১৯৬৯ সালে নাসার ঐতিহাসিক ‘Apollo Program’ এর মাধ্যমে মানুষ প্রথমবারের মতো চাঁদের বুকে পা রাখতে সক্ষম হয়। ঐ অভিযানে সংগৃহীত ‘Lunar Soil’ বা চাঁদের মাটির নমুনা পরীক্ষা করে তৎকালীন বিজ্ঞানীরা মতামত দেন যে, “চন্দ্রপৃষ্ঠে পানির তেমন কোন অস্তিত্ব নেই, এর বেশিরভাগ অংশ সম্পূর্ণরূপে শুষ্ক।” কিন্তু তাই বলে চাঁদে পানির সন্ধান থেমে থাকেনি। এমনকি বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতেও এ নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে। তবে সম্প্রতি একদল গবেষক চাঁদের বুকে পানির সন্ধান পেয়েছেন বলে দাবি করছেন।
সম্প্রতি হওয়া চীনের Chang’e 5 মহাকাশ অভিযানে, তারা চাঁদ হতে কিছু নমুনা পৃথিবীতে আনে। সে নমুনাতে উনারা প্রচুর ‘Glass Beads‘ দেখতে পান।
যখন চাঁদের পৃষ্ঠে উল্কাপাত হয় তখন উল্কাসমূহ এবং চাঁদের পৃষ্ঠের সংঘর্ষের ফলে চাঁদের মাটির কিছু অংশ উপরের দিকে ওঠে আসে। মাটির সাথে সেখানে থাকা বিভিন্ন খনিজ পদার্থ (যেমন: সিলিকেট) ইত্যাদিও উপরে চলে আসে। সংঘর্ষের কারণে তৈরি হওয়া প্রচুর তাপের ফলে মাটিগুলোতে থাকা সিলিকেট কণাগুলো গলে যায়। গলিত সিলিকেট কণাগুলো পরস্পর যুক্ত হতে থাকে এবং ঠান্ডা হবার পর এক পর্যায়ে মার্বেলের মতো দেখতে ছোটো ছোটো কাঁচের কণায় রূপান্তরিত হয়। এদের ‘Glass Beads’ বলে।
তবে যে ব্যাপারটি বিজ্ঞানীদের চোখ কপালে তুলে ফেলে, তা হলো সেসব Glass Beads এর ভেতরে থাকা পানির অণুসমূহ। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী, চাঁদের পৃষ্ঠের সাথে মিশে থাকা এসব কাঁচকণা সব মিলিয়ে প্রায় ২৭০ বিলিয়ন টন পর্যন্ত পানি ধারণে সক্ষম। এত পরিমাণ পানি দিয়ে ১০০ মিলিয়ন অলিম্পিক সাইজের সুইমিংপুল সহজেই পূর্ণ করে ফেলা যাবে।
Chang’e 5 অভিযানটি কী?
Chang’e 5 হলো ‘Chinese Lunar Exploration Program’ কর্তৃক আয়োজিত পঞ্চম চন্দ্রাভিযান। (Chang’e নামটি মূলত চাইনিজ চন্দ্রদেবীর নাম হতে নেওয়া হয়েছে)। ২০২০ সালে Chang’e 5 মহাকাশযানটি সংগৃহীত নমুনাসহ পৃথিবীতে ফেরত আসে। মহাকাশযানটি Oceanus Procellarum নামক চাঁদের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবতরণ করে। যে স্থানটি হতে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল তার নাম Mons Rümker। এটি ৭০ কি.মি. জুড়ে থাকা একটি বিশাল মাটির ঢিপি। ধারণা করা হচ্ছে, এখানে থাকা মাটিগুলো ১.২ বিলিয়ন বছর পূর্বে গঠিত হয়েছিল। নাসা নিজেদের ‘Apollo program’ এ যে মাটির নমুনাগুলো এনেছিল সেগুলো প্রায় ৩.১ থেকে ৪.৪ বিলিয়ন বছর পুরনো। ফলে ‘Mons Rümker’ থেকে Chang’e 5 এর সংগৃহীত নমুনাগুলো এ পর্যন্ত পাওয়া চাঁদের সবচেয়ে কম বয়সী নমুনা।
তবে প্রশ্ন হলো, Glass beads গুলোতে পানি আসলো কোথা থেকে?
গবেষকদের ধারণা, পানিগুলোর মূল উৎস হলো ‘সৌর বায়ু’। পৃথিবীতে যেমন বায়ুমণ্ডল আছে, সূর্যের চারদিকে তেমনই একটা গ্যাসের আবরণ রয়েছে। এই আবরণকে তিনস্তরে ভাগ করা যায়:
- ফটোস্ফিয়ার,
- ক্রোমোস্ফিয়ার এবং
- করোনা।
‘করোনা’ হলো সর্ববহিঃস্থ স্তর। সূর্যের করোনা স্তরটি মূলত প্লাজমা স্তর। (প্লাজমা হলো পদার্থের চতুর্থ অবস্থা। এ অবস্থায় অতিরিক্ত তাপের ফলে গ্যাসের পরমাণুসমূহ থেকে ইলেক্ট্রন বেরিয়ে এক প্রকার আয়নিত গ্যাস তৈরি করে। এই আয়নিত গ্যাসে মুক্ত ইলেকট্রন এবং ধনাত্মক আয়নের সংখ্যা প্রায় সমান।) এটি প্রধানত ইলেক্ট্রন, প্রোটন এবং আলফা কণা দ্বারা গঠিত। অতিরিক্ত তাপের ফলে প্লাজমা স্তরটি এত বেশি তাপশক্তি অর্জন করে যে, সূর্য নিজের মহাকর্ষ বল দ্বারা সেটিকে আর নিজের দিকে ধরে রাখতে পারেনা। ফলে স্তরটির বহিঃস্থ প্রসারণ ঘটে। এরপর সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্রের রেখাগুলো ধরে এটি ক্রমশ এগোতে থাকে। এটিই মূলত ‘সৌর বায়ু’। এই রেখাগুলো সমস্ত সৌরজগৎ জুড়ে বিস্তৃত। ফলে ‘সৌর বায়ু’ এর প্রভাব সমস্ত সৌরজগতেই দেখা যায়।
এবার আসি চাঁদে পানি পাওয়া যাওয়ার সাথে সৌর বায়ুর সম্পর্কের দিকে। সৌর বায়ুতে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেন থাকে। হাইড্রোজেনগুলো সেখানে মূলত ধনাত্মক আধান বা প্রোটন আকারে অবস্থান করে। Glass beads গুলো শক্ত হবার পূর্বেই হাইড্রোজেনগুলো এর ভেতরে আগে থেকে থাকা অক্সিজেন অণুর সাথে বিক্রিয়া করে ফেলে। ফলে তৈরি হয় পানি।
(মজার বিষয় হলো, চাঁদে কিন্তু প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন রয়েছে। কিন্তু সেগুলো বায়ুমন্ডলে মুক্তভাবে নেই। বরং অক্সিজেনগুলো চাঁদের উপরিস্তরে থাকা পাথর ও ধুলিকণার মধ্যে আটকে থাকে। চন্দ্রপৃষ্ঠে যে পরিমাণ অক্সিজেন রয়েছে তা পৃথিবীর ৮ বিলিয়ন মানুষের ১০০,০০০ বছরের চাহিদা মেটাতে সক্ষম।)
জেরেমি বয়েস নামক নাসার একজন বিজ্ঞানী এ গবেষণা নিয়ে বলেছেন,
“প্রথমত এই গবেষণাটি আমাদের এটি মনে করিয়ে দিয়েছে যে, চাঁদের সকল রহস্য এখনও ফুরিয়ে যায়নি।”
চাঁদের বুকে পানির সন্ধান মানব সভ্যতার জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। হয়তো চন্দ্রপৃষ্ঠে থাকা পানির এই বিশাল ভান্ডার একসময় আমরা নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে পারব। তাছাড়া সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহেও পানির সন্ধান পাওয়া নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন পূর্বের তুলানায় অধিক আশাবাদী। আপনি এ ব্যাপারে কী মনে করেন?
আতিক হাসান রাহাত/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: The Conversation, Chemistry World, JPL.NASA, Palentary, Wikipedia