চুল পড়ার জন্য অনেকেই বিড়ম্বনায় থাকেন। সৌন্দর্য বৃদ্ধির অন্যতম এই প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ সবারই অনেক প্রিয়। কিন্তু এই সৌন্দর্য বর্ধনকারী চুলই যদি আস্তে আস্তে পড়তে থাকে, তখন দেখা যায় চুল পড়া-র টেনশনে আরো বেশি চুল পড়তে থাকে!
মাথায় প্রশ্ন ঘুরে,
চুল পড়া কি কোনো রোগ?
কেন এত চুল পড়ে?
চুল পড়ার চিকিৎসা কি?
ইত্যাদি। তবে আপনার চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সাধারণত চুল পড়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু স্বাভাবিকের তুলনায় যদি বেশি পরিমাণে চুল পড়ে তাহলে চিন্তিত হওয়ার কিছুটা কারণ রয়েছে। চলুন তাহলে এই সম্পর্কে আরো জেনে আসা যাক।
চুল পড়া কি?
চুল পড়া, যা অ্যালোপেসিয়া বা টাক নামেও পরিচিত, এটি মাথা বা শরীরের চুল পড়ে যাওয়াকে বোঝায়। সাধারণত অ্যালোপেসিয়া বা টাক মাথার সঙ্গেই সর্ম্পকিত। দিনে ৫০ থেকে ১০০ টা চুল পড়া স্বাভাবিক। আমাদের মাথায় প্রায় ১০০,০০০ চুল থাকে, যার মধ্যে এই ছোট ক্ষতিটা লক্ষনীয় নয়। নতুন চুল সাধারণত হারানো চুলের স্থান দখল করে, কিন্তু এটি সবসময় ঘটে না। ৫০ বছর বয়সের মধ্যেই ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নে চুল পড়া পুরুষদের মাঝে প্রায় অর্ধেক সংখ্যক এবং মহিলাদের মাঝে প্রায় এক চতুর্থাংশ-এর চুল পড়াকে প্রভাবিত করে। প্রায় ২% মানুষের মধ্যে কোনো না কোনো সময় অ্যালোপেসিয়া এরিয়াটার বিকাশ ঘটে।
আমেরিকান একাডেমি অফ ডার্মাটোলজি [American Academy of Dermatology] (AAD) উল্লেখ করেছে যে আমেরিকায় ৮০ মিলিয়ন পুরুষ এবং মহিলাদের বংশগত চুল পড়ে (অ্যালোপেসিয়া)। এটি আপনার মাথার বা পুরো শরীরের চুলকে প্রভাবিত করতে পারে। যদিও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অ্যালোপেসিয়া বেশি দেখা যায়, তবে শিশুদের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত চুল পড়তে পারে।
একদিনে কতটি চুল পড়েছে, তা একদম সঠিক পরিমাপ করা আসলে অসম্ভব। আপনি যদি লক্ষ্য করেন যে আপনি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চুল হারাচ্ছেন, তাহলে আপনার প্রয়োজন ডাক্তারের সাথে আলোচনা করা। তারা আপনার চুল পড়ার সঠিক কারণ নির্ধারণ করতে পারবেন এবং উপযুক্ত পরামর্শ দিতে পারবেন।
চুল পড়ার সাধারণ কারণ হলো বংশগত। আপনার পারিবারিক ইতিহাসে যদি টাক পড়ার ঘটনা থাকে, তবে আপনার ক্ষেত্রেও একই কারণ কাজ করতে পারে। আবার আমাদের দেহের কিছু হরমোন এই বংশগত চুল পড়াকে ট্রিগার করতে পারে। হরমোনের মাত্রার ওঠা-নামার কারণে এটি বয়ঃসন্ধিকালের প্রথম দিকেও শুরু হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে অসুস্থতা বা কোনো মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট চুল পড়াকে ট্রিগার করতে পারে।
হরমোনের পরিবর্তন সাময়িকভাবে চুল পড়ার কারণ হতে পারে। যেমনঃ
- গর্ভাবস্থা
- সন্তানের জন্ম
- জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিলের ব্যবহার বন্ধ করা
- মেনোপজ
চুল পড়ার কারণ হতে পারে এমন অসুস্থতার মধ্যে রয়েছেঃ
- থাইরয়েড রোগ
- অ্যালোপেসিয়া আরেটা (একটি অটোইমিউন রোগ যা চুলের ফলিকল আক্রমণ করে)
- দাদের মত মাথায় ত্বকের সংক্রমণ
- লাইকেন প্ল্যানাস এবং কিছু ধরনের লুপাসের মতো দাগ সৃষ্টিকারী রোগগুলি দাগ ও চুলের স্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে।
চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ওষুধের (মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টের) কারণেও চুল পড়তে পারেঃ
- ক্যান্সার
- উচ্চ রক্তচাপ
- বাত
- বিষন্নতা
- কোলেস্টেরল
- ডায়াবেটিস
- হার্টের সমস্যা
শারীরিক বা মানসিক শক থেকেও চুল পড়া ট্রিগার হতে পারে। যেমনঃ
- পরিবারের কারো মৃত্যু
- চরম ওজন হ্রাস
- অনেক পরিমাণে জ্বর
এছাড়াও, ট্রাইকোটিলোম্যানিয়া (চুল টানার ব্যাধি) আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাধারণত তাদের মাথা, ভ্রু বা চোখের পাতার লোম তুলে ফেলতে দেখা যায়। বিভিন্ন রকমের উঁচু ও শক্ত করে বাঁধা চুলের স্টাইলগুলোও চুল পড়ার কারণ হতে পারে, এটি চুলের গ্রন্থিকোষের উপর চাপ দেয়। আর প্রতিদিনের খাবারে প্রোটিন, আয়রন এবং অন্যান্য পুষ্টির অভাব থাকাও এর অন্যতম একটি কারণ।
চুল পড়া কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
ক্রমাগত চুল পড়া অনেক সময়ই অন্য কোনো রোগের লক্ষণের দিকে নির্দেশ করে। আপনার ডাক্তার বা চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ শারীরিক পরীক্ষা এবং স্বাস্থ্যের ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে আপনার চুল পড়ার কারণ নির্ধারণ করবেন ও ঔষধ দিবেন। যদি তিনি অটোইমিউন বা চর্মরোগ সন্দেহ করেন, তাহলে তিনি আপনার মাথার ত্বকের বায়োপসি নিতে পারে। বায়োপসি হলো ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য ত্বকের একটি ছোট অংশ অপসারণ করা।
চুল পড়ার চিকিৎসা কি?
ঔষধঃ
চুল পড়ার চিকিৎসায় প্রথম কোর্স হতে পারে ওষুধ। ওভার-দ্য-কাউন্টার (OTC) ওষুধ সাধারণত টপিকাল ক্রিম এবং জেল যা সরাসরি মাথার ত্বকে ব্যবহার করবেন। সর্বাধিক সাধারণ পণ্যগুলির মধ্যে মিনোক্সিডিল (রোগেইন) নামক উপাদান থাকে।
AAD অনুসারে, ডাক্তার আপনাকে চুল পড়ার চিকিৎসার সাথে মিনোক্সিডিল সাজেস্ট করতে পারে। মিনোক্সিডিলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে মাথার ত্বকে জ্বালাপোড়া এবং আপনার কপাল ও মুখের মতো পার্শ্ববর্তী এলাকায় চুলের বৃদ্ধি। এছাড়াও ফিনাস্টারাইড (প্রোপেসিয়া), আবার অ্যালোপেসিয়া অ্যারাটে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রিডনিসোনের মতো কর্টিকোস্টেরয়েড গুলিও ডাক্তার পরামর্শ দিয়ে থাকে, যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং ইমিউন সিস্টেম কে কিছুটা কমিয়ে দেয় কর্টিকোস্টেরয়েড আপনার অ্যাড্রনালগ্রন্থি দ্বারা তৈরি হরমোন গুলির অনুসরণ করে।
কর্টিকোস্টেরয়েডের বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছেঃ
- গ্লুকোমা, এক ধরণের চোখের রোগ, অপটিক স্নায়ুর ক্ষতি এবং দৃষ্টিশক্তি হ্রাস করতে পারে।
- তরল ধরে রাখা এবং পায়ের নীচে ফোলা ভাব।
- উচ্চ রক্তচাপ
- ছানি
- রক্তে উচ্চ শর্করা
এমন প্রমাণ রয়েছে যে, কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহার নিম্নলিখিত সমস্যাগুলোর কারণ হতে পারেঃ
- সংক্রমণ
- হাড় থেকে ক্যালসিয়াম ক্ষয়, যা অস্টিওপওরেসিস এর কারণ হতে পারে।
- পাতলা ত্বক এবং সহজ ক্ষত
- গলা ব্যথা
- কর্কশতা
অ্যালোপেসিয়া এরিয়াটা আক্রান্ত স্থলে স্টেরয়েড ইনজেকশনও ব্যবহার করতে বলা হয় অনেক সময়, তবে এটি কার্যকর হওয়ার জন্য এগুলি ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি করতে হবে।
চিকিৎসা পদ্ধতিঃ
কখনও কখনও, ঔষধ চুল পড়া বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট নয়। টাক পড়া চিকিৎসার জন্য অস্ত্রোপচার পদ্ধতি রয়েছে।
- হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি আপনার মাথার ত্বকের টাক অংশে অল্প লোমযুক্ত ত্বকের ছোট প্লাগগুলিকে সরিয়ে দেয়। এটি উত্তরাধিকার সূত্রে টাক পড়া লোকের জন্য ভালো কাজ করে কারণ তাদের সাধারণত মাথার উপরের চুল পড়ে, এই ধরনের চুল পড়া ঘটমান, আপনার সময়ের সাথে সাথে একাধিক অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হবে। - স্ক্যাল্প রিডাকশন
স্ক্যাল্প রিডাশনে, একজন সার্জন আপনার মাথার ত্বকের এমন অংশ সরিয়ে দেন যেখানে চুলের আভাব রয়েছে। সার্জন তারপরে আপনার মাথার ত্বকের একটি টুকরো দিয়ে ঔ এলাকাটি বন্ধ করে দেয় যেখানে চুল রয়েছে। আরেকটি বিকল্প হলো ফ্ল্যাপ, যেখানে আপনার সার্জন মাথার খুলি ভাঁজ করে যেখানে টাকের উপর চুল আছে। - টিস্যু প্রসারণ
এই পদ্ধতিটি টাকের দাগও ঢেকে দিতে পারে। এর জন্য দুটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। প্রথম অস্ত্রোপচারে একজন সার্জন আপনার ত্বকের এমন একটি অংশের নীচে টিস্যু প্রসারিত করবে যেই অংশের চুল আছে এবং টাকের পাশে থাকে। কয়েক সপ্তাহ পর এক্সপেন্ডার আপনার মাথার ত্বকের যে অংশে চুল আছে তা প্রসারিত করবে। দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারে, আপনার সার্জন এক্সপেন্ডারটি অপসারণ করেন এবং মাথার ত্বকের প্রসারিত অঞ্চলটি টাক দাগের উপর চুল সহটান দেন। টাক প্রতিকারক এই অস্ত্রোপচার ব্যয়বহুল হয়ে থাকে এবং ঝুঁকিও বহন করে, এর মধ্যে রয়েছেঃ
১। বেমানান চুলের ঝুঁকি
২। রক্তপাত
৩। প্রশস্ত দাগ
৪। সংক্রমণ
আমি কিভাবে চুল পড়া রোধ করতে পারি?
চুল পড়া রোধ করতে আপনি বেশ কিছু জিনিস করতে পারেন।
- বিনুনি, পনিটেল বা ঝুঁটি এর মতো আটোঁসাটঁ চুলের স্টাইল করা থেকে বিরত থাকা, এই সব স্টাইল আপনার চুলে খুব বেশি চাপ দেয়। ওভারটাইম এই স্টাইল গুলো আপনার চুলের ফলিকলগুলিকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
- আপনার চুল টানা, মোচড় বা ঘষার চেষ্টা করবেন না।
- নিশ্চিত করুন, আপনি সুষমখাদ্য গ্রহণ করছেন যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন এবং প্রোটিন রয়েছে।
- চুল পড়ার ক্ষেত্রে স্টাইলিং পণ্য এবং সরঞ্জামগুলো বেশ ভালো ভূমিকা রাখে। যেমনঃ
১। ব্লো ড্রায়ার
২। উত্তপ্ত চিরুনি
৩। হেয়ার স্ট্রেইটনার
৪। রঙ করার পণ্য
৫। ব্লিচিং এজেন্ট
৬। পার্ম
৭। রিল্যাক্সার
আপনি যদি উত্তপ্ত সরঞ্জাম দিয়ে আপনার চুলের স্টাইল করার সিদ্ধান্ত নেন তবে আপনার চুল শুকিয়ে যাওয়ার পর তা করুন, এছাড়াও সম্ভাব্য সর্বনিম্ন সেটিং ব্যবহার করুন।
নিয়মিত চুলের যত্ন নেওয়া ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার মাধ্যমে চুল পড়ার হার কমানো ও চুলকে আরো স্বাস্থ্যজ্জ্বল করে তোলা সম্ভব। কিন্তু যখন চুল পড়ার হার অতিরিক্ত পরিমাণে হয়ে যায়, তখন তা আর অবহেলা না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই উত্তম।
আরাফাত রহমান/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ Wikipedia , healthline