এই তুই এতো মোটা কেন? এই তুই এতো পাতলা কেন? কথাগুলো আমরা মজা করেই আমাদের বন্ধুদের বলে থাকি। কিন্তু সবাই তা মজা হিসেবে নেয় না। এসব ঘটনা অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা এর মতো মারাত্মক মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরী করে দেয়, অতিরিক্ত অনীহা সৃষ্টি হয় খাবার এর প্রতি।
যখন মানুষগুলো একা থাকে, তখন তারা ভাবে ইসস আমি যদি একটু মোটা বা পাতলা হতে পারতাম! ফলস্বরূপ তারা নিজেদের পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। কিন্তু এ চেষ্টাতে সবাই ভালো ফল পায় না। কেউ মানসিক, কেউ শারীরিক বিভিন্ন রোগে জড়িয়ে যায়, এমনকি কারো কারো শেষ পরিণতি হিসেবে মৃত্যুও হয়।
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা হলো একটি ভয়ানক মানসিক ব্যাধী। এ রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা ক্ষুধার্ত থাকা সত্ত্বেও খাবার গ্রহন করতে চান না। তাদের ওজন বৃদ্ধির প্রতি এতো বেশি ভয় থাকে যে, তারা অনেক বেশি পাতলা হয়েও নিজেদের মোটা মনে করে। খাবারের প্রতি অনীহা তৈরী হয় এবন তারা ওজন কমাতে অতিরিক্ত ব্যায়াম করে, খাবার গ্রহণের মাত্রা কঠোরভাবে কমিয়ে দেয়। শরীরের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে ১৫% কমে গেলে এই রোগে আক্রান্ত বলে ধরা হয়। এ রোগে আক্রান্তের হার ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি, কিন্তু এখন ছেলেদের হারও বাড়ছে। তবে ৪০ এর উপরে বয়সীদের মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার খুবই কম। এখন কথা হচ্ছে, আপনি কেমনে বুঝবেন যে আপনি অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসায় আক্রান্ত?
আচরণগত পরিবর্তন
১. ডায়েটিং এর মাধ্যমে কঠোরভাবে খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
২. অতিরিক্ত ব্যায়াম করা।
৩. খাদ্য গ্রহণের পর ইচ্ছেকৃতভাবে বমি করা।
৪. দুপুরে বা রাতের খাবার ইচ্ছে করে মিস করা। খাবারের প্রতি অনীহা এবং বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে খাবার না খাওয়া।
৫. খাবার চিবিয়ে ফেলে দেওয়া। পাবলিক প্লেসে খাবার গ্রহণে অনীহা।
৬. বার বার ওজন পরিমাপ করা এবং ওজন বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত ভয়ে থাকা।
৭. কতটুকু খাবার গ্রহণ করলো তা নিয়ে মিথ্যা বলা।
৮. খিটখিটে ভাব।
৯. বার বার নিজেকে আয়নায় দেখা।
১০. যৌনতার প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া।
১১. নির্দিষ্ট কয়েক ধরনের খাবার গ্রহণে সীমাবদ্ধ থাকা।
শারীরিক লক্ষণ
১. অতিরিক্ত ওজন কমে যাওয়া বা প্রত্যাশিত ওজন না বাড়া।
২. রোগা চেহারা।
৩. অনিদ্রা।
৪. মাথা ঘোরা,অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
৫. চুল পাতলা, ভেঙ্গে যায় এবং পড়ে যাওয়া।
৬. মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া।
৭. কোষ্ঠকাঠিন্য এবং পেটে ব্যথা।
৮. শুষ্ক বা হলুদ ত্বক।
৯. অনিয়মিত হৃদ স্পন্দন, নিম্ন রক্তচাপ।
১০. পানিশূন্যতা, হাত বা পা ফুলে যাওয়া ইত্যাদি।
আরেকটা প্রশ্ন থেকে যায় আমাদের কেন অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা হয় অর্থাৎ কেন আমাদের খাবারে অনীহা এবং ওজন বৃদ্ধির ভয় সৃষ্টি হয়। ঠিক কি কারণে হয়, তা এখনও অজানা। তবে কয়েকটি কারণ যেমন- এই যে আমাদের সমাজে মেয়েদের একদম পারফেক্ট দেখতে চায়। এটা থেকেই নিজেকে পাতলা করার মানসিকতা সৃষ্টি হয়। আবার অনেকের নিজেদের সাইকোলজিক্যাল কারণেও নিজেকে পাতলা করার চেষ্টা শুরু হয়। গবেষকরা এতে জিনেরও ভূমিকা আছে বলে মনে করে কিন্তু তা এখনও সুস্পষ্ট নয়।
অ্যানোরেক্সিয়া অসংখ্য জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সবচেয়ে মারাত্মক হলো এতে হঠাৎ মৃত্যু হতে পারে, শরীরের ওজন অতিরিক্ত কম না হলেও। এমনটা হয় অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন বা ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতার কারণে। এ রোগের নির্দিষ্ট কার্যকর কোন চিকিৎসা না থাকলেও অভিজ্ঞদের পরামর্শ দ্বারা শারীরিক অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। তবে সমস্যা হলো আক্রান্ত ব্যাক্তিই চিকিৎসা নিতে চায় না, তারা পাতলা হলেও নিজেদের মোটা বা স্বাভাবিক মনে করে। তাই আপনার আশেপাশের মানুষের উপর নজর রাখুন, তাদের মাঝে উপরের লক্ষণ দেখা দিলে সময় থাকতে অভিজ্ঞদের শরণাপন্ন হতে সাহায্য করুন।
আমার নিজের কিছু অনুরোধ- দয়া করে নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করুন। অন্যের জন্য নিজেকে পরিবর্তন করতে গিয়ে নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলার কোন দরকার নেই। আমার একটা আর্টিক্যালে দেখিয়েছিলাম, আপনি কম খেলেও জেনেটিক এবং হরমোনের কারণেও আপনার ওজন বেশি হতে পারে। তাই আপনার যা করা সম্ভব যেমন স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা ইত্যাদি দিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন। তবে এমন কিছু ফলো করতে যাবেন না,যা আপনার জন্য উল্টো ক্ষতিকর হয়। আর প্লিজ প্লিজ ইউটিউব আর গুগল ডাক্তারের ডায়েট ফলো করতে যাবেন না। কারণ সবার শারীরিক অবস্থা এক না, তাই সবার জন্য একই ধরনের ডায়েট প্রযোজ্য না। যদি ডায়েট ফলো করতেই চান, তাহলে সার্টিফাইড ডাক্তার বা ডায়টেশিয়ানের শরণাপন্ন হোন।
তানজিনা সুলতানা শাহীন/ নিজস্ব প্রতিবেদক