উন্নত বিশ্বের কোনো দেশের কথা চিন্তা করলে যতগুলো দেশের নাম মাথায় আসবে, হলফ করেই বলা যায় জাপানের নাম শুরুর দিকেই থাকবে। জাপান- সূর্যদয়ের দেশ, চেরী ব্লসমের দেশ। সামুরাই যোদ্ধাদের দেশ। বলা হয়ে থাকে জাপানিদের নাকি ভবিষ্যতের এক পৃথিবীতে বসবাস। স্নিগ্ধ প্রকৃতি, শিক্ষিত ও কর্মঠ জনগোষ্ঠী, উন্নত প্রযুক্তি – সব মিলয়ে যেন স্বর্গীয় এক পরিবেশ। কিন্তু, আসলেই কি তাই? মুদ্রার অপর পিঠের চিত্রটা কী জানা আছে কারো?
বর্তমানে জাপান একটি অদ্ভুত ও কঠিন সমস্যার মোকাবেলা করছে। তাদের যুব সমাজ বিয়ে ও পরিবারের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী অনেক তরুণ-তরুণী ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ক্যারিয়ার ও আত্মবিকাশকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, যার ফলে তারা বিয়ে বা সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, আধুনিক সমাজে কর্মজীবনের চাপ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং দীর্ঘ কর্মঘণ্টা বিয়ের প্রতি এই আগ্রহ হ্রাসের অন্যতম কারণ।
এর ফলে জন্মহার ক্রমশ কমছে এবং দেশটিতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে জাপানের ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি, যা দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩০%। এই প্রবণতা জাপানের অর্থনীতি এবং সামাজিক কাঠামোর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে, কারণ বয়স্ক জনগোষ্ঠীর যত্ন নেওয়ার জন্য যুবক-যুবতীর সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে প্রবীণরা ভুগছেন নিঃসঙ্গতায়।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো এই নিঃসঙ্গতার চিত্র ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, এবং এর পরিণতিতে প্রতিনিয়ত ঘটছে একাকী মৃত্যু বা কোডোকুশি। আনুষ্ঠানিকভাবে এটি এমন একটি মৃত্যু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যেখানে কেউ কোনো ব্যক্তির যত্ন না নেওয়ার ফলে তিনি মারা যান, এবং কিছু সময় পর তার মরদেহ পাওয়া যায়। বর্তমান পরিস্থিতি এতটাই করুণ যে, বহু মানুষ তাদের জীবনসঙ্গী, পরিবারের মানুষ,প্রতিবেশী, বা কোনো প্রিয়জনের উপস্থিতি ছাড়াই তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই প্রায় ৪০ হাজার মানুষ নিজ বাড়িতে একা মারা গেছেন, এবং এর মধ্যে প্রায় ৪ হাজার জনকে মৃত্যুর এক মাস পর উদ্ধার করা হয়েছে।
জাপান পুলিশের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। পুলিশের ওই প্রতিবেদনে প্রত্যাশা করা হয়, এর মধ্য দিয়ে জাপানের বিপুলসংখ্যক প্রবীণ জনসংখ্যার একাকী জীবনযাপন ও মৃত্যুর বিষয়টি ফুটে উঠবে। জাতীয় পুলিশ সংস্থার সংগৃহীত এ বছরের প্রথম ছয় মাসের তথ্যানুযায়ী, একাকী জীবনযাপন করা মোট ৩৭ হাজার ২২৭ মানুষকে তাদের নিজ বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে ৭০ শতাংশের বয়স ৬৫ বা তার বেশি। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নিজ বাড়িতে একাকী মারা মানুষদের মধ্যে আনুমানিক ৪০ শতাংশ মানুষকে মৃত্যুর একদিনের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া গেছে। প্রায় ৩ হাজার ৯৩৯টি মরদেহ মিলেছে মৃত্যুর এক মাসেরও বেশি সময় পরে। এছাড়া ১৩০টি মরদেহ পাওয়া গেছে মৃত্যুর অন্তত এক বছর পর। একাকী মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ৭ হাজার ৪৯৮ জনের বয়স ৮৫ বছর বা তারও বেশি। এছাড়া ৫ হাজার ৯২০ জনের বয়স ৭৫ থেকে ৭৯ বছরের মধ্যে এবং ৫ হাজার ৬৩৫ জনের বয়স ৭০ থেকে ৭৪ বছরের মধ্যে।
জাপানের টোকিওর উপকণ্ঠে বসবাসরত ৭৬ বছর বয়সী নোরিকো শিকামা যেমন বলেন,
“আমরা মাঝে মাঝে একে অপরকে অভিবাদন জানাই, কিন্তু এটাই সব। আমার প্রতিবেশীদের মধ্যে একজন মারা গেলে আমি নিশ্চিত নই যে আমি লক্ষ্য করব।”
তিনি টোকিওর কমিউটার বেল্টের একটি ফ্ল্যাট টোকিওয়াদাইরায় একা থাকেন, এসেছিলেন ইকি ইকি ড্রপ-ইন সেন্টারে যেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা পরিবেশিত কফি কাপে আশেপাশের এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের খোঁজখবর নেন। এখানে দৈনন্দিন আলোচনার মধ্যে লোকেরা সর্বশেষ একাকী মৃত্যু, বা কোডোকুশির খবরও ভাগ করে নেয়। এবারের খবর- কিছুদিন আগে এমন একজন মহিলার দেহ তার নিজ বাসায় পাওয়া গেছে যখন প্রতিবেশীরা লক্ষ্য করেন যে দীর্ঘদিন তারা তাকে তার বারান্দায় দেখেনি। তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে মৃত্যুর পাঁচ মাস পর।
শিকামা বলেন,
“গন্ধটি বিভৎস ছিল। এটি চিরকাল আপনার মাথায় গেঁথে রয়।”
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন অ্যান্ড সোশ্যাল সিকিউরিটি রিসার্চ এ বছরের এপ্রিলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, জাপানে একাকী বসবাসকারী প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যা আগামী ২৫ বছরের মধ্যে অনেক বৃদ্ধি পাবে। ২০৫০ সালের মধ্যে দেশটির প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে একা একা জীবন কাটাতে হতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানে ১ কোটি ৮ লাখ বয়স্ক মানুষ নিঃসঙ্গভাবে একা বসবাস করবেন, যা দেশটির সব পরিবারের ২০ দশমিক ৬ শতাংশ।
এই সংকটের পেছনে থাকা মূল কারণগুলো খুঁজতে গেলে সমাজের ভেঙে পড়া সম্পর্ক এবং পরিবারগুলোর ছোট হয়ে যাওয়াকে চিহ্নিত করা হয়। বহু মানুষ, বিশেষত বয়স্করা, পরিবার বা সমাজের সাথে সংযোগ হারিয়ে একা বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু এমনটাই কী হওয়ার ছিল?
জাপানিরা বরাবরই এমন একটি জীবনধারা অনুসরণ করে, যা ধীরে ধীরে, কিন্তু স্থায়ী উন্নতির দিকে ধাবিত করে। জাপানের ঐতিহ্যগত সমাজে পরিবার ছিল জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে প্রত্যেকের দায়িত্ব ছিল একে অপরের পাশে থাকা এবং একটি দৃঢ় সামাজিক কাঠামো তৈরি করা। পরিবারের এই বন্ধন ছিল সমাজের মূল চালিকা শক্তি। এর কেন্দ্রে রয়েছে দুটি শক্তিশালী দর্শন: ইকিগাই এবং কাইজেন।
ইকিগাই জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়ার কথা বলে। এটি শুধু ব্যক্তিগত লক্ষ্য পূরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি পারিবারিক বন্ধন এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার সঙ্গেও জড়িত। জাপানি পরিবারগুলোতে প্রত্যেকের নিজস্ব ইকিগাই থাকতে পারে—কেউ হয়তো পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য কাজ করছেন, কেউ আবার সন্তানদের সফল ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করছেন।
অন্যদিকে, কাইজেন, যার মূল কথা হলো ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে ধারাবাহিক উন্নতি, পরিবারের ভেতরেও একইভাবে প্রয়োগ করা হয়। প্রতিদিনের জীবনযাপনে সামান্য মনোযোগ দিয়ে পারিবারিক সম্পর্ককে মজবুত রাখা, ছোট ছোট ঝগড়া বা সমস্যা মিটিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখা—এসবই কাইজেনের ধারণার বাস্তব উদাহরণ।
জাপানের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই “ইকিগাই” এবং “কাইজেন” এর মতো জীবন দর্শনকে ধারণ করে আসছে। তবে বর্তমান প্রজন্মের জন্য এই দর্শনগুলো কেন কার্যকর হচ্ছে না? কেন জাপানের মতো একটি দেশে, যেখানে মানুষজন তাদের নিজস্ব জীবন দর্শন ও সংস্কৃতির মাধ্যমে শতাব্দী ধরে মানসিক শান্তি খুঁজে পেয়েছে, সেখানে এখন কেন এই নিঃসঙ্গতা?
এর এক কথায় উত্তর হলো- সমাজের রূপান্তর। কর্মব্যস্ততা এবং সমাজের ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে পরিবার এবং সামাজিক বন্ধনের গুরুত্ব কমে গেছে। যেখানে একসময় পরিবার ছিল জাপানিদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, সেখানে এখন কাজ, প্রযুক্তি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা সেই স্থানটি দখল করে নিচ্ছে।
এমনকি, যারা পরিবারের সাথেও বসবাস করছেন, তাদের মধ্যেও কোডোকুশির সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে ডিমেনশিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেখানে রোগীরা পরিবারের সদস্যদের সাথে থেকেও মৃত্যুর পর অনেক দিন ধরে অজানা থেকে যান।
এহেন পরিস্থিতিতে সরকারি উদ্যোগ এবং স্থানীয় পর্যায়ে টোকিওর মতো শহরগুলোর বাসিন্দাদের মধ্যে সেন্সর এবং ভলান্টিয়ার প্যাট্রোলের মাধ্যমে কোডোকুশি কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবুও নিঃসঙ্গতা কাটানোর প্রকৃত সমাধান এখনো অনেক দূরে। কেননা স্বাভাবিকভাবেই একজন ব্যক্তি তার রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় তথা নিজের স্বামী/স্ত্রী, সন্তান সন্ততির কাছে যেই যত্ন, ভালোবাসা পান, স্বেচ্ছাসেবকদের আন্তরিকতায় তার অভাব পূর্ণ হওয়া অসম্ভব।
শুধু জাপান নয় বরং বর্তমান বিশ্বের সমগ্র তরুণ প্রজন্মের জন্য এটি একটি নতুন বাস্তবতা। কর্মসংস্থান, পরিবার এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা এখন আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে। সেই সাথে জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া বা উন্নতির লক্ষ্যও অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং, জাপানে নিঃসঙ্গতার এই ভয়াবহ চিত্র শুধুমাত্র প্রবীণদের সমস্যাই নয়, এটি পুরো সমাজের জন্যই এক উদ্বেগজনক সংকেত।
শাহলীন রাহনুমা / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বাংলাদেশ প্রতিদিন