গবেষকরা ল্যাবে E.coli ব্যাকটেরিয়ার একটি প্রজাতি তৈরি করেছেন যা শর্করা বা অন্যান্য জৈব অণুর পরিবর্তে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে বৃদ্ধি পায়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই কৃতিত্ব একটি ধারাবাহিক গবেষণার ফল, কারণ এটি জীববিজ্ঞানের অন্যতম জনপ্রিয় মডেল জীবের অভ্যন্তরীণ কাজকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। ভবিষ্যতে কার্বন ডাই-অক্সাইড রুপান্তরে সক্ষম E.coli ব্যাকটেরিয়া জৈব কার্বন অণু তৈরিতে ব্যবহৃত হতে পারে যা বায়োফুয়েল হিসাবে বা খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। এইভাবে তৈরি পণ্যগুলিতে প্রচলিত উৎপাদন পদ্ধতির তুলনায় কম কার্বন নির্গমন হবে এমনটাই আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। এই গবেষণাপত্রটি ২৭ নভেম্বর ২০১৯ ‘সেল‘ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
উদ্ভিদ এবং সালোকসংশ্লেষী সায়ানোব্যাকটেরিয়া (জলজ অনুজীব যা অক্সিজেন উৎপাদন করে) আলোক শক্তির সাহায্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে ডিএনএ, প্রোটিন এবং চর্বির মতো কার্বনযুক্ত জৈব উপাদান গুলোতে রূপান্তর করতে ব্যবহার করে। তবে এই জীবগুলো কে জিনগতভাবে সংশোধন করে বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্টরিতে রুপান্তর করা কঠিন।
বিপরীতে, E. coli ব্যাকটেরিয়াকে ল্যাবে মডিফাই করা তুলনামূলকভাবে সহজ, এবং এর দ্রুত বর্ধন ক্ষমতার জন্য ডিএনএ রেপ্লিকেশনের ফলাফল বেশ দ্রুত পাওয়া যায়, যা গবেষণার জন্য অনুকূল। তবে ব্যাকটেরিয়া, চিনির মতো শর্করার উপরে বৃদ্ধি পেতে পছন্দ করে এবং CO2 গ্রহণের পরিবর্তে গ্যাসটিকে বর্জ্য হিসাবে নির্গত করে।
ইসরায়েলের রেহোভোটের, ওয়েজম্যান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের জীববিজ্ঞানী, রন মিলো এবং তার দল গত দশক ধরে E.coli এর খাদ্যতালিকা পরিবর্তন করার চেস্টা করেছিলো। ২০১৬ সালে, তারা একটি ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতি তৈরি করেছিল যা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রাস/ ভক্ষণ করেছিল, তবে যৌগটি কার্বনের সামান্য অংশ গ্রহণ করেছিলো- বাকীটা গ্রহণ করেছিলো একটি জৈব যৌগ যাকে পাইরুভেট বলে।
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে, মিলো এবং তার দল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে E. coli এর একটি প্রজাতি তৈরি করেছিল যা এর সমস্ত কার্বন ‘কার্বন ডাই-অক্সাইড’ থেকে পেতে পারে। প্রথমত, তারা ব্যাকটেরিয়ামে সালোকসংশ্লেষণের জিন যুক্ত করেন।
কিন্তু উদ্ভিদ এবং সায়ানোব্যাকটেরিয়া আলোর উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষণ করলেও E. coli এর পক্ষে এটি সম্ভব ছিল না। পরবর্তীতে, মিলোর দল ব্যাকটেরিয়াগুলোতে এমন একটি জিন প্রবেশ করিয়েছিল যা ফর্মেট নামক জৈব অণু থেকে শক্তি গ্রহণ করতে সাহায্য করে।
এরপরেও ব্যাকটেরিয়ামগুলো কার্বন ডাই-অক্সাইড এর পরবর্তে চিনিযুক্ত খাদ্য বিনিময় করতে পারছিলো না। এই জিন সম্পর্কে আরও জানতে গবেষকরা এক বছরের জন্য সংশোধিত E. coli এর ধারাবাহিক প্রজন্মকে পরিবর্তিত করেছিলেন, এবং তাদেরকে খুব কম পরিমাণে চিনি এবং পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের প্রায় ২৫০ গুণ বেশি ঘনত্বের CO2 দেওয়া হয়েছিলো।
তারা আশা করছিলেন এই নতুন খাদ্যাভ্যাস এর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যাকটেরিয়াগুলি তাদের পরিবর্তন ঘটাবে। প্রায় ২০০ দিন পরে, কার্বন উৎস থেকে কোষগুলো কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করতে সক্ষম হয় এবং ৩০০ দিন পরে, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো CO2 গ্রাস করতে পারে না এমন ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
মিলো বলেছেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহন করা E. coli ব্যাকটেরিয়া গুলো এখনও চিনি থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে পারে, আবার পছন্দ অনুযায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইডের উৎস ব্যবহার করে। সাধারণ E. coli ব্যাকটেরিয়ার সাথে তুলনা করে দেখা গিয়েছিলো যে এরা প্রতি ২০ মিনিটে সংখ্যায় দ্বিগুণ হতে পারে, স্ব ভোজী E. coli ব্যাকটেরিয়াসমূহ সে তুলনায় মন্থরগতি সম্পন্ন হয়। এরা ১০% কার্বন ডাই-অক্সাইড সম্পন্ন বায়ুমন্ডলে প্রতি ১৮ ঘন্টায় বিভক্ত হয়।
মিলো এবং তার দল আশা করে তাদের ব্যাকটেরিয়াগুলি দ্রুত বাড়বে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে বেঁচে থাকবে। তারা আরও জানার চেষ্টা করছেন, শুধুমাত্র ১১ টি জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে E.coli কিভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহন করে বৃদ্ধি পায়।
পূর্ব ল্যানসিংয়ের মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স বেরকেলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির একজন বায়োইনজিনিয়ার, চেরিল কেরফিল্ড বলেছেন, কাজটি মিশ্র ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রাকৃতিক বিবর্তনের শক্তি দেখায়।
ইতিমধ্যে, E.coli ব্যাকটেরিয়া ইনসুলিন এবং মানব বৃদ্ধির হরমোনের মতো দরকারী রাসায়নিকের কৃত্রিম সংস্করণ তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়েছে। মিলো বলেছেন, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো থেকে তৈরি করা সম্ভব এমন পণ্য উদ্ভাবনে কাজ করছে তার দল, যাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানী, খাদ্য এবং অন্যান্য পদার্থ অন্তর্ভুক্ত থাকবে । তবে ব্যাকটেরিয়াটি এসকল ক্ষেত্রে প্রয়োগের আগে আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন। খুব শীঘ্রই এটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।
রিয়া আক্তার হিমা/ নিজস্ব প্রতিবেদক