কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতে ত্বকের লোম দাঁডিয়ে যাওয়া বা ত্বকে শিহরিত হবার অনুভূতি অবশ্যই আমাদের সবারই কোনো না কোনো সময়ে হয়েছে। কিন্তু আপনার মনে হয়ত প্রশ্নও জেগেছে, কেন হয় এই অনুভূতি, চলুন জেনে নেই এই পেছনের বিজ্ঞানটি!
আদিমকালে শিহরিত হওয়াকে ধরা হতো প্রাণিদের জন্য ঠান্ডা থেকে বাঁচার একটি উপায় হিসেবে। শিহরণের ফলে ত্বকের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যেত, ফলে এর মাঝে আটকে যেত বাতাস, যা ইনস্যুলেটর হিসেবে কাজ করত। প্রাণিদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি কাজ করলেও, মানুষের ক্ষেত্রে শিহরণ আমাদেরকে ঠান্ডা থেকে বাঁচায় না।
বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, শুধু মাত্র ঠান্ডা পরিবেশই নয়, আনন্দ, দুঃখ, ভয়, উত্তেজনা, গর্ব, প্রিয় গান বা আর্ট, বিস্ময়কর যেকোনো কিছুই শিহরণের কারণ হতে পারে। এড্রেনালিন হরমোনের হঠাৎ প্রবাহের ফলে আমরা শিহরিত হই, কিন্তু শিহরণের সময় কেন আমাদের দেহের লোম দাঁড়িয়ে যায় তা-ই আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা।
একটি নতুন গবেষণায়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা কারণটি আবিষ্কার করেছেন; যে ধরণের কোষের জন্য আমরা শিহরিত হই সেটি চুলের গ্রন্থিকোষ এবং পুনরায় চুল জন্মানোর স্টেম সেলগুলোর বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ। ত্বকের নীচে যে পেশীগুলো শিহরণ তৈরির সাথে সম্পর্কিত, তারা চুলের ফলিকল স্টেম সেলগুলির সাথে সিম্প্যাথেটিক নার্ভের মাধ্যমেও সংযুক্ত। সিম্প্যাথেটিক নার্ভ শর্ট টার্ম প্রতিক্রিয়ায় ঠান্ডায় পেশী সংকোচনের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং শিহরণ তৈরি করে ও এর দীর্ঘমেয়াদের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে চুলের ফলিকল স্টেম সেল এবং নতুন চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।
সেল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, ইঁদুরগুলো উপর এই গবেষণাগুলোর ফলাফল গবেষকদের আরও ভাল ধারণা দেয় যে, বাইরের পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য কীভাবে বিভিন্ন ধরনের কোষ স্টেম সেলের সাথে যোগাযোগ করে।
স্টেম সেল এবং রিজেনারেটিভ বায়োলজির অ্যালভিন এবং এস্টা স্টার সহযোগী অধ্যাপক, ইয়া-চিহ হু বলেছিলেন- “স্টেম সেলের আচরণ কীভাবে বাহ্যিক উদ্দীপনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তা নিয়ে আমরা বরাবরই আগ্রহী ছিলাম। ত্বক একটি চমৎকার ব্যবস্থা: এটিতে বিভিন্ন ধরণের স্টেম সেলকে ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের কোষ যা আমাদের দেহ এবং বাইরের পরিবেশের মাঝে অবস্থিত। তাই, এই স্টেম সেলগুলি বিভিন্ন উদ্দীপনা- হতে পারে তা শরীরের অভ্যন্তরে বা বাইরের পরিবেশের প্রভাবেও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে”।
তিনি ন্যাশনাল তাইওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সু-জান লিনের সহযোগিতায় এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। “এই গবেষণায়, আমরা একটি আকর্ষণীয় বিষয় শনাক্ত করেছি যা কেবল স্থির অবস্থায় স্টেম সেলগুলোকে নিয়ন্ত্রন করে না বরং বাইরে তাপমাত্রার পরিবর্তন অনুযায়ী স্টেম সেল গুলোর আচরণও সংশোধন করে।”
আমাদের দেহের অঙ্গগুলো তিন ধরনের টিস্যু দ্বারা গঠিতঃ এপিথেলিয়াম, মিসেনকাইম ও নার্ভ টিস্যু। ত্বকে এই তিনটি টিস্যুই উপস্থিত। সিম্প্যাথেটিক নার্ভ টিস্যু আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের অংশ। এটি ত্বকের মেসেনকাইম স্তরের ক্ষুদ্র মসৃণ পেশির সাথে যুক্ত হয়, আর এই পেশী তন্তু ত্বকের সর্ববহিস্থঃ স্তর যা এপিথেলিয়াম টিস্যু দিয়ে গঠিত। আমাদের চুলের ফলিকল স্টেম সেল গুলোও এপিথেলিয়াম টিস্যুরই অংশ।
সিম্প্যাথেটিক নার্ভ ও পেশী টিস্যুর মাঝে সংযোগ থাকায় ঠান্ডা পরিবেশে বা যেকোনো বাহ্যিক উদ্দীপনায় মস্তিষ্ক থেকে সঙ্কেত সিম্প্যাথেটিক নার্ভের মাধ্যমে পেশীতে পৌঁছায়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমরা দেখতে পাই বাহ্যিক ভাবে আমাদের পেশির লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া।
চুলের ফলিকল স্টেম সেলগুলির সাথে স্নায়ু সংযোগ কীভাবে কাজ করত তা দেখার জন্য গবেষকরা এর সাথে সংযুক্ত পেশীগুলো সরিয়ে ফেলেন, ফলস্বরূপ তখন সিম্প্যাথেটিক নার্ভ গুলোও সরে যায় এবং চুলের ফলিকল স্টেম সেলগুলির সাথে নার্ভের সংযোগ নষ্ট হয়ে যায়। এ থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছান, চুলের ফলিকলের সাথে সিম্প্যাথেটিক নার্ভের সংযোগে পেশী টিস্যু প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সহায়তা দেয়।
চুলের ফলিকল নিয়ে গবেষণা করার সময় বিজ্ঞানীরা দেখেন যে, এই ফলিকল স্টেম সেল গুলো স্নায়ু নিউরোট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সক্রিয় হয় ও এর মাধ্যমে নতুন চুলের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হয়।
হু ল্যাবের পোস্টডক্টরাল ফেলো ইউলিয়া শোয়ার্টজ বলেছেন, “আপনি চুলের ফলিক স্টেম সেলগুলো বিভিন্ন উপায়ে নিয়ন্ত্রিত করতে পারেন এবং টিস্যু পুনর্জন্মের গবেষণা করার জন্য এগুলো দুর্দান্ত মডেল”। “এই বিশেষ প্রতিক্রিয়াটি টিস্যু পুনর্জন্মের জন্য বাইরের পরিবেশেঃ যেমন তাপমাত্রার পরিবর্তনের সাথে সহায়ক। এটি একটি দ্বি-স্তরের প্রতিক্রিয়া: স্বল্পমেয়াদে কিছুটা স্বস্তির ব্যবস্থা করার জন্য শিহরণ একটি দ্রুত উপায়। কিন্তু যখন ঠান্ডা পরিস্থিতি স্থায়ী হয়, তখন এই কোষ গুলো চুলের বৃদ্ধিতে কাজ করে।”
আমরা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল পরিবেশে বাস করি। চামড়া যেহেতু সর্বদা বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শে থাকে, তাই এটি গবেষণার করার সুযোগ দেয় যে, পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের দেহের কোষগুলো কীভাবে টিস্যু উৎপাদন করে ও প্রতিক্রিয়া দেয়। গবেষকরা তাই আশাবাদী এই গবেষণা ভবিষ্যতের রিসার্চ গুলোর ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মাইশা আমিন/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ health.harvard.edu, সাইন্সডেইলি, huffpost
+1
8
+1
3
+1
1
+1
7
+1
6
+1
2
+1
2