বিজ্ঞানীরা জৈব প্রকৌশল প্রক্রিয়ায় গবেষণাগারে মানব ত্বকের কোষ থেকে ক্ষুদ্র লিভার তৈরি করে সেই লিভার ইঁদুরের দেহে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪০,০০০ এরও বেশি মানুষের জীবন যায় লিভারের অকার্যকরীতার জন্য। ইঁদুর এর দেহে সফলভাবে মানব কোষ থেকে তৈরি লিভার প্রতিস্থাপনের এই প্রক্রিয়ার সাহায্যে হাজার হাজার মানুষের জীবন রক্ষা করা যেতে পারে। একই সাথে ভবিষ্যৎ এ এটি লিভার অকার্যকরীতার জন্য সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা পদ্ধতি হতে পারে।
কৌশলটি সরাসরি মানব রোগীদের উপর রপ্ত করার আগে আরো অনেক গবেষণা করার দরকার আছে। যদিও গবেষকরা বলেছেন যে তাদের ধারণা এই আবিষ্কারটি যকৃত প্রতিস্থাপনের বিকল্প হতে পারে। কারণ বর্তমানে লিভার ডোনার এর সহায়তায় যকৃত প্রতিস্থাপন করা হয় যা অনেক ব্যয়বহুল পদ্ধতি এবং এর জন্য অনেকটাই ডোনার এর উপর নির্ভর করতে হয়। আর এর একটি ইতিবাচক দিক হল রোগীদের অকার্যকর লিভারগুলো প্রতিস্থাপন করে তাদেরকে নতুন জীবন দেওয়া।
পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় এর প্যাথলজিস্ট আলেজান্দ্রো সোটো এর ভাষ্যমতে, “এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষা এবং এই পরীক্ষায় সফল হলে আমাদের আর লিভার ডোনারদের উপর নির্ভর করতে হবেনা। এটি হবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য প্রতিস্থাপনের সেতু। উদাহরণস্বরূপ, সম্পূর্ণ লিভার ব্যর্থ হয়ে গেলে আপনার হয়তো পুরো নতুন লিভারের পরিবর্তে কেবলমাত্র কিছু সময়ের জন্য হেপটিক বুস্ট প্রয়োজন হবে। আমি বিশ্বাস করি এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কারণ আমরা জানি যে এটি সফল করা সম্ভব। এর সাহায্যে আপনি ত্বকের একটি মাত্র কোষ থেকে একটি সম্পূর্ণ অঙ্গ তৈরি করতে পারবেন, যা একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার।”
এই ক্ষুদ্র লিভারগুলো তৈরির জন্য গবেষকরা মানব স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে ত্বক সংগ্রহ করেন। এবং সেই ত্বকের কোষগুলোকে তারা স্টেম কোষ অবস্থায় ফিরিয়ে নেন, যা প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল নামে পরিচিত। এই স্টেম কোষ থেকে সহজেই অন্যান্য ধরণের কোষের উদ্ভাবন করা যায়। তারপর গবেষকরা হরমোন এবং অন্যান্য রাসায়নিকের সাহায্যে স্টেম কোষগুলিকে লিভারের কোষে পরিণত করার চেষ্টা করেন এবং পরীক্ষাগারে সেগুলোকে কালচার করেন।
সাধারণত কোন মানুষ জন্মের পর থেকে তার লিভার পরিণত হতে প্রায় দুই বছর সময় লাগে। তবে গবেষকরা কেবলমাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে স্টেম কোষ থেকে ক্ষুদ্র লিভারগুলো বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। পাঁচটি ইঁদুরের দেহে এই ক্ষুদ্র যকৃতগুলো প্রতিস্থাপন করে দেখা যায় যে তারা যথাযথভাবে কাজ করছে। চার দিন পরে পরীক্ষা করে জানা যায় যে জৈব প্রকৌশল এর মাধ্যমে তৈরি লিভারগুলো থেকে ইঁদুরের দেহে পিত্তরস এবং ইউরিয়া ক্ষরণ হয়েছে। প্রাণীগুলোর দেহে মানব লিভারের প্রোটিনগুলি দেখে বুঝা যায় যে স্টেম কোষ থেকে তৈরি লিভারগুলো কাজ করেছে।
পূর্বের লিভার গ্রাফ্ট পরীক্ষাগুলোতে গবেষকরা রডেন্ট কোষগুলিকে স্ক্যাফোল্ডের সাথে সংযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু এবার গবেষকরা মানব স্টেম কোষ থেকে যকৃতের কার্যকরী টিস্যু, তার ভাস্কুলার সিস্টেম, পিত্ত নালী তৈরি করে স্ক্যাফোল্ডের সাথে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে প্রতিস্থাপনগুলো যে নিখুঁতভাবে কাজ করেছে তাও নয়। গ্রফের ভিতর থ্রোম্বোসিস এবং ইস্কেমিয়া ছাড়াও স্বল্প রক্ত প্রবাহ দেখে বুঝা যায় যে গ্রাফটগুলোকে কোনও প্রাণীর ভাস্কুলার নেটওয়ার্কের সাথে সঠিকভাবে সংযোগ করার ক্ষেত্রে এখনও আরো উন্নতি প্রয়োজন।
আরও পড়ুনঃ ১। সর্বকালের সবচেয়ে ছোট ডাইনোসরটি ছিল একটি পাখি- গবেষকদের দাবি ২। মানব সংবেদনশীলতার কারণ: জিন নাকি পরিবেশ ৩। সুর বা ছন্দ শিশুদের মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতা ও যোগাযোগ ক্ষমতা বাড়ায় |
গবেষকদের মতে, সম্ভবত আরো এক দশক লাগতে পারে এই চিকিৎসাটিকে মানব রোগীদের জন্য ব্যবহার করতে। যদিও এটি নির্ভর করে ভবিষ্যতের বিভিন্ন পরীক্ষাগুলি সফল হওয়ার উপর। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে এই ধরণের অঙ্গ প্রতিস্থাপন মানুষের জন্য নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত করা।
যাইহোক, এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। অল্প সময়ের জন্য হলেও পাঁচটি ইঁদুর মানব লিভার নিয়ে জীবিত ছিলো। এমন ফলাফল এর আগে কখনো দেখা যায়নি। আবিষ্কৃত এই কৌশলটি আমাদের মানব রোগীদের সুবিধার্থে ব্যবহার করে লিভার প্রতিস্থাপন করায় আরো এক ধাপ কাছে নিয়ে এসেছে।
ইতিমধ্যে একই পরীক্ষাগারে এই ধরনের ক্ষুদ্র অঙ্গ ব্যবহার করে সিমুলেটেড রোগ ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহার এর জন্য গবেষণা করা হচ্ছে।
নিশাত তাসনিম/ নিজস্ব প্রতিবেদক