সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এমন এক আচরণ, যার সাথে সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এখন পরিচিত। বিশ্বব্যাপী মহামারী সৃষ্টিকারী করোনা ভাইরাসের বিস্তার কমিয়ে দেওয়ার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসাবে সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
তবে, আমরা এই অভ্যাসটি শুরু করার অনেক আগে থেকেই কিছু গাছ একে অপরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বেড়ে উঠতো। সাধারনত, বনের মধ্যে যখন একাধিক গাছ পাশাপাশি বেড়ে উঠে, তখন তাদের মধ্যে ফাঁক দেখা যায়। তবে প্রতিবেশী গাছগুলি সাধারণত এই স্থানগুলিতে দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং শূন্যস্থান পূরণ করে। কিন্তু, কিছু বনাঞ্চলে গাছের চূড়াগুলো অনুসন্ধান করে দেখা যায়, মাথার উপরে গাছের বাইরের শাখাগুলির মধ্যে সুস্পষ্ট চ্যানেলের মতো ফাঁকা স্থান রয়েছে। দেখে মনে হবে যেন গাছগুলো নিজেদের সীমানা নির্দিষ্ট করে রেখেছে। গাছগুলির চারদিকে এই দূরত্ব বজায় রাখা “Crown Shyness বা মুকুট লাজুকতা” হিসেবে পরিচিত। বিজ্ঞানীরা ১৯২০ সাল থেকে এই ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা করছেন এবং কেন এটি হয় তার একাধিক সম্ভাব্য কারণের প্রস্তাব দিয়েছেন।
গাছের চূড়ার এই লাজুকতা সমস্ত গাছের মধ্যে দেখা যায় না। এটি কেবল কালো ম্যানগ্রোভ (Avicennia germinans), লজপোল পাইন (Pinus contorta), জাপানি লার্চ (Larix kaempferi), কিছু প্রজাতির ইউক্যালিপ্টাস এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে দেখা গিয়েছে। সাধারণত এটি একই প্রজাতির গাছের মধ্যে দেখা যায়, তবে এটি ভিন্ন প্রজাতির গাছের মধ্যেও দেখা যেতে পারে, যেমন; স্পাইনি হ্যাকবেরি (Celtis spinosa) এবং অ্যামবেরয় (Pterocymbium beccarii) গাছের মধ্যে।
কিছু বিজ্ঞানী প্রস্তাব করেছেন যে, বাতাসের জন্য একই উচ্চতার গাছের চূড়াগুলোর মধ্যে ঘর্ষণ সৃষ্টির ফলে এই শূন্যস্থানটি তৈরি হতে পারে। প্রতিবেশী গাছের ডাল, পাতা এবং কুঁড়ি একে অপরের সাথে ঘর্ষণ এর ফলে ক্ষত এবং ভাঙ্গন সৃষ্টি করে। ১৯৫৫ সালে, উত্তর-পূর্ব অস্ট্রেলিয়াতে ইউক্যালিপটাস গাছের উপর করা এক গবেষণায় উঠে আসে যে, তীব্র বাতাসের ফলে সৃষ্ট ঘর্ষণ প্রায়শই গাছের মধ্যে ক্ষত সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটি বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস করিয়ে দেয় যে, ক্ষত সৃষ্টির ফলে গাছের সংবেদনশীল বর্ধনশীল কুঁড়ি মারা যায় এবং ফলস্বরূপ গাছের মধ্যে শূন্যস্থানটি তৈরি হয়।
এরপরে, ১৯৮৪ সালে, কালো ম্যানগ্রোভ গাছ অধ্যুষিত কোস্টা রিকার একটি অঞ্চল নিয়ে গবেষণা প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞানীরা এলোমেলোভাবে একই উচ্চতার ২২ জোড়া গাছ বাছাই করেছিলেন এবং স্থির অবস্থার পাশাপাশি বাতাসের ঝাপটায় তাদের চূড়াগুলো দোলার সময় তাদের মধ্যে দূরত্ব পরিমাপ করেছিলেন। তারা দেখেছিলেন যে, শান্ত পরিস্থিতিতে শাখাগুলো নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখে কিন্তু বাতাস এর মধ্যে শাখাগুলো প্রায়শই একে অপরকে স্পর্শ করে এবং ক্ষত সৃষ্টি করে।
বাতাস কি গাছের এই মুকুট লাজুকতার একমাত্র কারণ?
ঘর্ষণ যদি মুকুট লাজুকতার প্রাথমিক কারণ হয়, তবে আপনি সংরক্ষিত স্থানে বেড়ে ওঠা গাছের তুলনায় অধিক বাতাসযুক্ত স্থানের গাছগুলির মধ্যে এটি আরও বেশি স্পষ্ট হবে বলে আশা করবেন। তবে কোস্টা রিকার মন্টেভার্ড ক্লাউড ফরেস্ট রিজার্ভের গাছ নিয়ে গবেষণা করার সময় বিজ্ঞানীদের এরকম কিছু মনে হয়নি। এই বনটি প্রায়শই উচ্চ গতির বাতাসের কবলে পড়ে, শীতকালেও কয়েকটি স্থানে নিয়মিত প্রতি ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে বাতাস অতিক্রম করে। তবে, সংরক্ষিত স্থানের তুলনায় অধিক বাতাসযুক্ত অঞ্চলের গাছের মুকুট লাজুকতায় খুব সামান্যই পার্থক্য পাওয়া যায়। যদিও ঘর্ষণ কিছু ক্ষেত্রে মুকুট লাজুকতার কারণ, তবে এটিই একমাত্র কারন নাও হতে পারে।
মলয় কর্পূর গাছের (Dryobalanops aromatica) মুকুট লাজুকতার গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাতাসের জন্য শাখা-প্রশাখার সরাসরি ক্ষয় হওয়ার কোনও প্রমাণ নেই। এই প্রজাতির গাছের উপর গবেষণারত বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, এই গাছের বর্ধনশীল কুঁড়ি আলোক সংবেদনশীল হওয়ার কারনে প্রতিবেশী গাছের কাছাকাছি পৌঁছালেই বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা যায় যে, এই প্রজাতির গাছপালা দূর-লাল (Far-Red) আলো নামক দৃশ্যমান আলোর একটি ফ্রিকোয়েন্সি শনাক্ত করতে পারে, যা তার প্রতিবেশীদের কতটা কাছাকাছি আছে তার ধারণা দিতে পারে।
মুকুট লাজুকতার উপকারিতা
প্রাণিদের মতো গাছপালাও বেঁচে থাকার জন্য পুষ্টি, জল, মাটি এবং আলো সহ অন্যান্য বেঁচে থাকার উপকরণ এর জন্য প্রতিযোগিতা করে। ঘন ডালপালা যুক্ত বনাঞ্চলগুলিতে আলোর জন্য উদ্ভিদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, মুকুট লাজুকতার ফলে সৃষ্ট ফাঁকগুলি গাছগুলিকে আলোর সাথে তাদের যোগাযোগ বাড়িয়ে তুলতে এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াটিকে অধিক অনুকূল করতে সাহায্য করে।
বিজ্ঞানীরা এখনও গাছের এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে বিতর্ক করছেন, তবে এর আরও কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে বলে কিছু ইঙ্গিতও দিয়েছেন। গাছের চূড়ার এই ফাঁকাস্থানগুলো বনের মেঝেতে আলো পৌঁছতে দেয়, যা অন্যান্য উপকারী গাছপালা এবং প্রাণীদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। এছাড়াও, ডালগুলি দূরত্ব বজায় রাখার কারণে তাদের প্রতিবেশীদের শারীরিকভাবে স্পর্শ করে না। ফলে গাছগুলি ক্ষতিকারক পাতাখেকো পোকামাকড়ের বিস্তারকে সীমাবদ্ধ করতে পারে এবং গাছ থেকে গাছে ক্ষতিকারক রোগের সংক্রমণও সীমাবদ্ধ করতে পারে।
সোহানুর রহমান/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, বোরড পান্ডা, ন্যাশনাল হিস্টোরি মিউজিয়াম