অদ্ভুত রহস্যময় আমাদের এ মানব শরীর। ক্ষুদ্র ভাইরাস থেকে শুরু করে জটিল ক্যান্সার বা টিউমারের সাথে লড়াই করে টিকে আছে মানবজাতি। আমাদের মানব শরীর যেমন প্রতিনিয়ত রোগ-বালাইয়ের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে বেঁচে থাকার তাগিদে, ঠিক তেমন ভাবেই বিজ্ঞানীরা নিরলস প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন সেসব রোগের প্রতিষেধক উদ্ভাবনের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফলও হচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানী শ্যাওলা থেকে বায়ো-হাইব্রিড মাইক্রোরোবট তৈরি করেছেন।
চলুন এটা নিয়ে একটু ধারণা নেওয়া যাক। মূলত স্পিরুলিনা শৈবাল ব্যবহার করা হয়েছে জীবন্ত এ মাইক্রোরোবট তৈরিতে। আর এ স্পিরুলিনার কাজ হচ্ছে কেবল শরীরের স্বাভাবিক পুষ্টি বাড়িয়ে তোলা। গবেষক দলের মতে ম্যাগনেটাইট এবং আয়রন অক্সাইড (Fe3O4) দিয়ে তৈরী জৈব সামঞ্জস্যপূর্ণ চৌম্বকীয় ন্যানো পার্টিক্যাল দ্রবণে স্পিরুলিনা ডুবিয়ে এই বায়ো-হাইব্রিড মাইক্রোরোবট তৈরি করা হয়েছে।
কেমন হবে যদি শ্যাওলা থেকে তৈরি মাইক্রোরোবট ক্যান্সার নিরাময় করতে পারে?
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক শোনাচ্ছেন এমনই আশার বাণী। তারা শ্যাওলা থেকে জীবন্ত মাইক্রোরোবট বানাতে সক্ষম হয়েছেন যা ক্যান্সার থেরাপির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে টিউমারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে।
শরীরের কোষে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার সময় শক্ত টিউমারগুলো অল্প পরিমাণে পুষ্টি এবং অক্সিজেন গ্রহন করে বিকশিত হয়। রক্তনালির অস্বাভাবিক গঠন এবং অতিদ্রুত টিউমার বৃদ্ধির কারণে দূরে থাকা কোষগুলো হাইপোক্সিয়া (কোষে নিম্ন মাত্রার অক্সিজেন থাকা) হিসেবে পরিচিত হয়।
স্কুল অফ মেডিসিনের রেডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক উটকান ডেমিরসির নেতৃত্বে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের একটি দল “ভলবট” নামক বায়োহাইব্রিড মাইক্রোরোবট দিয়ে টিউমার আক্রান্ত স্থানের অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য একটি উদ্ভাবনী পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, যা টিউমারের কার্যকারিতা কমিয়ে হাইপোক্সিয়া থেকে মুক্তি দেয়।
ডেমিরসি বলেন- “আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ভলভটগুলোকে আক্রান্ত স্থানে অক্সিজেন উৎপন্ন করে এমন মাইক্রো-ফ্যাক্টর হিসেবে ব্যবহার করে ক্যান্সার হাইপোক্সিয়ার সমস্যাগুলোর সমাধান করা”।
বায়োহাইব্রিড মাইক্রোরোবট মূলত জীবিত এবং কৃত্রিম উভয় উপাদান দিয়ে তৈরি। মাইক্রোরোবটের “জীবন্ত অংশ” গতিশীলতা এবং পরিবহন এর কাজ করে।এতে করে বিজ্ঞানীরা অতি সহজেই নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। যেমন: ক্যান্সার আক্রান্ত টিস্যুতে মাইক্রোরোবট ব্যবহার করে ঔষধের সঠিক প্রয়োগ করতে পারেন।
এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে, এতো ক্ষুদ্র মাইক্রোরোবট কাজ কীভাবে করবে? অথবা, মানুষের শরীরে এতো ক্ষুদ্র মাইক্রোরোবট খুঁজে পাওয়া যাবে কিভাবে?
এ প্রশ্নের উত্তরও খুবই সোজা। যেহেতু মাইক্রো রোবট তৈরিতে চৌম্বকীয় ন্যানো পার্টিক্যাল ব্যবহার করা হয়েছে, তাই বাইরে থেকে চৌম্বকক্ষেত্র দিয়ে খুব সহজেই এটি শরীরের নির্দিষ্ট স্থান অব্দি নিয়ে যাওয়া যাবে। স্পিরুলিনা উজ্জ্বল শ্যাওলা হওয়ায় বিজ্ঞানীরা এর এই প্রবনতাকে কাজে লাগিয়েছেন। শরীরের ভেতর এই মাইক্রোরোবটের অবস্থান চিহ্নিত করতে তারা একটি ফ্লুরোসেন্স মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করেছেন।
অটোমেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর সহযোগী অধ্যাপক লি ঝাং এর মতে, “ফ্লুরোসেন্সের উজ্জ্বলতা স্তর পার্শ্ববর্তী পরিবেশের pH মানের সাথে সম্পর্কিত। এর ফলে মাইক্রোরোবটগুলো শরীরে কম তীব্রভাবে জ্বলছে কিনা তা দেখা যাবে, যা আরো অম্লীয় পরিবেশকে নির্দেশ করবে। এতে করে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের সন্ধান পাওয়া যাবে।
অধ্যাপক উটকান ডেমিরসি আরও বলেন- “বায়োহাইব্রিড মাইক্রোরোবটের ন্যানো পার্টিক্যালগুলো থেরাপিউটিক এজেন্টও বহন করতে পারে এবং কাছাকাছি- ইনফ্রারেড আলোর সংস্পর্শে এসে তাপ তৈরি করতে পারে, যা ফটোথার্মিয়া-ভিত্তিক চিকিৎসা বা নির্দিষ্ট মাত্রায় ঔষধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে”।
মাইক্রোরোবট ক্যান্সার থেরাপিতে ব্যবহারের আগে ইন-ভিট্রো পদ্ধতিতে অক্সিজেন উৎপাদনে ভলবটের ক্ষমতা মূল্যায়ন করা হয়েছিলো। ডেমিরসি বলেন “আমরা পশুর নমুনাতে ভলবট ব্যবহার করে পরীক্ষা করেছি, যেখানে চিকিৎসা করা ইঁদুরগুলোর টিউমারের আকার হ্রাস পেয়েছে।” বিজ্ঞানীরা আরও জানিয়েছেন, ভলবটগুলো দিয়ে পরীক্ষার সময় কোনো বিষক্রিয়া হয়নি। তবুও শৈবালের ক্লিয়ারেন্স এবং ডেলিভারি প্রক্রিয়া সম্পর্কিত সম্ভাব্য কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা ক্লিনিকাল ব্যবহারের আগে অবশ্যই পুনরায় পর্যবেক্ষণ করা হবে।
দলটি নিজেদের গবেষণাপত্রে লিখেছেন- “বর্তমান প্ল্যাটফর্মে ক্লিনিক্যাল ট্রান্সলেশন ব্যাখ্যা করার অনেক দিক থাকা স্বত্তেও, এই বায়োহাইব্রিড রোবট-এর কৌশলটি সম্ভবত ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য জৈবিক রোবোটিক ডিজাইন তৈরীর মাধ্যমে বায়োমেডিসিন, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ইমেজিং অ্যাপ্লিকেশনগুলোর পরিসর বাড়ানোর জন্য একটি নতুন উদ্ভাবনী পথের উন্মোচন করেছে।”
নিজস্ব প্রতিবেদক/ জেসিকা আক্তার