চোখ, মাথা কিংবা শরীর ব্যথা নিয়ে অভিযোগ করতেই মায়েদের মুখে একটা কমন ডায়ালগ হয়তো আমরা সবাই কমবেশি শুনেছি- “আরও বেশি চালাও ফোন”। অর্থাৎ, সমস্যা যাই হোক না কেন সব দোষ বেচারা ফোনের। কেমন হবে যদি পালটা জবাবে সব দোষ উলটো বাবা-মায়ের ঘাড়েই চাপিয়ে দেয়া যায়? কেননা সম্প্রতি মানব কঙ্কালতন্ত্র এর ওপর রচিত একটি গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবরসায়নের গবেষক ইউক্যারিস্ট কুন (Eucharist Kun) কিন্তু দাবি করছেন আমাদের দেহরোগের ঝুঁকি বাড়ায় কঙ্কালতন্ত্র এর গঠন।
গবেষকদের মতে, মানবদেহের কঙ্কালতন্ত্র এর গঠনই বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় সমস্যা যেমন ঘাড়, পিঠ ও হাঁটু ব্যথা, অস্টিওপরোসিস কিংবা আর্থ্রাইটিসের মতো সমস্যাগুলোর জন্য দায়ী। আর কঙ্কালতন্ত্র এর এই গঠন তো জিনগতভাবে বাবা-মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া তাই না?
গবেষণা দলটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইউনাইটেড কিংডম বায়ো ব্যাংকের অংশগ্রহণকারীদের ৩৯,০০০ টি এক্সরে বিশ্লেষণ করে মানব কঙ্কালের অনুপাতের একটি জিনগত মানচিত্র দাঁড় করাতে সক্ষম হয়। এর ফলে জানা যায়, কঙ্কালের বিভিন্ন অংশের এই অনুপাত জিনগত ফ্যাক্টর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এছাড়া প্রক্রিয়াটি ১৪৫ টি জিনগত অঞ্চল চিহ্নিত করে যা কঙ্কালের বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। এদের মধ্যে সামান্য কিছু বাদে বাকি সবগুলো অঞ্চল এতোদিন পর্যন্ত অজানা ছিল।
মানব কঙ্কালের অনুপাতের বিষয়টি সম্পর্কে একটু বলা যাক। আমাদের শরীরের প্রতিটি অংশের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের মোটামুটি একটি নির্দিষ্ট অনুপাত রয়েছে। যেমন বাহুর হাড়ের (হিউমেরাস) অনুপাতে ঊরুর হাড় (ফিমার– মানবদেহের সবচেয়ে বড় হাড়) তুলনামূলক বড়, যার ফলে আমরা দুই পায়ে দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারি। তেমনভাবে কাঁধ, কোমর, নিতম্ব প্রতিটা অংশের হাড় একটির তুলনায় অপরটি ছোট-বড়, সরু কিংবা চওড়া। এটি দেহকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার উপযুক্ত আকৃতি প্রদান করে।
তবে হাড়ের এই অনুপাত সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। কারও কাঁধ দেহের অনুপাতে চওড়া, কারও বাহুর তুলনায় ঊরুর হার অনুপাতে অধিক লম্বা, কারও আবার নিতম্বের হাড় তুলনামূলক বেশি প্রশস্ত। কঙ্কালের এই বৈশিষ্ট্য গুলো একজন তার বাবা-মায়ের কাছ থেকেই বংশানুক্রমিকভাবে পেয়ে থাকে। সুনির্দিষ্ট কিছু জিন দেহের এই বৈশিষ্ট্য গুলো বাবা-মা থেকে সন্তানে স্থানান্তর এবং নিয়ন্ত্রণ করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে,এই বংশানুক্রমিকভাবে কঙ্কালতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরে সমস্যা কোথায়?
আমাদের শারীরিক গঠনসহ দৈহিক সকল বৈশিষ্ট্যই জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর প্রতিটা জিন আমরা পেয়ে থাকি বাবা-মায়ের কাছ থেকেই- এ তো পুরোনো কাসুন্দি। তবে উক্ত গবেষণা আমাদের জানাচ্ছে মানব কঙ্কালের এই অনুপাত আর্থ্রাইটিস, অস্টিওপরোসিস এমনকি অতি সাধারণ যে পিঠ, কোমর, কাঁধ কিংবা হাঁটুর ব্যথা এসবের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলতে পারে। অর্থাৎ, কেবল জীবনযাত্রার ধরন, দীর্ঘমেয়াদি অভ্যাস কিংবা কোনো দুর্ঘটনাই নয়- এসমস্ত রোগ আমরা পেতে পারি বংশানুক্রমিকভাবেও!
দৈহিক উচ্চতার তুলনায় প্রশস্ত কাঁধ হতে পারে পিঠে ব্যথা হওয়ার অন্যতম কারণ। উচ্চতার তুলনায় চওড়া নিতম্বের অধিকারীরা ভুগতে পারেন অস্টিওপরোসিস কিংবা কোমর ব্যথায়। আবার যাদের ঊরুর হাড় তুলনামূলক বেশি লম্বা তাদের হাঁটু ব্যথা কিংবা আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি। যেহেতু শারীরিক এই গঠন জিনগত তাই এসবের জন্য মা-বাবাকে দায়ী করাই যায়।
গবেষণাটি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করে এবং তা হচ্ছে কীভাবে আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রায় ছয় মিলিয়ন বছর পূর্বে ঘটিত বিবর্তনের ফলে হাতের তালু ও পায়ের পাতায় ভর করে চলা থেকে দুই পায়ে ভর করে হাঁটা শিখলেন। আমরা জানি, প্রাইমেটরা পায়ের পাতা ও হাতের তালুর সাহায্যে অনেকটা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে চলাফেরা করতো। তবে হোমিনিডরাই (আদি মানবগোষ্ঠী) একমাত্র প্রাইমেট যাদের বাহুর তুলনায় লম্বা পা রয়েছে। যা পরবর্তীতে তাদের দুই পায়ে চলতে শিখতে সক্ষম করেছে।
দুই পায়ে চলতে পারার এই শিক্ষা আদি মানবগোষ্ঠীকে প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যাপক সাহায্য করে। তারা তাদের বাহু উন্মুক্ত করতে এবং হাত ব্যবহার করে কোনোকিছু ধরতে শেখে। এভাবেই প্রাইমেট থেকে হোমিনিড এবং হোমিনিড থেকে বর্তমান সভ্য মানুষের আগমন ঘটে।
গবেষকগণ দেখেছেন যে কঙ্কালের অনুপাত নিয়ন্ত্রণকারী বেশ কয়েকটি জিনগত বিভাগ মানব ত্বরিত অঞ্চল (Human Accelerated Region) নামে পরিচিত জিনোমের ক্ষেত্রগুলোর সাথে আশাতীত হারে ওভারল্যাপ করে। এই জিনগত বিভাগ গ্রেট এপ (grate ape) এবং অন্যান্য অনেক মেরুদণ্ডী প্রাণী থেকে প্রাপ্ত জিনোমের অংশ। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এই জিনগত বিভাগ সেভাবে ওভারল্যাপ করেনি বরং উল্লেখযোগ্যভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর ফলেই মানব কঙ্কালতন্ত্রে প্রাইমেটদের তুলনায় অনেকটা পরিবর্তন চলে আসে যা হোমো সেপিয়েন্সের বিবর্তনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজির সহকারী অধ্যাপক ড. ভাঘীশ নরসিমহান বলেন,
“আমরা যা পেয়েছি তা হলো প্রথম জিনগত প্রমাণ যেটি নির্দেশ করে জেনেটিক ভ্যারিয়েন্টের ওপর একটা নির্বাচনী চাপ ছিল যা কঙ্কালের অনুপাতকে প্রভাবিত করে। যেটি মানুষকে হাঁটুভিত্তিক হাঁটা থেকে দ্বিপদ চলাচলে প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়”।
“কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরাও একই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি যা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি কেও ভাবিয়েছিল ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান‘ নামক তার মহান সৃষ্টির প্রাক্কালে- মানুষের মৌলিক রূপ ও অনুপাত কী? তবে আমরা আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে এই রহস্যের একটি উপযুক্ত সমাধান দাঁড় করাতে যাচ্ছি এবং বলা ই বাহুল্য সেটি মানুষের জিনের ওপর ভিত্তি করেই।”
সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্র নিঃসন্দেহে শারীরবিজ্ঞানে এক অনন্য অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে, মানব কল্যাণে এটি যথাযথ অবদান রাখবে বলেই সকলের প্রত্যাশা।
তাসমিয়া আহমেদ হিয়া / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: রোর মিডিয়া, দ্যা টেলিগ্রাফ