গরুর মাংসের কালোভুনা, স্টেক, খাসির কাচ্চি এসব মুখরোচক খাবার কার না পছন্দ!? তবে এগুলোর মূল যে চর্বি এটা তো কম বেশি সবাই জানি।
আমাদের শরীরের সব যৌগের মধ্যে, কোলেস্টেরল, স্নেহ বা চর্বি অন্যতম। এই ফ্যাটি পদার্থটিকে ঘিরে অনেক দূর্নাম থাকলেও এটা আমাদের জীবনের জন্য অপরিহার্য। আজ আমরা এই কোলেস্টেরলের নানা রোগ ব্যাধি সহ প্রচলিত অনেক ভুল ধারনা সম্পর্কে জানব। চলুন তাহলে আমরা কোলেস্টেরল সম্পর্কে বিস্তারিত জানি!
কোলেস্টেরল প্রাণী কোষের ঝিল্লির একটি অপরিহার্য উপাদান; এটি সমস্ত প্রাণী কোষ দ্বারা সংশ্লেষিত হয়। যখন চর্বি রক্তে উচ্চ মাত্রায় উপস্থিত থাকে, তখন এটি কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। কোলেস্টেরল, ফ্যাট এবং ক্যালসিয়ামের মতো অন্যান্য পদার্থের সাথে যুক্ত হয়ে ধমনীর দেয়ালে অতিরিক্ত স্তর তৈরি করে। সময়ের সাথে সাথে, এটি রক্তনালীগুলিকে সংকীর্ণ করে এবং স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক সহ গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) অনুসারে, ২০১৫-২০১৬ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১২ শতাংশ, ২০ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের উচ্চতর কোলেস্টেরল ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুমান করে যে কোলেস্টেরলের উচ্চমাত্রা প্রতি বছর 2.6 মিলিয়ন সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
কোলেস্টেরল নিয়ে যত কুসংস্কার:
কুসংস্কার-১ঃ সকল কোলেস্টেরল খারাপ
আমরা সবাই জানি, কোলেস্টেরল কোষের ঝিল্লির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ঝিল্লিতে তার কাঠামোগত ভূমিকা ছাড়াও, এটি স্টেরয়েড হরমোন, ভিটামিন ডি, এবং পিত্ত অ্যাসিড উৎপাদনেও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কোলেস্টেরলের উচ্চ মাত্রা জীবন ঝুঁকির কারণ কিন্তু কোলেস্টেরল ছাড়া, আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
“কোলেস্টেরল খারাপ নয়। এটি একজন নিরীহ প্রত্যক্ষদর্শী যা আজ আমাদের আধুনিক জীবনধারাতে ভুল আচরণ করছে। আমাদের দেহ এমন পরিবেশে বাস করার জন্য তৈরি করা হয়নি যেখানে খাবার অতিরিক্ত গ্রহন করা যাবে তাই যখন খাবার অতিরিক্ত হয় কোলেস্টেরল অতিরিক্ত হয়। তখন এটি আমাদের দেহে জমা হবে এবং সেই জমা কেন্দ্র প্রায়ই আমাদের রক্তনালী হতে পারে, এবং তখনই এটি আমাদের জন্য খারাপ। ” – ডাঃ রবার্ট গ্রিনফিল্ড।
শরীরে কোলেস্টেরলের ক্রিয়াকলাপের বাইরে, যেভাবে এটি শরীরে পরিবাহিত হচ্ছে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিনা তাতেও অনেক কিছু নির্ভর করে। কোলেস্টেরল চারদিকে লিপোপ্রোটিন দ্বারা বেষ্টিত। লিপোপ্রোটিন হচ্ছে চর্বি এবং প্রোটিনযুক্ত পদার্থ। লিপোপ্রোটিন পরিবহন দুটি প্রধান উপায়ে ঘটে। কম ঘনত্বের লিপোপ্রোটিন (LDL) কোলেস্টেরল যকৃত থেকে কোষে নিয়ে যায়, যেখানে এটি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়।
প্রায়শই এলডিএলকে “খারাপ” কোলেস্টেরল বলা হয়, কারণ রক্তের প্রবাহে এলডিএল কোলেস্টেরলের উচ্চ মাত্রা কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। অন্যদিকে উচ্চ ঘনত্বের লিপোপ্রোটিন (HDL) কে প্রায়শই “উপকারি” কোলেস্টেরল হিসাবে উল্লেখ করা হয়, কারণ এটি কোলেস্টেরলকে আবার লিভারে পরিবহন করে। এভাবে কোলেস্টেরল শরীর থেকে অপসারণ করা হয়, যার ফলে কার্ডিওভাসকুলার ঝুঁকি হ্রাস পায়।
কুসংস্কার-২ঃ আমার ওজন ঠিক আছে, তাই আমার কোলেস্টেরল নেই
অনেকেই ভেবে থাকেন আমি সুস্থ ওজনের অধিকারী, তাই আমার উচ্চ কোলেস্টেরল থাকতে পারে না। কিন্তু না এই ধারনা ভুল। ডাঃ গ্রিনফিল্ড এর মতে “কোলেস্টেরলের ভারসাম্য আসলে আমরা যা খাই তার উপর নির্ভর করে, কিন্তু আমাদের জেনেটিক্সও এই ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।”
উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি কোলেস্টেরলকে কার্যকরভাবে প্রক্রিয়াজাত না করার জিনগত প্রবণতা নিয়ে জন্ম নিতে পারে। ডাঃ গ্রীনফিল্ড বলেছেন “এই জেনেটিক সমস্যাকে ফ্যামিলিয়াল হাইপারকোলেস্টেরোলিমিয়া (Familial Hypercholesterolemia) বলা হয় এবং প্রতি ২০০ জন মানুষের ১জন এই রোগে আক্রান্ত।
“ওজন আপনার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বিপাক প্রক্রিয়ার একটি ফাংশন যা আসলে খরচ হওয়া ক্যালরি এবং ব্যয়িত ক্যালরিগুলির মধ্যে ভারসাম্য।” ডাঃ পাজ এক্ষেত্রে সম্মত হয়ে বলেন:
“এমনকি যদি আপনার স্বাস্থ্যকর ওজন থাকে তবেও আপনার দেহে কোলেস্টেরলের পরিমাণ অস্বাভাবিক হতে পারে। আপনার কোলেস্টেরলকে প্রভাবিত করে এমন অন্যান্য কারণগুলি হল আপনার খাদ্যভাস, ব্যায়ামের অভ্যাস, আপনি ধূমপান করেন কিনা এবং আপনি কতটা অ্যালকোহল পান করেন। ”
ডাঃ লাজোয়ী বলেছেন, “যাদের স্বাস্থ্যকর ওজন আছে তাদের উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রা থাকতে পারে, আবার কিছু লোক যাদের ওজন বেশি তাদের উচ্চ কোলেস্টেরল নাও থাকতে পারে। কোলেস্টেরলের মাত্রা জেনেটিক্স, থাইরয়েড ফাংশন, ওষুধ, ব্যায়াম, ঘুম এবং খাদ্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়”। তিনি আরও বলেন, “এমন কিছু কারণ রয়েছে যা আপনি পরিবর্তন করতে পারবেন না, যেমন আপনার বয়স বা আপনার জেনেটিক প্যাটার্ন, যা উচ্চ কোলেস্টেরল থাকায় অবদান রাখতে পারে”।
কুসংস্কার-৩ঃ কোলেস্টেরল হলে আমার শরীরে তার লক্ষণ দেখা যেত
একটা প্রচলিত কুসংস্কার আমরা প্রায় শুনি, উচ্চ কোলেস্টেরল হওয়া মানেই শরীরে সাথে সাথে লক্ষন প্রকাশ পায়। ডাঃ পাজ বলেন: “বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চ কোলেস্টেরল লক্ষণ সৃষ্টি করবে না। এ কারণেই উচ্চ কোলেস্টেরল পরীক্ষা করার জন্য পর্যায়ক্রমিক রক্ত পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। আপনি যে বয়সে স্ক্রিনিং শুরু করেন, সেই স্ক্রিনিং ফ্রিকোয়েন্সি আপনার ব্যক্তিগত ঝুঁকির কারণগুলি দ্বারা নির্ধারিত হয়।”
তাহলে লক্ষণ কখন বুঝা যায়??
এর ও জবাব দিয়েছেন ডাঃ গ্রীনফিল্ড। “একমাত্র তখন-ই লক্ষন দেখা দেয় যখন অতিরিক্ত কোলেস্টেরল জমে হৃদযন্ত্র এবং রক্তনালী ক্ষতি এবং ব্লকেজ সৃষ্টি করে ফেলে। এটি বুকে ব্যথা (এনজাইনা), হার্ট অ্যাটাক বা এমনকি আকস্মিক মৃত্যু ঘটায়” বলেন ডাক্তার গ্রিনফিল্ড।
কুসংস্কার-৪ঃ প্রচুর কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার খেলে দেহে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়বে
অনেকে বলে থাকেন যদি আমি প্রচুর কোলেস্টেরল খাই, আমার উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল থাকবে। ডাঃ লাজোই বলেছেন, “যে কোলেস্টেরল খাওয়া হয়, সেক্ষেত্রে এটা নয় যে তা সরাসরি কোলেস্টেরলের মাত্রার সাথে সম্পর্কিত। শর্করা, সাধারণ কার্বোহাইড্রেট খাওয়ার ফলে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি হতে পারে, এমনকি যদি কেউ বেশি চর্বিজাতীয় খাবার না খায়।”
ডাঃ গ্রিনফিল্ড ব্যাখ্যা করলেন “আপনি দোকানে গিয়ে কোলেস্টেরলের প্যাকেজ কিনবেন না, তবে আপনি লাল মাংস, পনির এবং ডিম কিনবেন। লাল মাংসে থাকে স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং কোলেস্টেরল। এই কোলেস্টেরলগুলো একটি পশুজাতীয় পণ্য, তাই যেসব সামগ্রীতে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে তা কেবল কোলেস্টেরলই বাড়ায় না, বিশেষ করে ‘খারাপ’ বা এলডিএল, কোলেস্টেরল বাড়ায়, যা তখন আমাদের রক্তনালীর ধমনী প্রাচীরের মধ্যে জমা হয়।”
কুসংস্কার-৫ঃ নারীদের চেয়ে পুরুষদের কোলেস্টেরল নিয়ে বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন
শুধুমাত্র পুরুষদেরই কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ে চিন্তিত হওয়া দরকার এই ভুল ধারনাও অনেক প্রচলিত, যা সত্য নয়। এক্ষেত্রে ডাঃ পাজ ব্যাখ্যা করেছেন: “CDC এর নির্ভরযোগ্য উৎস অনুসারে, ২০১৫-২০১৮ তে, মার্কিন প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে উচ্চ কোলেস্টেরলের প্রকোপ ছিল মোট ১১.৪% এবং তার মধ্যে উচ্চ কোলেস্টেরলের প্রাদুর্ভাব পুরুষদের মধ্যে 10.5% এবং মহিলাদের মধ্যে 12.1% ছিল।”
“Heart disease is an equal opportunity employer,” – Dr. Greenfield
ডাঃ গ্রীনফিল্ড আরো জানান- “মহিলারা, এস্ট্রোজেনের প্রতিরক্ষামূলক প্রভাব হারানোর পরে, তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি ত্বরান্বিত করতে শুরু করে এবং পুরুষদের মতো একই ঝুঁকিতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, যেহেতু মহিলাদের গড় আয়ু বেশি হয় এবং তারা পরবর্তী বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয় তাই তখন পুরুষদের চেয়েও বেশি সংখ্যক মহিলাদের হার্ট অ্যাটাক রেকর্ড দেখা যায়।” তিনি আরও বলেছিলেন যে যখন মহিলারা হার্ট অ্যাটাকের সম্মুখীন হন, তখন তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে এবং মহিলাদের স্তন ক্যান্সারের চেয়ে হৃদরোগে মারা যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।
কুসংস্কার-৬ঃ স্ট্যাটিন জাতীয় ওষুধ খেলে যা কিছুই খাওয়া হোক, কোলেস্টেরলের সমস্যা হবেনা
অনেকেই স্ট্যাটিন জাতীয় ওষুধ খেয়ে থাকেন কোলেস্টেরলের ঝুকি কমাতে। কিন্তু এই ওষুধ গ্রহণ করা মানে এটা না যে, আপনি যখন তখন মাত্রাতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার খেতে পারেন যা আপনার উচ্চ মাত্রায় ঝুঁকি বাড়ায়। ডাঃ গ্রিনফিল্ড বলেছেন:- “যদি আপনি যা চান তা খান এবং অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করেন, তাহলে আপনার ওজন বাড়বে। যখন আপনি খুব বেশি ওজন বাড়ান, বিশেষত আপনার পেটের আশেপাশে, আপনি metabolic syndrome নামে একটি অবস্থা তৈরি করতে পারেন, যা একটি প্রি –ডায়াবেটিক অবস্থা। তিনি আরো বলেন: “স্ট্যাটিন ওজন কমানোর ওষুধ নয়। তাদের কাজ হল ‘খারাপ’ এলডিএল কোলেস্টেরল কমানো, এবং আপনার কাজ হল আপনার শরীরের প্রতি শ্রদ্ধার সাথে আচরণ করা, যার মধ্যে আপনি যা খান তা অন্তর্ভুক্ত। “
কুসংস্কার-৭ঃ ৪০ বছরের আগে কোলেস্টেরলের মাত্রা চেক করার প্রয়োজন নেই
অনেকেই ভেবে থাকেন- আমার বয়স ৪০ এর নিচে, তাই আমার কোলেস্টেরলের মাত্রা চেক করার দরকার নেই- ভুল। ডাঃ পাজ ব্যাখ্যা করেছিলেন, “অনেক প্রতিষ্ঠান, যেমন AHA, 20 বছর বয়সের আগে স্ক্রিনিং করার সুপারিশ করে।” Dr. গ্রিনফিল্ড বলেন: “তরুণ বয়সে আপনার রক্তনালীগুলি যদি অতিরিক্ত কোলেস্টেরল যুক্ত রক্তে পূর্ণ থাকে, পরবর্তী জীবনে আপনার কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বলা হয়ে থাকে যে, কিশোর বয়সে প্রথম কোলেস্টেরল পরীক্ষা করা উচিত এবং যদি আপনার কোলেস্টেরলের জন্য নানা রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে, তবে তা দ্রুত পরীক্ষা করা উচিত এবং যারা হোমোজাইগাস ফ্যামিলিয়াল হাইপারকোলেস্টেরোলেমিয়া আক্রান্ত তাদের ২ বছর বয়সে কোলেস্টেরল পরীক্ষা করা উচিত।”
জান্নাতুল মাওয়া/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: মেডিক্যাল নিউজ টুডে