কুকুর তাদের প্রখর ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের জন্য বিখ্যাত। আমরা জানি, কুকুর তার অতি সংবেদনশীল ঘ্রাণশক্তি ব্যবহার করে দিক নির্দেশনা দিতে পারে। এজন্য পুলিশ, মিলিটারি সহ আরও নানান ক্ষেত্রে কুকুরের এই বিশেষ ক্ষমতা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়।
তবে একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে, তাদের আরও একটি লুকানো সংবেদনশীল প্রতিভা আছে। এই বোধশক্তির জন্য তারা অপরিচিত অঞ্চলে শর্টকাট রাস্তা খুঁজে বের করতে পারে, আর এজন্য তারা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রটি ব্যবহার করে।
ঠিক কীভাবে তারা এটি করে তা এখনও অবধি অস্পষ্ট। তবে সত্যিই কুকুরের মধ্যে এই ইন্দ্রিয়টি উপস্থিত রয়েছে যা ম্যাগনেটো রিসেপশন নামে পরিচিত, ঠিক যেমনটি পরিযায়ী পাখি, সালামান্ডার, ইঁদুর, গলদা চিংড়ি এবং ব্যাঙ সহ অন্যান্য অনেক প্রাণির মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ এই প্রাণিগুলো নিজেদের চলাচলের জন্য পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সহায়তা নেয়।
কুকুরের লুকানো এই প্রতিভা দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করেছিলেন কিন্তু বাস্তবে কখনও এর পরীক্ষা করা হয়নি। ইতিমধ্যে এমন অনেক ইঙ্গিত বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল যে কুকুরগুলি অন্যান্য অনেক প্রাণির মত পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রটি বুঝতে পারে।
২০১৩ সালে, প্রাগের চেক ইউনিভার্সিটি অফ লাইফ সায়েন্সেস এর সেন্সরি ইকোলজি বিশেষজ্ঞ হাইনেক বুরদা, যিনি ৩ দশক ধরে ম্যাগনেটো রিসেপশন নিয়ে কাজ করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে কুকুরেরা প্রস্রাব বা মলত্যাগের সময় নিজেকে চৌম্বকীয় মেরুর উত্তর-দক্ষিণ বরাবর ঝুঁকে রাখে, এতে বোঝা যায় যে তারা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রটি অনুধাবন করতে সক্ষম।
কুকুরের দুর্দান্ত নেভিগেশনাল প্রতিভা রয়েছে তা নতুন কিছু নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ও সংবেদনশীল কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কুকুরের ব্যবহার হতো যাদের “মেসেঞ্জার কুকুর” বলা হতো। এছাড়াও, শিকারি কুকুরেরা তাদের মালিকদের কাছে ফিরে আসার দক্ষতা দীর্ঘকাল ধরে প্রদর্শন করেছে। এর জন্য মূলত তারা ঘ্রাণ নেওয়ার পাশাপাশি ভিজ্যুয়াল পাইলটিং ব্যবহার করে, অর্থাৎ যাত্রাপথে কিছু ল্যান্ডমার্ক চিহ্নিত করে পরবর্তীতে সেই ল্যান্ডমার্ক ধরে ধরে মালিকের কাছে ফিরে আসে। কিন্তু পূর্ববর্তী অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ফিরতি পথে তারা তাদের যাওয়ার পথ ব্যবহার করার বিপরীতে প্রায়শই নতুন ফিরতি পথ তৈরি করে। তারা কীভাবে এটি করে তা কিছুটা রহস্যজনক ছিল।
পরবর্তীতে বুরদার স্নাতক শিক্ষার্থী ক্যাথরিনা বেনেডিক্টোভা এই গবেষণায় নতুন মোড় নিয়ে আসেন। তিনি প্রথমে চারটি কুকুরের উপরে ভিডিও ক্যামেরা এবং জিপিএস ট্র্যাকার লাগিয়ে বনে নিয়ে যান। কুকুরগুলিকে গড়ে ৪০০ মিটার দূরে একটি প্রাণির ঘ্রাণ তাড়া করার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। কুকুরগুলি তাদের মালিকের কাছে ফেরত আসার পর বেনেডিক্টোভা জিপিএস ট্র্যাক বিশ্লেষণ করে দুই ধরণের আচরণ দেখেছিলেন (নীচে মানচিত্র দেখুন)। একটি হলো ট্র্যাকিং, যেখানে কুকুর তার নিজের ঘ্রাণ অনুসরণ করে সেই পথেই ব্যাকট্র্যাকিং করে ফিরে আসে। অপরটি হলো স্কাউটিং যেখানে কুকুরটি কোন ব্যাকট্র্যাকিং ছাড়াই পুরোপুরি নতুন রুট দিয়ে ফিরে আসে।
বেনেডিক্টোভা যখন তাঁর পিএইচডি উপদেষ্টা বুরদার কাছে এই ডেটা দেখিয়েছিলেন, তখন তিনি একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছেন; একটি স্কাউটিং দৌড়ের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ফিরতি পথ ধরার আগ মুহূর্তে কুকুরটি থামতো এবং উত্তর-দক্ষিণ অক্ষ বরাবর প্রায় ২০ মিটার দৌড়াতো। এই সংক্ষিপ্ত দৌড়গুলি পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে হয়েছিলো, তবে বেনেডিক্টোভার কাছে নিশ্চিত হওয়ার মতো পর্যাপ্ত ডেটা ছিল না। তাই বেনেডিক্টোভা এবং বুরদা একটি প্রকল্প হাতে নেন যাতে ২৭ টি কুকুরকে নিয়ে পরবর্তী ৩ বছরের মধ্যে কয়েকশো ভ্রমণের আয়োজন করেন।
কুকুরগুলিকে সাধারণত এমন লোকালয়ে নিয়ে যাওয়া হত যার সাথে তাদের কোনও পরিচয় ছিল না। গবেষকরা কোন প্রকার ন্যাভিগেশনাল ক্লু না দিয়ে তাদের ছাড়তো যাতে করে কুকুরগুলি কোন পরিচিত ল্যান্ডমার্ক কিংবা ঘ্রাণ এর উপর নির্ভর না করতে পারে। এভাবে গবেষকরা ২২৩ টি স্কাউটিং রান ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, যেখানে কুকুরগুলি তাদের ফিরে আসার সময় গড়ে ১.১ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে ১৭০ টি দৌড়ে কুকুরগুলি ফিরে যাওয়ার আগে থামে এবং উত্তর-দক্ষিণ অক্ষের সাথে প্রায় ২০ মিটার দৌড়ায়।
রহস্যজনকভাবে, এই কুকুরগুলোই দ্রুততম এবং সর্বাধিক সংক্ষিপ্ত রুটে ফিরে আসে। এসব তথ্য পর্যবেক্ষণ করে নর্থ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটি, চ্যাপেল হিল এর জীববিজ্ঞানী ক্যাথরিন ল্যোম্যান বলেছেন, “আমি এই তথ্য দেখে সত্যিই বেশ অবাক হয়েছি।” বুরদা মনে করেন যে, কুকুরগুলি তাদের যাত্রাপথের কোন দিকে আছে তা নির্ধারণ করার জন্যই উত্তর-দক্ষিণ অক্ষ বরাবর ছুটে, আর এটিই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা।
এই গবেষণার বিষয়ে মন্তব্য করে, ইয়টভট লরান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুকুর-আচরণবিদ অ্যাডাম মিক্লাসি বলেছিলেন, “সমস্যাটি হচ্ছে কুকুরের চৌম্বক ক্ষেত্রের উপর সংবেদনশীলতা অথবা অন্য যেকোনো সংবেদনশীলতা শতভাগ প্রমাণ করার জন্য আপনাকে অন্য সকল সংবেদনশীল আচরণ বাদ দিতে হবে।”
এই অসুবিধার কথা চিন্তা করে বেনেডিক্টোভা এবং বুরদা তাদের অনুমানকে ভিন্ন দিক থেকে পরীক্ষা করার পরিকল্পনা করেছে। তারা কুকুরগুলোর কলারের সাথে চুম্বক বেঁধে পুনরায় পরীক্ষাগুলো করতে যাচ্ছেন, যাতে করে কুকুরের লোকাল ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর প্রতি সংবেদনশীলতা বিভ্রান্ত করা যায়। এরপর যদি কুকুরগুলো আর উত্তর-দক্ষিণ অক্ষ বরাবর না দৌড়ায় তবে পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের উপর তাদের নির্ভরতা আরও শক্তভাবে প্রমাণিত হবে।
মিক্লাসি বলেছেন যে, কুকুর চলাচল করার জন্য পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটি ব্যবহার করলে এটি আশ্চর্যজনক কিছু নয়। এটি একটি প্রাচীন দক্ষতা বলে মনে হচ্ছে, যাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই বরং এটি অন্য কোন স্তন্যপায়ী প্রাণির মধ্যেও থাকতে পারে যারা পায়ে হেঁটে বৃহৎ অঞ্চল পরিভ্রমণ করে।
সোহানুর রহমান/ নিজস্ব প্রতিবেদক