সময়ের সাথে সাথে মানব জাতি সমৃদ্ধ হচ্ছে এবং পরিবর্তিত হচ্ছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং রোবোটিক্সের অগ্রগতির সাথে আমরা এমন ভবিষ্যতের দিকেও যেতে শুরু করেছি যেখানে মানুষের মতো দেখতে কৃত্রিম প্রাণীও রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারে।
বিজ্ঞানীরা একটি নতুন কৃত্রিম প্রাণী তৈরি করেছেন যা ব্যাঙ এবং রোবটের একটি জীবন্ত সংমিশ্রণ। ব্যাঙের ভ্রূণ থেকে নেওয়া স্টেম সেল ব্যবহার করে ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয় (University of Vermont) এবং টুফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের (Tufts University) গবেষকরা এই ‘জেনোবট’ তৈরি করেছেন।
দলটি ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেসের প্রসিডিংস (PNAS) -এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে গবেষণাটির বর্ণনা দিয়েছে।
কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স বিশেষজ্ঞ যোশুয়া বোঙ্গার্ড বলেছেন, “এগুলো নভেল লিভিং মেশিন”। তিনি এই নতুন গবেষণার নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি আরও যোগ করেছেন, “তারা না কোনও চিরাচরিত রোবট, না কোনও প্রজাতির প্রাণী। এটি একটি নতুন শ্রেণি; একটি জীবন্ত, প্রোগ্রামযোগ্য জীব।”
জেনোবটগুলি ১ মিলিমিটারের চেয়ে কম দীর্ঘ এবং ৫০০-১০০০ টি জীবন্ত কোষ দ্বারা তৈরি। তাদের বিভিন্ন আকার রয়েছে। কিছু আকারের মধ্যে কয়েকটি ‘পা’ ও রয়েছে। তারা নিজেদের রৈখিক বা বৃত্তাকার দিকে চালিত করতে পারে, সম্মিলিতভাবে কাজ করতে এবং ছোট ছোট বস্তুকে সরিয়ে নিতে পারে। তাদের নিজস্ব সেলুলার শক্তি ব্যবহার করে, তারা ১০ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। জেনোবটগুলি পুরোপুরি বায়োডিগ্রেডেবল। সাত-দশ দিন পরে, তারা কেবল ত্বকের মৃত কোষে পরিণত হয়।
জেনোবটগুলির সৃষ্টি যুগোপযোগী। ‘প্রোগ্রামযোগ্য জীবন্ত রোবট’ হিসেবে বর্ণিত হওয়া সত্ত্বেও এগুলি আসলে সম্পূর্ণ জৈব এবং জীবন্ত টিস্যু দ্বারা তৈরি। ‘রোবট’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে কারণ জেনোবটগুলি বিভিন্ন রূপ এবং আকারে তৈরি করা যেতে পারে এবং নির্দিষ্ট কিছু বস্তুকে লক্ষ্য করতে ‘প্রোগ্রামযুক্ত’ করা যেতে পারে, যা তারা নির্দেশনা অনুযায়ী অনুসন্ধান করবে। ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পরে তারা নিজেরাই নিজেদের মেরামত করতে পারবে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক সংগ্রহ করে আমাদের দূষিত মহাসাগর পরিষ্কার করতে রোবটগুলোর ব্যবহার করা যেতে পারে। একইভাবে, বিপজ্জনক অঞ্চলে প্রবেশ করে তেজস্ক্রিয় পদার্থকে নিষ্ক্রিয় করতেও এরা ব্যবহৃত হতে পারে। জেনোবটগুলো ড্রাগ বহন করে মানব দেহে প্রবেশ করতেও সক্ষম।
এরা কি কোনোভাবে আমাদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে?
জেনোবটগুলি তাদের নিজস্ব খাদ্য উৎসের সাথে প্রিলোডেড হয়ে আসে, যা প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে, যদি না তারা পুষ্টিকর এবং সমৃদ্ধ পরিবেশে না থাকে। যদিও চিন্তা করবেন না, এই ছোট্ট জেনোবটেরা বংশ বিস্তার বা বিবর্তন করতে পারে না- কমপক্ষে বলা যায় এখন পর্যন্ত পারে না।
গবেষকরা আশা করেন যে আমরা এই প্রযুক্তি এবং সক্ষমতা যত বেশি বুঝতে পারব ততই আমরা ভাল থাকব। জেনোবটগুলো বেশ কয়েকটি নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে এই বটগুলি থেকে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন কিছু বিশেষজ্ঞ। অন্য কিছু বিশেষজ্ঞ ইঙ্গিত করছেন, বিজ্ঞানীরা ঈশ্বরের মতো ভূমিকা পালন করতে অস্বস্তিতে পড়ছেন।
গবেষণার প্রথম অংশে, বিজ্ঞানীরা নতুন জীবনের উপযুক্ত রূপের জন্য হাজার হাজার সম্ভাব্য নকশা তৈরি করতে একটি সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করেন। বিজ্ঞানীরা কম্পিউটারকে একটি কার্য নির্ধারণ করে দেন। এরপর কম্পিউটারটি কোন নকশাটি সর্বোত্তমভাবে কার্যকর হতে পারে তা নির্বাচিত করে।
গবেষণার দ্বিতীয় অংশে, মাইক্রোসার্জন এবং অন্যান্য গবেষকরা সেই নকশাগুলি বাস্তব জীবনে রূপান্তরিত করতে চেষ্টা করেন। তারা আফ্রিকান ব্যাঙের ভ্রূণ থেকে স্টেম সেল নেন, সেগুলিকে ব্যবহার করেন এবং তারপরে কম্পিউটারের তৈরি নকশা অনুযায়ী তাদের একত্রিত করেন।
এর অর্থ হলো, বিজ্ঞানীরা প্রকৃত জৈব পদার্থকে একসাথে সংযুক্ত করেছিলেন এমন একটি জীবন-রূপ তৈরি করতে, যা প্রকৃতিতে এর আগে কখনও দেখা যায়নি।
এরপরই কোষগুলি একসাথে কাজ শুরু করে। কম্পিউটার যেমন নির্দেশ দিয়েছিল, ঠিক তেমনভাবেই রোবটগুলি নিজেরাই চলতে সক্ষম হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নিয়ম অনুসরণ করে, সংযুক্ত ব্যাঙের ত্বক এবং কার্ডিয়াক কোষগুলি ব্যবহার করে বটগুলি চালিত হয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, তারা জেনোবট গুলির আরও জটিল এবং আধুনিক সংস্করণ তৈরি করতে সক্ষম হবেন।
জৈবিক ‘রোবট’ বা জেনোবট গুলো রোবোটিক সিস্টেমগুলি সম্পর্কে আমাদের বোঝাকে ত্বরান্বিত করতে পারে। কীভাবে জেনোবটগুলো আচরণ করবে এবং কীভাবে পরিবর্তিত হতে পারবে সে সম্পর্কে আরও জানার মাধ্যমে আমরা তাদের ভালভাবে বুঝতে সক্ষম হব।
কায়েস মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ/নিজস্ব প্রতিবেদক