গর্ভাবস্থা মেয়েদের জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। এমন অবস্থায় মুড সুইং, হরমোনাল পরিবর্তন এবং খাদ্যাভাসের পরিবর্তনসহ দেহে অনেক পরিবর্তন আসে। খাবারের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনকে ডাইজেসিয়া (dysgeusia) বলা হয়। এই পর্যায়ে মহিলারা লেবু, আচার এবং তেঁতুল অর্থাৎ টক জাতীয় খাবার খাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে। এমনটা বেশি ঘটে প্রথম তিন মাস সময়ে। অন্যদিকে অধিকাংশ লোক মনে করেন যে, এ সময়ে তেঁতুল খাওয়া গর্ভপাতের ঘটনার মতো বিপজ্জনক হতে পারে, বিষয়টা কি সত্য?
উত্তর হলোঃ না, বরং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, পরিমিত পরিমাণে তেঁতুল খাওয়া মা এবং ভ্রূণ উভয়েরই জন্যই ভাল। বিষয়টি স্পষ্ট করতে বিস্তারিত আলোচনা করছি।
গর্ভাবস্থায় তেঁতুল কেন খাবেন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, তেঁতুল পুষ্টির এক সমৃদ্ধ উৎস যা মা এবং অনাগত শিশুর উভয়ের জন্যও স্বাস্থ্যকর। এটি ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলিতে সমৃদ্ধ যা কেবল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে না বরং এর ট্যানজি এবং মিষ্টি স্বাদের কারণে গর্ভাবস্থায় নারীদের রোগা (অতিরিক্ত চর্বিহীন) থাকতেও সহায়তা করে।
অকাল জন্মের ঝুঁকি কমায়
আয়রনের সমৃদ্ধ উৎস হিসাবে তেঁতুল শরীরে রক্তের বর্ধিত পরিমাণকে ভারসাম্য রাখে, যা অকাল জন্মের সম্ভাবনাকে আরও কমিয়ে দেয় এবং শিশুর কম ওজনের জন্মানোর সম্ভাবনাকেও হ্রাস করে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে
তেঁতুলের মধ্যে উপস্থিত পটাসিয়াম উপাদানগুলি গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপে ভোগা মহিলাদের মধ্যে রক্তচাপের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
সকালের অসুস্থতার বিরুদ্ধে কার্যকর
গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসের সময় তেঁতুল গ্রহণ করা সকালের অসুস্থতা যেমন বমি বমি ভাব, বমি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। তেঁতুলের লাক্সাটিভ (laxative) প্রভাব, এ জাতীয় লক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এ অবস্থায় তেঁতুলের সাথে কিছুটা লবণ দিয়ে চুষে খাওয়া গর্ভবতী মহিলাকে আরও ভাল অনুভব করাতে সহায়তা করে।
আপনি শরবত বানিয়ে তেঁতুল পান করতে পারেন। এছাড়াও তেঁতুল আপনার তরকারীতে মিশিয়ে বা এমনকি সতেজ পানীয়ের জন্য লেমনেডে যোগ করেও পান করতে পারেন।
ভ্রূণের বিকাশে সহায়তা করে
তেঁতুল নায়াসিন (নিকোটিনামাইড) বা ভিটামিন বি ৩, ৪ সমৃদ্ধ যা গর্ভবতী মহিলার প্রতিদিনের পুষ্টি প্রয়োজনীয়তার প্রায় ১০% পূরণ করে যা ভ্রূণের স্নায়ু, মস্তিষ্ক, পাচনতন্ত্রের বিকাশে সহায়তা করে।
এছাড়াও গর্ভাবস্থায় পরিমিত পরিমাণ তেঁতুল খাওয়ার অসংখ্য উপকারিতা রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি হলঃ
- তেঁতুলের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য যা গর্ভাবস্থার পরবর্তী পর্যায়ে গোড়ালির চারপাশে ফোলাভাব এবং পেশীর ব্যথা কমাতে সহায়তা করে।
- তেঁতুল ফ্ল্যাভোনয়েড এবং পলিফেনল সমৃদ্ধ, যা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- তেঁতুলে পটাসিয়াম এবং হালকা সোডিয়াম থাকার কারণে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সামান্য ভূমিকা রাখে।
- মিষ্টি তেঁতুল এর লাক্সাটিভ (laxative) বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যায় সহায়তা করতে পারে।
- তেঁতুল পরিমিত পরিমাণে খাওয়া হলে হজমের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য দুর্দান্ত; এটি মলের প্রবাহকে ঘন করতে সহায়তা করে, একইভাবে ডায়রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতেও সহায়তা করে ।
- তেঁতুলের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টগুলি কয়েকটি ধরণের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে বলে বিশ্বাস করা হয়।
গর্ভবস্থায় তেঁতুল খাওয়ার ঝুঁকিঃ
অনেক উপকারিতার সাথে তেঁতুল খাওয়ার কিছু ঝুঁকিও রয়েছে, যখন তা অনিয়ন্ত্রিত পরিমাণে খাওয়া হয়। কিছু ঝুঁকিঃ
- তেঁতুল দেহের আইবুপ্রোফেন (ibuprofen) শোষণ করার ক্ষমতা বাড়ায়, এটি তৃতীয় ত্রৈমাসিকের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ এই সময়ের মধ্যে আইবুপ্রোফেন শিশুর হার্ট প্যাসেজ স্থায়ীভাবে বন্ধের কারণ হতে পারে। তাই তেঁতুল এবং আইবুপ্রোফেন গ্রহণ একত্রিত করবেন না।
- তেঁতুলে ভিটামিন সি থাকে, আর অতিরিক্ত পরিমাণে ভিটামিন সি গ্রহণ গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই আপনি অবশ্যই তেঁতুল খাবেন; কিন্তু অতিরিক্ত নয়, তাহলে হিতে-বিপরীত হবার সম্ভাবনা থাকে।
- আইবুপ্রোফেন শোষণ করার ক্ষমতার অনুরূপ, তেঁতুল অ্যাসপিরিনের অত্যধিক শোষণের ঝুঁকি বাড়ায়। এটি ব্লাড টিনার হিসাবে কাজ করে, ফলে আপনার শিশুর যথাযথ পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে না। পাশাপাশি এটি আপনার শিশুর জন্য অনিয়মিত রক্ত প্রবাহ তৈরি করতে পারে।
- অতিরিক্ত তেঁতুল খাওয়ার ফলে আপনার রক্তে শর্করার ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে।
- বেশি পরিমাণে তেঁতুল খাওয়া আপনার রক্তচাপকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
- যদি আপনার গর্ভাবস্থায় ফ্লুরোসিস হয় তবে কাঁচা, অবিভক্ত(undiluted) তেঁতুল ভ্রূণের ক্ষতি করতে পারে।
কিছু পরামর্শঃ
তেঁতুল নিঃসন্দেহে গর্ভাবস্থায় অনেক উপকারী। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া নিরাপদ নয়। নিরাপদে খেতে চাইলে, কয়েকবার তবে অল্প অল্প করে খেতে পারেন।
আপনাকে গর্ভাবস্থায় যদি নিয়মিত তেঁতুল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, আপনি নিয়মিত রক্তে শর্করার এবং রক্তচাপের মাত্রা চেক করুন। যদি আপনি সুস্থ বোধ না করেন তবে এটি খাওয়া বন্ধ করুন এবং অবিলম্বে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। এই পরিস্থিতিতে, চিকিৎসক পুষ্টি মেটাতে আপনাকে তেঁতুলের বিকল্প হিসেবে ক্যাপসুল বা পরিপূরক দিতে পারে। বেশি কাঁচা তেঁতুল না খাওয়ার চেষ্টা করুন।
গর্ভাবস্থায় তেঁতুলের ঝুঁকি এবং উপকারগুলি পাওয়া আপনি কী পরিমাণ তেঁতুল গ্রহণ করছেন এবং তা কীভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে। তাই আপনি কী পরিমাণ তেঁতুল গ্রহণ করতে পারবেন, পাশাপাশি তেঁতুল খেলে আপনার কোন ওষুধ এড়িয়ে চলতে হবে, এসব বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ায় উত্তম।
তানজিনা সুলতানা শাহীন/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ টাইমস অফ ইন্ডিয়া, parenting.firstcry.