তির দিকে ইঙ্গিত করে। আর এসব মিথ্যা স্বীকারোক্তি তৈরি করা খুবই সহজ।
অত্যাচারের তীব্রতার সাথে চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা হ্রাস পায়, যার কারণে মস্তিষ্ক নির্ভরযোগ্য তথ্য উৎপন্ন করে না। চরম ব্যথা, সর্দি, ঘুম যেতে না দেওয়া এবং নির্যাতনের ভয়- এসব কিছুই স্মৃতির, মেজাজের এবং জ্ঞানের চরম ক্ষতিসাধন করে। নির্যাতন কোনো মানুষকে সহযোগিতা করার বা সত্যি বলার জন্য প্ররোচিত করে না। উল্টো অত্যাচার প্রতিরোধ করার জন্য একজন মানুষকে মিথ্যা বলার দিকে ধাবিত করে। পাশাপাশি আতঙ্ক, বিচ্ছিন্নতা, অজ্ঞানতা এবং দীর্ঘমেয়াদী স্নায়বিক ক্ষতির সৃষ্টি করে।
শেন ও’মারা কম্বোডিয়ায় নির্যাতনের হাত থেকে বেঁচে ফেরা ৬০ বছর বয়সী একজনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন: “তিনি জিজ্ঞাসাবাদকারীদেরকে নিজ থেকেই সত্য সহ সব কিছু জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অত্যাচারে তিনি নিজেকে সিআইএর একজন গুপ্তচর এবং একজন ক্যাথলিক বিশপ বলে স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু তিনি আসলে একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি একবার ফরাসী ভাষায় কথা বলেছিলেন।”
জিজ্ঞাসাবাদকারীরা প্রায়শই নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যখন তারা মনে করে যে কোনও সন্দেহভাজন ব্যক্তি তথ্য লুকাচ্ছে বা মিথ্যা বলছে। তবে মিথ্যা শনাক্ত করার ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবাদকারীরা সাধারণ মানুষদের চেয়েও ভাল, এমন কোনও প্রমাণ নেই।
উল্টো এমন প্রমাণ রয়েছে যে, কেউ যখন জিজ্ঞাসাবাদকারী হিসাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয় তখন সে ভাবে যে অন্যরা তার সাথে মিথ্যা বলছে। এই বিশ্বাসটি উদ্বেগজনক ভুলের দিকে পরিচালিত করতে পারে। কেউ হয়তো সত্য বললেও, নির্যাতনকারী তা বিশ্বাস করে না। সে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এই ভেবে যে, অপরাধী এখনো মিথ্যা বলছে।
বাস্তবে যা হয় তা হলো- নির্যাতনের সময় চরম রকমের চাপ মস্তিষ্ককে অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ করে তোলে, অভিযোজিত পরিসর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। অত্যাচারগুলো মস্তিষ্কের তন্তুগুলোকে আক্রমণ করে, মেমরির সাথে সম্পর্কিত মস্তিষ্কের অঞ্চলে টিস্যু হ্রাস ঘটায়। মস্তিস্কের কিছু অঞ্চলে বিশেষত ভয় এবং হুমকিসহ তথ্যের প্রসেসিংয়ের সাথে সম্পর্কিত টিস্যুর বৃদ্ধি দেখা যায়।
অবশেষে, দীর্ঘস্থায়ী এবং চরম চাপের ফলস্বরূপ সাধারণ আচরণ নিয়ন্ত্রণের সাথে সম্পর্কিত মস্তিষ্কের অঞ্চলগুলি কম প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। সৈনিকদের নিয়ে একাধিক গবেষণা, কিছু রোগী এবং সাধারণ জনগণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত এটি প্রমাণ করে যে, অত্যচারের কারণে সৃষ্ট এসব শারীরিক ও মানসিক চাপ মানুষের মেমরি, মেজাজ এবং জ্ঞানীয় কার্যক্রমে যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিসাধন করে।
আর এই কারণেই জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন ব্যর্থ হয়। কারণ নির্যাতন আমাদের সমন্বিত, সামাজিক, মানসিক এবং স্নায়বিক কার্যক্রমে আক্রমণ করে, একজনের নির্যাতিতের ভাবনা-চিন্তায় মারাত্মক ব্যাঘাতের সৃষ্টি করে।
টর্চার (Torture) এর নীতিমালা প্রণয়নকারী ব্যক্তিরা কারাগারে শারীরিকভাবে উপস্থিত থেকে এসব নির্যাতন পরিচালনা করেন না; তাই এর প্রভাব আসলে কতটুকু কার্যকরী তা আসলে তাদের জন্য নির্ধারণ করা কঠিন। তবে কাউকে তো এই কাজ করতে হবে। এর ফলস্বরূপ, যারা জিজ্ঞাসাবাদকারীর পক্ষে নির্যাতন চালায়, তারা নিজেদের এসব বর্বর কাজগুলি দ্বারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মানসিকভাবে তারা দূর্বল এবং বিকৃত হয়ে পড়ে।
বিজ্ঞান এবং নীতিশাস্ত্রর মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার ক্ষেত্রে অনেক অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এটির জন্য রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক এবং আইনপ্রয়োগকারী দের মধ্যে পরিবর্তন প্রয়োজন। কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ চালানো উচিত, অপরাধীদের কী করা উচিত, জিজ্ঞাসাবাদকারীদের কী প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, জিজ্ঞাসাবাদের মূল কেন্দ্রবিন্দুটি কী হওয়া উচিত তা নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। অনুমান কিংবা আটককৃতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি প্রদানের ইচ্ছা থেকে নয়, জিজ্ঞাসাবাদ হওয়া উচিত বিজ্ঞান এবং নীতিশাস্ত্র মেনে, মনোবিজ্ঞান ও শারীরিক সক্ষমতার উপরে যাচাই বাছাই করে।
‘জিজ্ঞাসাবাদ পেশাদারদের জন্য, এবং নির্যাতন অপেশাদারদের জন্য‘। চলচ্চিত্রের কল্পকাহিনি আর বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যারা জিজ্ঞাসাবাদের জ্ঞান মূলত এসব নিম্ন মানের শিল্পের থেকে পেয়েছে, তাদেরকে বোঝানো কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। সুস্থ মানসিকতার বিকাশ হোক, বর্বরতার সমাপ্তি ঘটুক।
কায়েস মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ সাই নেট, সাইকোলজিক্যাল সাইন্স, সাইকোলজি টুডে, নিউজউইক, নিউ সায়েন্টিস্ট, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ডিসকভার ম্যাগাজিন
+1
3
+1
+1
+1
2
+1
1
+1
+1