বিশ্বে সেরা কোম্পানিগুলোর তালিকায় শীর্ষে থাকা গুগল এর নাম শুনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগলের সাহায্য ছাড়া বোধহয় এখন আমাদের একটি স্বাভাবিক দিন কল্পনাও করা যায় না।
গুগল যে শুধু সার্চইঞ্জিন হিসেবেই পরিচিত, এমনটি নয়।টেক জায়ান্ট এই কোম্পানি অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্যও অনেক পরিচিত। তবে এসকল প্রযুক্তির সবগুলোই গুগলের নিজের নয়। ছোট-বড় অনেক কোম্পানি গুগলের প্যারেন্ট কোম্পানি “এলফাবেট” (Alphabet Inc) এর অধীনে রয়েছে।
এই কারণেই এসকল কোম্পানির সকল পণ্যের স্বত্বাধিকার “এলফাবেট” এবং ক্ষেত্র বিশেষে গুগল এর নামে থাকে। বলা বাহুল্য, এসব কোম্পানির প্রযুক্তিগুলো সেরা বলেই গুগলের মতো প্রতিষ্ঠান এদের মালিকানা কিনে নেয়।
তবে সম্প্রতি গুগল মাত্র ৮ বছর পুরোনো একটি চশমা তৈরির প্রতিষ্ঠানের মালিকানা কিনে নেয়, যার নাম আমাদের সিংহভাগেরই অজানা।
গত ৩০শে জুন, ২০২০ ইং তারিখে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কানাডার ওয়াটারলুর “নর্থ” নামের এই কোম্পানির মালিকানা কিনে নেয় গুগল। কোম্পানিটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত এর “ফোকাল স্মার্ট চশমা” ( Focals smart glasses) এর জন্য।
গুগল সর্বপ্রথম ২০১৪ সালের মে মাসে এর স্মার্ট চশমা “গুগল গ্লাস” রিলিজ করে। তবে এর জনপ্রিয়তা আশানুরূপ না হওয়ায়, পরবর্তীতে গুগল এর আধুনিকায়নের পিছনে আর গুরুত্ব দেয়নি।ঠিক এই কারণটিই “নর্থ” কোম্পানির মালিকানা কেনাকে প্রতিনিধিত্ব করে।
চলুন জেনে নেয়া যাক এই কোম্পানির পুরো ইতিহাসঃ
১। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলু থেকে মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রকৌশল সম্পন্ন করা ৩ প্রকৌশলী স্টিফেন লেক, ম্যাথিউ বেইলে এবং এরন গ্রান্ট ২০১২ সালে এ কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন। একটি আড্ডায় মানুষ এবং কম্পিউটারের মধ্যকার ইন্টার্যাকশন নিয়ে আলোচনা করার সময়ই তারা এই কোম্পানির শুরুর প্রথম চিন্তা করেন।
তবে তারা শুরুতে “থ্যালমিক ল্যাবস” নামে এ কোম্পানির যাত্রা শুরু করেন এবং গুগলের কাছে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত স্টিফেন লেক কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এর দায়িত্ব পালন করেন।
২। ২০১৩ সালে কানাডার এ কোম্পানিটি তাদের প্রথম পণ্য “মায়ো” (Myo) রিলিজ করে যা ছিলো মূলতঃ একটি ইশারা বা সংকেত নিয়ন্ত্রিত আর্মব্যান্ড বা হাতের ব্র্যাসলেট। এটি মূলতঃ ইলেক্ট্রোগ্রাফি দিয়ে তৈরি যার প্রধান ব্যবহার ছিলো চিকিৎসা খাতে। মাংসপেশির তড়িৎ স্পন্দন হিসাব ও রেকর্ডের কাজে এটি ব্যবহার করা হতো। মাত্র ১৯৯ ডলারের এ প্রযুক্তিটি সে বছর “টাইম ম্যাগাজিন” এর সেরা উদ্ভাবনের খেতাব অর্জন করে। ব্যাপক প্রশংসা পাওয়ার পরও, দুর্ভাগ্যবশত ২০১৮ সালে কোম্পানিটি “মায়ো” উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।
৩। ২০১৬ সালের মধ্যেই অ্যামাজন, ইন্টেল সহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১২ কোটি ডলার এর ফান্ডিং পায় ওয়াটারলুর এ কোম্পানিটি। এর বাহিরেও অ্যামাজন এই কোম্পানিতে ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে শুধু ভয়েস রেসপন্স প্রযুক্তির উপর। আর ততদিনে “থ্যালমিক ল্যাবস” এর অধীনে শতাধিক প্রকৌশলী কাজ করছিলো এবং কোম্পানিটি এর ওয়াটারলু এবং সদ্য খোলা সানফ্রান্সিসকোর অফিসে আরো প্রকৌশলী নেয়ার ব্যাপারে পরিকল্পনা করছিলো।
৪। ২০১৮ এর অক্টোবরে লেক এবং তার সহ-প্রতিষ্ঠাতারা তাদের তৈরি ফোকাল স্মার্ট চশমা এর কথা জানায়। ৯৯৯ ডলারের এই চশমা অ্যামাজন এর ভয়েস নির্ভর ভার্চুয়াল এসিস্টেন্স “এলেক্সা” এর সাহায্যে ম্যাসেজ রিসিভ করা ও পাঠানো ছাড়াও, তারিখ-সময় এবং আবহাওয়া দেখানো, উবার রাইড অর্ডার করতে পারতো।
এছাড়াও চশমাটির অন্যান্য বৈশিষ্ট্য এর মধ্যে ডান লেন্সের সাথে খচিত একটি পাতলা প্রজেক্টর ও একটি গোলাকার হলোগ্রাফিক ফিল্ম ছিলো অন্যতম। প্রজেক্টর বিমটি হলোগ্রাফিক ফিল্মকে আঘাত করলে এটি চোখের রেটিনাতে বাউন্স করতো যেখানে প্রতিচ্ছবি প্রদর্শিত হয়। “নর্থ”-ই প্রথম কোম্পানি যারা এ প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করে। ফোকাল স্মার্ট চশমাটি কোম্পানির নিজের তৈরিকৃত সফটওয়্যারের সাহায্যে চলতো যা গুগলের এন্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত হতো।
৫। লেক এবং তার দলের এই চশমাটি তৈরি করতে চার বছর লেগেছিলো যা পরবর্তীতে আমেরিকায় অনেক বেশি সমাদৃত হয়। একটি ইন্টারভিউতে লেক বলেন, ”আমি শুধু একটি স্মার্ট চশমা তৈরির স্বপ্ন দেখেছি যা মানুষ নিজে থেকে পরতে চাইবে। আমি এটিকে একটি প্রযুক্তি পরে, আগে একটি সাধারণ চশমা হিসেবেই দেখি“।
৬। “ফোকাল স্মার্ট চশমা” বাজারে আনা ছিলো কোম্পানির দুটি নিজস্ব ফ্ল্যাগশিপ স্টোর খোলার জন্য পূর্বপরিকল্পনা যার একটি টরোন্টোতে আর অন্যটি নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে। তাছাড়াও ছোট ছোট কিছু পপ-আপ স্টোরও এ পরিকল্পনার আওতায় ছিলো।
৭। ফোকাল বাজারজাত করার সাথে সাথেই লেক এবং বাকি সহ-প্রতিষ্ঠাতারা সিদ্ধান্ত নেন কোম্পানির পুনর্নামকরণের। মজার ব্যাপার হলো, তারা কোম্পানির নাম “নর্থ” ঠিক করেন কারণ কোম্পানির হেডকোয়ার্টার বা মূল অফিস ছিলো কানাডার ওয়াটারলুতে যা কানাডার বিখ্যাত সিলিকন ভ্যালির উত্তরপার্শ্ব [North] ।
৮। স্টিফেন লেক কখনই “গুগল গ্লাস” এত বেশি পছন্দ করেননি। এমনকি ২০১৮ তে এক ইন্টারভিউতে তিনি বলেন, ”ফোকাল হলো একজোড়া নিত্যদিনের স্মার্ট কাঁচ যা নকশাই করা হয়েছে মূলত চোখের চশমার দৃষ্টিকোণ থেকে। আমরা এটাকে পূর্বের স্মার্ট চশমার মতো তৈরি করতে চাইনি যেখানে আপনার মুখে একটি আস্ত কম্পিউটার বসিয়ে দেয়া হবে।
৯। কানাডিয়ান এই কোম্পানিটি ২০১৮ সালে সবাইকে বিস্মিত করে দেয় যখন এটি ইন্টেল এর মতো কোম্পানির তৈরি “ভন্ট স্মার্ট গ্লাস” ( Vaunt smart glasses) এর স্বত্বাধিকার কিনে নেয়। সে বছরই ইন্টেল তাদের এই “ভন্ট গ্লাস” এর ডেভেলপমেন্ট বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলো। যদিও এই চুক্তিটি কখনই খোলাসা করা হয়নি, কিন্তু স্টিফেনের মতে এই চুক্তিটিতে ২৩০ টিরও বেশি স্বত্বাধিকারের চুক্তি যুক্ত ছিলো, যার কারণে “নর্থ” এর মোট পেটেন্ট সংখ্যা বা স্বত্বাধিকার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫০ টিরও অধিক।
১০। যদিও “ফোকাল স্মার্ট গ্লাস” সবার কাছে অনেক বেশি সমাদর লাভ করে, ”নর্থ” কখনোই এর থেকে খুব বেশি টাকা অর্জন করতে পারেনি। বরং ২০১৯ এ ফোকাল এর রপ্তানির শুরু থেকেই “নর্থ” কে লড়াই করতে হয়। ফোকাল এর রপ্তানির কয়েক সপ্তাহ পরেই কোম্পানিটি যখন তার ১৫০জন সহকর্মীকে ছাটাই করতে বাধ্য হয়, কানাডা সরকার তখন কোম্পানির ওপর ১কোটি ৮০ লক্ষ ডলার বিনিয়োগ করে। এ সময় কোম্পানিকে ফোকালের দাম ৯৯৯ ডলার থেকে ৬০০ ডলারে (প্রেস্ক্রিপশন সহ) নামাতে হয় কারণ রপ্তানির পর দেখা গেছে, কোম্পানির তাদের এই প্রযুক্তির উপর অনেক বেশি আশা করেছিলো যা আসলে ওই সময়ের সাথে ম্যাচই করে নি।
“ফোকালস ২.০” (Focals 2.0) এর মুক্তির জন্য “নর্থ” ২০২০ কে ইশারা করে। কিন্তু যেহেতু এখন গুগল কোম্পানিটির স্বত্বাধিকার কিনে নিয়েছে, তাই “ফোকালস ২.০” এর বানিজ্যিক মুক্তি আর কোম্পানিটির হাতে নেই। একটি ব্লগে গুগলের “ডিভাইস এন্ড সার্ভিসেস” এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, রিক ওস্টেরলোহ জানান, “‘নর্থ’ টিম গুগলের কানাডার “কিচেনার-ওয়াটারলু” টিমে জয়েন করবে যেখানে কোম্পানিটি যাত্রা শুরু করে“।
তন্ময় দাস/ নিজস্ব প্রতিবেদক