মানব মস্তিষ্কের চেয়ে দ্রুতগামী এবং জটিল কোনো কম্পিউটার পৃথিবীতে নাই। মানুষের মস্তিষ্কে বিদ্যমান স্নায়ুটিস্যু গুলো যে পরিমাণ তথ্য এবং যে গতিতে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে সেই গতি বা পরিমাণ কোনোটাই এখনো কম্পিউটার দ্বারা সম্ভব হয়ে উঠেনি। মস্তিষ্কের এত শক্তিমত্তার কারণ হল নিউরন; যা মস্তিষ্কে প্রসেসর এবং মেমোরি দুইটা ইউনিট হিসেবেই কাজ করে। অন্যদিকে কম্পিউটারে মেমোরি এবং প্রসেসর হিসেবে আলাদা আলাদা ডিভাইস সংযুক্ত থাকে।
বিজ্ঞানীরা কম্পিউটারকে মস্তিষ্কের স্তরে উন্নীত করার জন্য বহু চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্লুমিংটন এর গবেষক ফেং গুয়া ও তার দলের এক আবিষ্কারের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টা একধাপ এগিয়েছেন। তারা মানব মস্তিষ্কের কোষ নিয়ে বৈদ্যুতিক চিপের সাথে সমন্বিত করে Brainoware নামে এক নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করছেন।
নেচার ইলেক্ট্রনিক্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা পত্রে তারা দাবি করেছেন, তাদের এই যন্ত্র তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে, শিখতে পারে এবং মনেও রাখতে পারে। এমনকি এই যন্ত্র কিছু সাধারণ বক্তব্য জমা রাখতে পারে, যে ধরনের বক্তব্য পুনরায় শনাক্ত করতে পারে। যদিও এই চিপের ফলাফল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন চ্যাটবটের মত অতটা নির্ভুল না, তবুও কম্পিউটার এর সাথে মানব টিস্যু সমন্বিত করার সম্ভাবনা আগামীর জন্য আশার আলো জাগাচ্ছে।
ফেং গুয়া বলেন,
“কম্পিউটিং এর ক্ষেত্রে এই ধরনের কোষ ব্যবহার করা এই প্রথম। এটা ভেবে আমরা খুব আনন্দিত যে, এই সিস্টেমের মধ্যে আমরা বায়ো-কম্পিউটারের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। এই ধরনের কম্পিউটার গুলো সিলিকন ভিত্তিক কম্পিউটারের কিছু সীমাবদ্ধতা; যেমন: তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম।
সাধারণ কম্পিউটার যেহেতু বিট নিয়ে কাজ করে তাই সংখ্যা সূচক কাজে এর পারদর্শিতা মানব মস্তিষ্কের চেয়ে বেশি, কিন্তু তুলনামূলক কম শক্তি ব্যয় করে আরও জটিল তথ্য প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে মানব মস্তিষ্ক এগিয়ে থাকবে।”
Brainoware প্রযুক্তি তৈরি করার জন্য ফেং গুয়া ও তার দল মস্তিষ্কের অর্গানয়েড(Brain Organoid) দিয়ে অর্গানোইড নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। সেরিব্রাল অর্গানয়েড বা ব্রেন অর্গানয়েড হল একটি ত্রিমাত্রিক বিন্যাস যা মানব মস্তিষ্কের স্টেম কোষ থেকে উদ্ভূত। এই বিন্যাস মানব মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যপ্রণালি অনুকরণ করতে সক্ষম এবং নিজে নিজে বিকাশ করতে সক্ষম।
স্টেম কোষ হল এমন কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কোষ, যা নিজে নিজেই মানব দেহের অন্য যে কোনো ধরনের কোষে পরিণত হতে পারে। অর্গানয়েড নিউরাল নেটওয়ার্ক হল অনেকগুলো ব্রেন অর্গানয়েড এর সমষ্টি যা মাইক্রোইলেক্ট্রোড এ্যারে’তে যুক্ত থেকে মস্তিষ্কের নিউরনের অনুরূপ একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এটি সিলিকন চিপ দিয়ে তৈরি কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
Brainoware এর জন্য ফেং গুয়া ও তার দলের লক্ষ্য ছিল আসল মস্তিষ্কের কোষ ব্যবহার করে তথ্য আদান প্রদান করা। এই জন্য তারা তাদের তৈরি হাইব্রিড সিস্টেমে তড়িৎ সংকেত প্রেরণ করেন। তারা লক্ষ্য করেন Brainoware এই সংকেতগুলোর বিপরীতে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে এবং নিউরাল নেটওয়ার্কগুলোর মাঝে কিছুটা পরিবর্তনও ঘটেছে। গবেষকদের দাবি অনুযায়ী, এই পরিবর্তনটি ইঙ্গিত দেয় যে এই সিস্টেমটি তথ্য প্রক্রিয়া করছে এবং এমনকি কোনো ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই এই সিস্টেম কাজ করতে সক্ষম।
Brainoware এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য ফেং গুয়া ও তার দল কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। প্রথমত তারা কিছু গাণিতিক সমীকরণ সমাধান করতে দেন এবং এটি ঠিকঠাক মত সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া বক্তব্য শনাক্তকরণের মাপকাঠি হিসেবে তারা এই সিস্টেমে আট জন জাপানি ভাষাভাষী মানুষের ২৪০ টি অডিও ক্লিপ প্রদান করে।
এই অডিও ক্লিপগুলোকে তড়িৎ সংকেতে রূপান্তরিত হয়ে Brainoware এর মধ্যে প্রবেশ করে এবং অর্গানয়েড নিউরাল নেটওয়ার্কে উৎপন্ন সংকেত গুলো পুনরায় ডিকোডিং এর জন্য একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেমে প্রবেশ করানো হয়। গবেষকরা লক্ষ্য করেন যে Brainoware অডিও ক্লিপের সংকেতগুলোকে ডিকোড করতে পারে, যা বক্তব্য শনাক্তকরণের একটি রূপ।
ফেং গুয়া জানান,
“যদিও এর নির্ভুলতার হার অনেক কম। প্রাত্যহিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এটি শতকরা প্রায় ৭৮ ভাগ নির্ভুল উত্তর দেয়, তবুও এটি কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের তুলনায় এখনো কম।”
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক লেনা স্মিরনোভা উল্লেখ করেন যে,
“মস্তিষ্কের অর্গানয়েডের সত্যিকার অর্থে কথা শুনার মতো কোনো সক্ষমতা নাই কিন্তু তারা অডিও ক্লিপগুলোর তড়িৎ সংকেতের প্রতি এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।”
এই আবিষ্কারের এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন: অর্গানয়েডটি সচল রাখা, সংশ্লিষ্ট যন্ত্রগুলোর শক্তি খরচের মাত্রা ইত্যাদি। তবুও বিজ্ঞানীরা আশা করছেন এই যন্ত্র বায়ো-কম্পিউটার সিস্টেমের দিকে আমাদের একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। গবেষকরা এই সিস্টেমের উন্নতির পাশাপাশি মানব মস্তিষ্কের রহস্য উন্মোচনেও সাহায্য করবে বলে মনে করেন।
মোহাম্মদ রিফাতুল ইসলাম মারুফ / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: নিউরোসায়েন্সনিউজ, সায়েন্সএলার্ট, টেকনোলজি রিভিউ