আমরা কমবেশি চেরনোবিলে-র ব্যাপারে কোথাও শুনেছি কিংবা পড়েছি। চেরনোবিল এ ঘটে যাওয়া ঘটনার আলোকে তৈরি “Chernobyl” টিভি সিরিজটির মাধ্যমে উক্ত স্থান সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ এবং জ্ঞান দুটোই আরো গভীর হয়।
সংক্ষেপে যদি বলি, ১৯৮৬ সালের এপ্রিলের ২৫-২৬ তারিখের ঘটনা এটি। ঘটনার স্থান তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র (এটি ভি. আই. লেনিন পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র নামেও পরিচিত)। এই শক্তিকেন্দ্রের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর বা নিউক্লিয় চুল্লী বিস্ফোরণের ঘটনাটিই মূলত চেরনোবিল বিপর্যয়।
দুর্ঘটনাটি ঘটেছিলো মূলত একটি অপরিকল্পিত পারমাণবিক পরীক্ষা পরিচালনা করতে গিয়ে। চুল্লী নং ৪-এ করা হয়েছিলো এই অপরিকল্পিত পরীক্ষা। চেরনোবিলে-র অপারেটররা এর পাওয়ার রেগুলেটিং সিস্টেমটি বন্ধ করে দেয়। সেই সাথে এর জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থাটিও বন্ধ করে দেয়া হয়। অপারেটররা কোরের সাথে সংযুক্ত কন্ট্রোল রডগুলোও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কিন্তু রিঅ্যাক্টরটি তখনো কাজ করছিলো মাত্র ৭ শতাংশ শক্তি নিয়ে। এতসব অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের কারণে চুল্লীর চেইন রিঅ্যাকশন এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, তা আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।
এই বিস্ফোরণের ফলে ৫০ থেকে ১৮৫ মিলিয়ন কুরি রেডিওনিউক্লাইড পরিবেশে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এর তেজস্ক্রিয়তা এতটাই ভয়াবহ ছিলো যে, সেটি হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার প্রায় কয়েকগুণ। একইসাথে এর বিস্তরণের পরিমাণ ছিলো হিরোশিমা-নাগাসাকির তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিস্তরণের ১০০ গুণ। কয়েকদিনের মধ্যেই এর তেজস্ক্রিয়তা আশপাশের দেশগুলোতে, যেমন- বেলারুশ, ইউক্রেন, ফ্রান্স ও ইতালিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
চেরনোবিল এর আয়তন ছিলো প্রায় ২,৬৩৪ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু তেজস্ক্রিয়তা আরো ছড়িয়ে পড়ার কারণে এই আয়তনকে আরো বর্ধিত করে প্রায় ৪,১৪৩ বর্গ কিলোমিটার করা হয়। সাধারণত এই নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে কোনো জনমানুষকে বসবাসের অনুমতি দেয়া হয় না বা কেউ থাকেও না। তবে বিজ্ঞানী বা গবেষকদেরকে বিশেষভাবে এবং স্বল্পসময়ের জন্য এখানে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়।
বিস্ফোরণের পরেও এই শক্তিকেন্দ্রে প্রায় ২০০ টনের মত তেজস্ক্রিয় পদার্থ মজুদ থেকে গেছে। বর্তমান গবেষকদের হিসাবমতে এই তেজস্ক্রিয় পদার্থ পুরোপুরি নিস্ক্রিয় হতে আরো প্রায় ১০০ থেকে ১০০০ বছর লেগে যাবে।
তবে, নিউ ইয়র্ক পোস্ট এর তথ্য মতে চেরনোবিলে থাকা ফাঙ্গাস বা ছত্রাকগুলোকে রিসাইকেল করে ব্যবহার করার এক সু্যোগ আছে। মূলত নভোচারীদের মহাকাশ মিশনে উক্ত ছত্রাক গুলো রেডিয়েশন থেকে রক্ষা করতে পারে বলে জানানো হচ্ছে। চেরনোবিল থেকে পাওয়া এক ধরণের ছত্রাককে একটি গবেষণা প্রকল্পে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল, যার লক্ষ্য ছিল মহাকাশচারীদের গভীর মহাকাশ মিশনে রেডিয়েশন থেকে সুরক্ষিত রাখা।
জীববিজ্ঞানের জন্য bioRxiv প্রিপ্রিন্ট সার্ভারে আপলোড করা একটি গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন, “ডিপ-স্পেস অনুসন্ধানের মিশনে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় বাঁধা রেডিয়েশন। তবে চেরনোবিল সাইটে পাওয়া ছত্রাকটি গামার বিকিরণকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। মূলত উক্ত শক্তি রুপান্তরের জন্য ছত্রাকগুলো মেলানিন ব্যবহার করে এবং “রেডিওসিনথেসিস” সম্পাদন করে। উল্লেখ্য, মহাকাশে এই বিকিরণের প্রভাব মঙ্গল গ্রহের মতো স্থানে দীর্ঘকালীন স্পেসফ্লাইটের জন্য বিশেষ উদ্বেগ।
নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয় শার্লট, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলিনা স্কুল অফ সায়েন্স অ্যান্ড ম্যাথমেটিক্সের বিজ্ঞানীরা গবেষণা প্রকল্পটি স্থাপন করেছিলেন। তাঁরা ক্লাডোস্পোরিয়াম স্পেরোস্পার্মাম ছত্রাক ব্যবহার করেছিল। ছত্রাকযুক্ত একটি পেট্রিডিশ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নভোচারী দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। bioRxiv এর গবেষকরা ব্যাখ্যা করেন, “ক্লাডোস্পোরিয়াম স্পেরোস্পার্মামের বৃদ্ধি এবং আয়নাইজিং বিকিরণকে কিভাবে কমায় তা জানতে ৩০ দিন সময় ধরে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন (আইএসএস) একে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল”।
গবেষণায় দেখা গেছে যে ছত্রাকটি মহাকাশে জন্মাতে পারে। আইএসএস এর গবেষকরা লিখছেন, “একটি সূক্ষ্ম এবং সহজ পরীক্ষামূলক সেটআপ ডিজাইনের মাধ্যমে একটি ছোট একক পেলড হিসাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল, এটি দেখায় যে মেলানিন যুক্ত ফাঙ্গাস সি. স্পেরোস্পার্মাম এলইও [লো আর্থ অরবিট] এ চাষ করা যেতে পারে, যখন অন্যান্য মাইক্রোগ্রাভিটি এবং রেডিয়েশন মহাকাশ স্টেশনের পরিবেশের সাপেক্ষে রাখা হবে”। অ্যানালাইজিক আর্থ-ভিত্তিক সমীক্ষা অনুসারে, “এর বৃদ্ধির বৈশিষ্ট্যগুলো আরও দেখায় যে, ছত্রাকটি কেবল স্পেস রেডিয়েশনের বিরুদ্ধে রূপান্তরিত হয় না বরং বেড়ে ওঠে এবং রুখে দাড়ানোরও সক্ষমতা প্রকাশ করে”।
এছাড়াও চেরনোবিল সম্পর্কিত আরও অন্যান্য উদ্ভাবনী গবেষণা চলছে।
উদাহরণস্বরূপ, এ বছরের শুরুর দিকে, যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা চেরনোবিলে-র ধ্বংসস্থুপ থেকে এমন পদার্থের বিকাশের ঘোষণা করেছিলেন যা জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পারমাণবিক চুল্লিগুলির ক্ষয়ক্ষতিতে সহায়তা করতে ব্যবহৃত হতে পারে। গবেষকরা বলছেন, ইউক্রেনের বিজ্ঞানীদের নিয়ে তৈরি উপকরণগুলি লাভা-জাতীয় জ্বালানীযুক্ত উপাদান (এলএফসিএম) এর মতো কাজ করতে পারে যা পারমাণবিক বিপর্যয় হলে সে স্থানে ক্ষয়ক্ষতির প্রচেষ্টাতে বাধা সৃষ্টি করে।
চেরনোবিল একটি ধ্বংসস্তুপ বটে তবে এর উপাদানগুলোও এখন কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। রিসাইক্লিং করার মানসিকতাই যেকোনো কিছুকে কার্যকর বানানোর ক্ষমতা রাখে কেবল।
ফাহাদ বিন এনাম/ নিজস্ব প্রতিবেদক