সাধারণভাবে বলতে গেলে যখন কোনো কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে তখন তা দেখতে ত্বকের নিচে মাংসের পিন্ডের মতো লাগে, একেই টিউমার বলে। এই টিউমার বিনাইন ও ম্যালিগন্যান্ট এ দু’ধরনের হতে পারে। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারকেই ক্যান্সার বলে। ক্যান্সার নিরাময়ে এখনও বেশ অগ্রগতি সাধিত না হওয়ায় এই রোগেই মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
কারণ প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার রোগ সহজে ধরা পড়ে না। ফলে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ভালো কোন চিকিৎসা দেওয়াও সম্ভব হয় না। তাই ক্যান্সার মরণব্যাধি হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু ওইদিন খুব-ই সন্নিকটে যেদিন থেকে কাউকে আর ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুবরণ করতে হবে না। একটি ব্যাকটেরিয়া এখন ধ্বংস করতে পারবে জীবন্ত কোষের টিউমার ডি.এন.এ।
জেনেটিক মিউটেশন, কার্সিনোজেনের সংমিশ্রণ (তামাকের ধোয়া, অ্যালকোহল ও কিছু রাসায়নিক পদার্থ), বয়স, দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, দেহের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থার কর্মহীনতা, পারিবারিক ইতিহাস, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, ভাইরাসের সংস্পর্শ ইত্যাদি কারণে ক্যান্সার হতে পারে।
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সিদ্ধার্থ মুখ্যার্জি বলেছেন,
“ভবিষ্যতে কোষের মাধ্যমে যেকোন জটিল রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা করা যাবে, বড়ির বা ঔষধের প্রয়োজন হবে না।”
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টেনাইল এবং অন্যান্য অনেক ক্যান্সার শনাক্তকরণ, ধ্বংস এবং ক্যান্সার নিরাময়ে এর জন্য একটি ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার হবে যা অন্ত্রে DNA শনাক্ত করে পারে। চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
এবছর ১১ আগস্ট বিখ্যাত সায়েন্স জার্নালে গবেষণাটি প্রকাশ পায়। ক্যালিফোর্নিয়া সান ডিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও তার সহযোগীরা এমন জীবাণু তৈরি করেছেন যা বিভিন্ন ইনফেকশন, ক্যান্সার এবং অন্যান্য রোগ শনাক্ত করতে সক্ষম। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী জেফ হেস্টি বলেন,
“আমরা এটি নিয়ে ৪ বছর আগে যখন প্রথম গবেষণা শুরু করি তখন আমরা ভাবতেই পারিনি যে মানুষের DNA সেন্সর হিসেবে ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার সম্ভব!”
টিউমার কোষ সাধারণত তার আশেপাশের DNA এর মধ্যে ছড়িয়ে যায়। যদিও DNA কে বিশুদ্ধ করার জন্য ল্যাবে অনেক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় কিন্তু সকল প্রযুক্তিই ছড়িয়ে পড়া অংশে নিউক্লিক অ্যাসিড শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়।
কোলারেজটাল ক্যান্সার কি?
মলাশয়ের ক্যান্সার বা কোলারেজটাল ক্যান্সার হচ্ছে এক ধরনের ক্যান্সার যা দেহের মলাশয়, মলনালি (বৃহদান্ত্রের অংশ) বা অ্যাপেন্ডিক্সে অংশে অনিয়ন্ত্রিত কোষবৃদ্ধির কারণে সৃষ্টি হয়। এটি কোলন ক্যান্সার (colon cancer), বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার বা অন্ত্রের ক্যান্সার (bowel cancer) নামেও পরিচিত।
হেস্টি, কুপার এবং অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার ড্যান ওয়ার্খলি ব্যাকটেরিয়ার প্রাকৃতিক রূপান্তরের বিষয়কে কাজে লাগিয়ে কোলোরেক্টাল ক্যান্সার সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা করেন। তারা জেনেটিক্যালি রূপান্তরিত ব্যাকটেরিয়াকে নতুন বায়োসেন্সর হিসেবে প্রণয়ন করেন যেটা কোলোরেক্টাল টিউমার থেকে ছড়িয়ে পড়া DNA কে শনাক্ত করে।
অস্ট্রেলিয়ান ক্যান্সার গবেষক ও গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট ওয়ার্থলি বলেছেন,
“কোষবিহীন DNA (যেসব DNA কোষের বাইরে রক্ত, মূত্র এসব তরল পদার্থে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। DNA গুলোর উৎস মূলত মৃত কোষ, ক্যান্সার কোষ ইত্যাদি) টিউমার DNA কে শনাক্ত করতে সক্ষম। এটি মাথায় রেখে আমরা ব্যাকটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং করার যাত্রা শুরু করেছি।”
ক্যান্সার সৃষ্টিকারী জেনেটিক মিউটেশন কি?
মিউটেশন হল কোষের ডিএনএ সিকোয়েন্সের পরিবর্তন। এ পরিবর্তন ক্যান্সারের বিকাশ ঘটাতে পারে। এই মিউটেশনগুলো উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বা সময়ের সাথে সাথে পরিবেশগত কারণ যেমন: UV বিকিরণ বা কিছু রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসবার কারণে অর্জিত হতে পারে। কোষের বৃদ্ধি এবং বিভাজন নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলোতে মিউটেশন ঘটতে পারে, যা অনিয়ন্ত্রিত কোষের বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে।
অস্ট্রেলিয়ান গবেষক সুসাইন এবং জোসেফাইন এর সাথে কাজ করে গবেষকরা আবিষ্কার করেছে, টিউমার কোষগুলো সাধারণভাবে তাদের ডিএনএ এর টুকরো চারপাশে ছড়িয়ে দেয়।
একদল গবেষক CRISPR নামক জিন-এডিটিং টুল ব্যবহার করে A.baylayi ব্যাকটেরিয়ায় মডিফিকেশন করেন। এতে করে তারা একটি মিউটেড জিনকে চিহ্নিত করতে পারে যা ক্যান্সারের সাথে সম্পর্কিত। যদি এই মিউটেড জিন উপস্থিত থাকে তাহলে ব্যাকটেরিয়াটি নিজের জিনোমে এই জিনটি যোগ করবে, যা একটি নির্দিষ্ট সিগন্যাল সৃষ্টি করবে যার সাহায্যে চিকিৎসকরা একটি রোগীকে ক্যান্সার পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত করে।
A.baylayi ব্যাকটেরিয়া কীভাবে ক্যান্সার নিরাময়ে কাজ করে?
ব্যাকটেরিয়াটি শরীরের কোনো এক অংশে, উদাহরণস্বরূপ কোলনে মুক্ত করা হয়। যদি তারা ক্যান্সার সংক্রমিত মিউটেড জিন এর সম্মুখীন হয় তবে তাদের সেই ডিএনএ আকর্ষিত হয়। তখন এটি একটি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিন এ প্রতিক্রিয়া করে যা তাদের একটি নির্দিষ্ট ঔষধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী করে তোলে।
গবেষকরা ওষুধের প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া খুঁজতে এটিকে একটি ল্যাব ডিশে (সেল কালচার ডিশ) অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে রাখে। যদি ব্যাকটেরিয়া ডিশে টিকে থাকতে না পারে তাহলে বুঝা যাবে যে তাদের জিনোম পরিবর্তন হয়নি অর্থাৎ এদের মধ্যে কোনো ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের অস্তিত্ব নেই।
তবে যদি তারা যদি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ করে ল্যাব ডিশে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় তাহলে বুঝা যাবে সেটিতে ক্যান্সার বা প্রিক্যান্সার পলিপের উপস্থিতি আছে।
‘Acinetobactor baylyi‘ নামক ব্যাকটেরিয়া যা বায়োসেন্সর হিসেবে এমন একটি DNA শনাক্ত করতে পারে যেটা KRAS (মিউটেড জিন/ক্যান্সার সংক্রমিত একটি জিন) থেকে আগত। তারা ব্যাকটেরিয়াকে একটি CRISPR সিস্টেমের সাথে প্রোগ্রাম করেছে যা KRAS এর মিউট্যাড থেকে নন মিউটেড অনুলিপিকে আলাদা করে।
এক্ষেত্রে শুধুমাত্র যেসব ব্যাকটেরিয়া KRAS এর মিউট্যাড অনুলিপি গ্রহণ করেছিলো, যা মূলত ক্যান্সার কোষে পাওয়া যায়। এই একই কোষে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মিউটেড জিনের অবস্থান শনাক্ত করার সংকেত দেয়।
জোসেফাইন বলেছেন,
“ব্যাপার টা আমার কাছে খুব অবিশ্বাস্য লেগেছিল যখন আমি অণুবীক্ষণযন্ত্রের নিচে টিউমারের DNA অনুলিপি গ্রহণকারী ব্যাকটেরিয়া দেখেছিলাম।”
গবেষকেরা এখন মানুষের ক্যান্সার সংক্রমণ, শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার জন্য ব্যাকটেরিয়া বায়োসেন্সর কৌশলটি প্রয়োগ শুরু করছেন। বর্তমানে বায়োসেন্সরটি নির্দিষ্ট কিছু KRAS মিউটেশন শনাক্ত করতে ডিজাইন করা হয়েছে যা প্রায় ৪০% কোলোরেক্টাল ক্যান্সারে এবং এক-তৃতীয়াংশ ফুসফুস ক্যান্সারে এবং বেশিরভাগ প্যানক্রিয়াস ক্যান্সারে পাওয়া যায়।
মানুষের মধ্যে এর সম্ভাব্য ব্যবহারের আগে গবেষকদের দেখাতে হবে যে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানো টিউমার ডিএনএ স্তর থেকে A. baylyi ব্যাকটেরিয়া ক্যান্সার কণাগুলো স্বতন্ত্রভাবে শনাক্ত করতে পারে।
গবেষক উডস বলেছেন,
“কোলোরেক্টাল ক্যান্সার এর টিউমারটি প্রতিরোধ করার জন্য ব্যাকটেরিয়া প্রকৌশলের সম্ভাবনা বেড়েছে। এক্ষেত্রে টিউমারটি ব্যাকটেরিয়ার স্রোতে নিমজ্জিত হয়ে যায় এবং ব্যাকটেরিয়া এটির অগ্রগতিতে বাধা দেয়।”
তবে কুপারের মতে,
“এটি শুধুমাত্র অন্ত্রের ক্যান্সার নিরাময়ে সীমাবদ্ধ হতে পারে। যদিও নতুন এই গবেষণা আরও উন্নয়ন এবং পরিমার্জন প্রয়োজন।”
গবেষক ওয়ার্থলি বলেছেন,
“এমন একটি সময় হবে যেখানে কোলোরেক্টাল ক্যান্সারে কারোরই মৃত্যু হবে না। আমরা আশা করি যে জীব প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকদের জন্য এই লক্ষ্যে পূরণ ভবিষ্যতে সম্ভব হবে।”
মাইশা নিজাম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সায়েন্স ডেইলি, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস