নিঃসন্দেহে জলবায়ু পরিবর্তন একটি খুব গুরুতর এবং ক্রমবর্ধমান সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকারী প্যানেলের (আইপিসিসি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সমস্ত শিল্পোন্নত দেশগুলি যদি রাতারাতি কার্বন নিরপেক্ষ হয়ে যায় তবে সমস্যাটি আরও বাড়তে থাকবে। এর সমাধান হিসেবে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড এর নিঃসরণ বন্ধ করা যথেষ্ট নয় বরং ইতিমধ্যে যতটুকু আছে এখানে তা অপসারণ করতে হবে। এখানেই কার্বন অপসারণ নামে পরিচিত কৌশলটি কার্যকর হয়।
প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া কে কাজে লাগিয়ে অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয় ও ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি আন্তর্জাতিক দল একটি কৃত্রিম পাতা তৈরি করেছে যা বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাই অক্সাইডকে জ্বালানিতে পরিণত করতে সক্ষম। এই দলটির নেতৃত্বে ছিলেন ইলিনয়ের আর্গোন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে (এএনএল) সেন্টার ফর ন্যানোস্কেল মেটেরিয়ালসের গবেষক এবং ন্যানো টেকনোলজির জন্য ওয়াটারলু ইনস্টিটিউট (ডব্লিও এন আই)- এর প্রকৌশল অধ্যাপক ইয়িমিন এ উ। বায়ুমণ্ডলীয় CO2 কে পাতা নিজের জন্য জ্বালানীর উৎসে পরিণত করার পরিবর্তে, এটিকে একটি দরকারী বিকল্প জ্বালানিতে রূপান্তরিত করে।
এটিকে কৃত্রিম পাতা বলার কারণ হলো, এটি আসল পাতার মতো সালোকসংশ্লেষণের প্রক্রিয়াটিকে অনুকরণ করে একটি প্রাকৃতিক পাতার মতো গ্লুকোজ এবং অক্সিজেন উৎপাদন করে।
প্রক্রিয়াটির মূল চাবিকাঠি হলো কপার অক্সাইড, একটি সস্তা লাল পাউডার যা রাসায়নিকভাবে যতটা সম্ভব আট-পার্শ্বযুক্ত কণা। এই পাউডার রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্বারা তৈরি করা হয় যখন গ্লুকোজ, তামা অ্যাসিটেট, সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড এবং সোডিয়াম ডোডেকাইল সালফেট একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে থাকে এমন পানিতে যুক্ত করা হয়।
এই পাউডারটি পানির সাথে যুক্ত করা হয়, যেখানে এটি অনুঘটক হিসাবে কাজ করে, পাম্পকৃত কার্বন ডাই অক্সাইড এবং একটি সৌর সিমুলেটরের উপস্থিতিতে প্রাপ্ত রাসায়নিক বিক্রিয়া অক্সিজেন গ্যাস তৈরি করে (সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে) আর CO2 , পানি এবং গুঁড়ো দ্রবণটি মিথানলে রূপান্তরিত হয়। এই বিক্রিয়ায় দ্রবণে একটি সাদা উজ্জ্বল আলোক রশ্মি দেখা যায়। যেহেতু মিথানলের পানির তুলনায় নিম্ন ফুটন্ত পয়েন্ট থাকে তাই দ্রবণটি উত্তপ্ত হয়ে যায় এবং মিথানলটি বাষ্প হওয়ার সাথে সাথে সংগ্রহ করা হয়।
এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত একই রকম একটি গবেষণায় গবেষকরা এমন একটি ডিভাইস তৈরি করেছেন যেটি সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত সূর্যরশ্মি এবং কোবাল্ট আলোক-শোষণ করে পানি এবং CO2 গ্যাসে রূপান্তর করতে পারে। এই পদার্থটি হাইড্রোজেন এবং কার্বন মনোক্সাইডের মিশ্রণ থেকে তৈরি হয় এবং বিকল্প জ্বালানী, ওষুধ, প্লাস্টিক এবং সার ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
এটি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেনফেস্ট সেন্টার ফর টেকসই শক্তির পরিচালক, ক্লাউস ল্যাকনার দ্বারা নির্মিত ” কৃত্রিম গাছ ” ধারণার সাথেও সাদৃশ্য রয়েছে। কয়েক বছর আগে, ল্যাকনার এমন একটি পদ্ধতি প্রস্তাব করেছিলেন যেখানে রেজিন-প্রলেপযুক্ত প্লাস্টিকের পাতা সহ গাছ প্রাকৃতিক গাছের চেয়ে প্রায় 100 গুন CO2 বাতাস থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে। পাতাগুলি যত পারে তত কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে জ্বালানী তৈরি করে।
এই প্রক্রিয়াটি দুটি কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণঃ
প্রথমত, বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড (গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রাথমিক অবদানকারী) অপসারণ করে জলবায়ু পরিবর্তনকে ধীর করতে সহায়তা করবে।
দ্বিতীয়ত, বিকল্প জ্বালানীর সাহায্যে বৈদ্যুতিক অটোমোবাইলগুলির ব্যবহার বাড়ানো যায়, যা জ্বালানীনির্ভর যানবাহনের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাবে।
যেমন, ইউ ইউনিভার্স টুডে ইমেলের মাধ্যমে বলেছেন:
“এই প্রযুক্তিটি তেল,অটোমোবাইল এবং ইস্পাত শিল্প সংশ্লিষ্ট সংস্থা গুলোর কাছ থেকে CO2 নির্গমন হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি যানবাহন এবং বিমানের জন্য পরিষ্কার এবং টেকসই জ্বালানী, মিথানল সরবরাহ করতে পারে। প্লাস্টিক এবং তন্তু তৈরির জন্য মিথানল রাসায়নিক শিল্পের একটি সম্বনয় মাধ্যম। এটি CO2 নির্গমন হ্রাস করার এবং সবুজ অর্থনীতির জন্য টেকসই জ্বালানির উৎপাদন করার সমাধান সরবরাহ করে”।
“ভবিষ্যতে, মিথানল উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পেটেন্ট প্রক্রিয়াটির বাণিজ্যিকীকরণের জন্য অতিরিক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে যাতে এটি শিল্প উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন একটি জরুরি সমস্যা এবং আমরা বিকল্প জ্বালানী তৈরি করার সময় CO2 নির্গমন হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারি।”
কৃত্রিম এবং প্রাকৃতিক পাতার সালেকসংশ্লেষনের মধ্যেই একটি পার্থক্য তুলে ধরা হলোঃ
প্রাকৃতিক পাতার সালোকসংশ্লেষণঃ
•জৈবিক সালোকসংশ্লিষ্ট একটি জটিল অনুঘটক প্রক্রিয়া যা আলোক শোষণ এবং শক্তি রূপান্তরকরণের জন্য প্রতিক্রিয়া কেন্দ্র, কোফ্যাক্টর এবং পিগমেন্টস (ক্লোরোফিলস এবং ক্যারোটিনয়েডস) সহ প্রোটিন উপাদানগুলির সাথে জড়িত।
•মাল্টিস্টেপ হালকা এবং গাড় অন্ধকার প্রতিক্রিয়ার নেট ফলাফল হিসাবে CO2 বায়োমাস এবং শক্তি সমৃদ্ধ বায়োমোলিকুল যেমন কার্বোহাইড্রেট এবং অন্যান্য গুলিকে পুনব্যবহারযোগ্য করে তোলে।
•সমস্ত প্রতিক্রিয়া পিএস আই এবং পিএস কমপ্লেক্সের মতো সু-সংগঠিত হালকা সংগ্রহের উপাদানগুলিতে করা হয়।
কৃত্রিম পাতার সালোকসংশ্লেষণঃ
•কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণ একটি প্রক্রিয়া যার জন্য আলোক শোষণকারী রাসায়নিক বা ছোপানো রেণুগুলির প্রয়োজন যা রাসায়নিকভাবে উদ্ভূত শক্তি রূপান্তর করতে সহায়তা করে।
•কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণের ক্ষেত্রে, সাধারণ অণু বিভক্ত হওয়ার থেকে চার্জ পৃথক হওয়ার ফলে হাইড্রোজেন, মিথানল এবং অ্যামোনিয়া জাতীয় উচ্চমানের যৌগের উৎপাদন ঘটে।
•H2O, CO2 বিভক্ত হওয়া এবং হাইড্রোজেনের মতো উচ্চমূল্যের পণ্যগুলির উৎপাদন একটি অনুঘটক চালিত জটিল প্রক্রিয়া।
•কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণে, তাত্ত্বিক সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করা যায় যা প্রায় 10%।
কৃত্রিম পাতার অসুবিধাঃ
কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণের লক্ষ্য হলো ফাংশনাল ইউনিটে সংহত মডুলার সিস্টেমগুলি বিকাশ করা যেখানে চার্জ পৃথকীকরণের পরে আলোক শোষণের তিনটি প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া অবশেষে জ্বালানী গঠনের দিকে পরিচালিত হয়। উচ্চতর সৌরশক্তির দক্ষতা অর্জনের জন্য কৃত্রিম আলোকসংশ্লিষ্ট সিস্টেমের দক্ষতা এবং ইতিমধ্যে সফলভাবে ফটোইলেক্ট্রোক্যামিক্যাল H2O বিভাজন প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে 30% এর গড় দক্ষতা অর্জন করেছে। কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণের প্রধান সুবিধাটি হলো এই সিস্টেমগুলি সহজেই নিরীক্ষণ করা যায় এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য হয়। কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণে, কাঁচামাল (যেমন অনুঘটক এর জন্য ধাতু) এবং উৎপাদন পদ্ধতি (যেমন, বহু স্তর কৃত্রিম পাতা) খুব ব্যয়বহুল। যদিও, কার্বন-ভিত্তিক পণ্য (CH3OH, C2H4, CO ইত্যাদি) প্রাপ্তির জন্য আরও কার্যকর এবং ব্যবহারযোগ্য জিনিসগুলি স্বীকৃত কাঁচামাল হিসাবে CO2 না পাওয়ার কারণে শক্তিশালী হিসাবে এখনও কার্যকর নয়।
কৃত্রিম পাতার ব্যবহার অনেক ব্যয়বহুল হলেও এটি বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করব
আসমা আকতার/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ ফাস্টকোম্পানি , scitechdaily , ক্লাইমেট সেন্ট্রা্ল, রিসার্চগেট, সায়েন্স ডিরেক্ট, ইউনিভার্স টুডে
ছবিঃ রিসার্চগেট
+1
3
+1
+1
+1
+1
1
+1
+1