মানুষের Bone Marrow বা অস্থিমজ্জায় স্টেম সেল নামক এক বিশেষ ধরনের কোষ রয়েছে। এই কোষগুলো নিজেরাই নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে অথবা রক্তকোষ ও প্রতিরক্ষা কোষে রূপান্তরিত হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে স্টেম সেল গুলোতে কিছু জিনগত ত্রুটি দেখা যায়, ফলে কোষগুলো নিজেদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটায়। এতে স্টেম কোষের সংখ্যা অন্য কোষগুলোর চেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকে এবং স্টেম কোষ এর মধ্যে ঘটতে থাকা জিনগত ত্রুটি রক্তকোষ ও প্রতিরক্ষা কোষে ছড়িয়ে দিতে থাকে। একে ক্লোনাল হেমাটোপোয়েসিস (Clonal Hematopoiesis of Indeterminate Potential- CHIP) বলা হয়, যাকে ব্লাড ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৫৬ সালে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত এক শিশুর দেহে প্রথম অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়। তখন থেকেই অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ক্যান্সার রোগীদের জীবন বাঁচাতে অবদান রেখে আসছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পরে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো হৃদরোগ।
যদিও উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল এবং ধূমপানের মতো কারণগুলি কার্ডিওভাসকুলার রোগ সৃষ্টিতে অবদান রাখে, তবে ক্লোনাল হেমাটোপোয়েসিস বা CHIP এই সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়ে দেয়। যেখানে উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত কোলেস্টরল, ধূমপান এসব হৃদরোগের ঝুঁকি ১.২-১.৪ গুণ বাড়ায়, সেখানে এই CHIP হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় প্রায় দ্বিগুন। ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে দেখা যায়, CHIP প্রদাহ বাড়ায় এবং ধমনীর দেয়ালে চর্বিযুক্ত প্লেক তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ার নাম এথেরোস্ক্লেরোসিস, যা হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ হতে পারে।
ক্লোনাল হেমাটোপোয়েসিস বা CHIP এর সাথে সম্পর্কিত এই জিনগত ত্রুটি গুলো উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায় না, বরং এই পরিবর্তন গুলো সময়ের সাথে ঘটতে থাকে। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসা-বিজ্ঞানী কেলি বোল্টন এর মতে,
“আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের জিনে মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটতে পারে। যখন অস্থিমজ্জার স্টেম কোষে এই মিউটেশন ঘটে তখন কোষগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিরূপ তৈরি করে, স্টেম কোষ থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য কোষেও এই পরিবর্তন ছড়িয়ে পড়ে।”
অনেকেরই প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হতে ক্লোনাল হেমাটোপোয়েসিস হয়ে থাকে, তবে এর মাত্রা খুব কম থাকে। ক্লোনাল হেমাটোপোয়েসিস বা CHIP এর মাত্রা ও প্রভাব সাধারণত বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তে থাকে, কারণ ক্লোন বা প্রতিরূপগুলোর সংখ্যা বাড়তে সময় লাগে। CHIP এর সাথে সম্পর্কিত জিনগত ত্রুটি ও কোষের সংখ্যা যত বেশি হবে, স্বাস্থ্য ঝুঁকি ততই বাড়তে থাকবে। গবেষণায় দেখা যায়, CHIP আছে এমন মানুষের তুলনায়, CHIP ব্যতীত মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি অনেকাংশেই বেশি।
গবেষকদের মতে, যেসব মানুষদের শরীরে CHIP এর উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল তারা ক্যান্সারে নয়, বরং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই মারা গিয়েছে। বিগত কয়েকবছরের হৃদরোগে আক্রান্ত এবং হৃদরোগ বিহীন ব্যক্তিদের ডিএনএ তথ্য পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, যাদের শরীরে CHIP এর উপস্থিতি আছে তাদের করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণ। তাদের হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে অতি দ্রুত প্লেক গঠিত হতে থাকে, যা হৃৎপিণ্ডে রক্ত প্রবাহে বাধা দেয়।
একই পরীক্ষা ইঁদুরের উপর করা হলে দেখা যায়, ইঁদুরের ধমনীতেও প্লেক গঠনে প্রভাব ফেলে CHIP। ইঁদুরগুলোতে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয় এবং তাদের উচ্চ কোলেস্টেরল যুক্ত সরবরাহ করা হয়। CHIP ব্যতীত ইঁদুরের তুলনায়, CHIP সহ ইঁদুরের ধমনীতে প্লেক ও প্রদাহ বেশি হয়।
মানুষের দেহে যেকোনো প্রদাহের বিরুদ্ধে শ্বেত রক্তকণিকা প্রতিরক্ষা কোষগুলো কাজ করে। কিন্তু চিকিৎসকরা মনে করেন রক্তনালিতে অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা কোষের উপস্থিতি ভালো নয়। CHIP প্রদাহের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ফলে ঐ জায়গায় শ্বেত রক্তকণিকা জমা হতে শুরু করে, যা শেষ পর্যন্ত ঐ স্থানে আরো দ্রুত প্লেক তৈরি করতে সাহায্য করে।
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপিত হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে গবেষণায় তাদের শরীরে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ট্রাইগ্লিসারাইড এবং ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের উপস্থিতি পাওয়া যায়, যা ধীরে ধীরে বিভিন্ন হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাদের শরীরে অতিরিক্তি কোলেস্টেরল থাকলেও খুব কম সংখ্যক ব্যক্তিই স্থুলতায় আক্রান্ত ছিলো। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাদের পেশির ভর হ্রাস পেয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ চর্বির ভর বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ক্রমশ কার্ডিওভাস্কুলার রোগ সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে।
গবেষকদের মতে, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপিত হয়েছে এমন রোগীদের অস্বাভাবিক লিপিড প্রোফাইল, উচ্চ রক্তচাপ এসব বিষয় পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি। বিভিন্ন শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে এসব রোগীদের বিভিন্ন কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ঝুঁকি থেকে বাঁচানো সম্ভব। সাম্প্রতিক অনেক ক্লিনিকাল ট্রায়ালে CHIP আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমাতে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বা প্রদাহ বিরোধী চিকিৎসা প্রয়োগ করা হয়েছে।
কার্ডিওভাস্কুলার রোগের কারণ হিসেবে ক্লোনাল হেমাটোপোয়েসিস এর শনাক্তকরণ হৃদরোগ চিকিৎসায় অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। একে কেন্দ্র করে বর্তমানে হৃদরোগ চিকিৎসা ও প্রতিরোধ পদ্ধতি আরো প্রশস্ত হবে বলে আশাবাদী গবেষকরা।
তাফহীমা ফেরদৌস / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সায়েন্স নিউজ, ফ্রেড হ্যাচ ক্যান্সার সেন্টার, ইনসাইড প্রিসিশন মেডিসিন