যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় গতকাল দুপুরের খাবারে আপনি কী খেয়েছিলেন? কোথায় ছিলেন? আশেপাশে কী ছিল মনে করতে পারেন? তিনি কোনো না কোনো উত্তর অবশ্যই দিতে পারবেন। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় অতীতের কোনো স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া, সে সময়ের ছোট খাটো তথ্য মনে রাখার ক্ষমতাকে বলা হয় ‘এপিসোডিক মেমোরি’ (Episodic Memory)। কেমব্রিজ এবং সিঙ্গাপুরের গবেষকদের নতুন একটি অনুসন্ধানে পাওয়া উপাত্ত মতে মানুষের পাশাপাশি ‘ইউরেশিয়ান জে’ (Eurasian Jay) নামের পাখিও এই অনন্য ক্ষমতার অধিকারী।
ইউরেশিয়ান জে (Garrulus glandarius) হলো কাক পরিবারের Corvidae প্রজাতির ‘প্যাসারিন’ পাখি। এরা বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান পাখিদের মধ্যে একটি। এটি একটি বনভূমির পাখি। এদেরকে পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং তারও পূর্বের এশিয়ার সমুদ্র তীর পর্যন্ত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও দেখা যায়।
অতীতের কোনো মুহূর্ততে ফিরে গিয়ে সেটাকে অনুধাবন করা বা ভবিষ্যতের কোনো কল্পনাকে একদম নিজের ভেতর অনুভব করার ক্ষমতাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় “মানসিক সময় ভ্রমণ” বা ‘Mental Time Travel’।
মানসিক সময় ভ্রমণ হলো এপিসোডিক মেমোরি এর একটি অংশ বা কোনো ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতির একটি রূপ। দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি বা semantic memory যেমন বিভিন্ন তথ্য এবং উপাত্ত মনে রাখতে দেয়, এপিসোডিক মেমরি ঠিক সেটা করে না। বরং এটি অতীতের এমন কোনো দৃশ্য বিস্তারিত স্মরণ করতে দেয় যা সেই সময়ে নোট করার মতো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না।
যদিও এপিসোডিক মেমোরি যেকোনো মানুষের অভিজ্ঞতা অর্জন করার প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, বিজ্ঞানীদের পক্ষে এটা প্রমাণ করা কঠিন যে মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীদের এই ক্ষমতাটি আছে কিনা। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবেই ইউরেশিয়ান জে-দের চমৎকার স্মৃতিশক্তি রয়েছে। তারা বাদাম এবং লার্ভা জাতীয় খাবারসমূহ ভবিষ্যতে খাওয়ার জন্য লুকিয়ে রাখে। তাই এই খাবার লুকানোর জায়গা, সময় ইত্যাদি মনে রাখা তাদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটিই গবেষকদের জানতে আগ্রহী করে তোলে যে ইউরেশিয়ান জে মানুষের মতো অতীতের স্মৃতি পুনরায় দেখতে পারে কিনা।
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নিকোলা ক্লেটনের নেতৃত্বে গবেষণা দলটি সাতটি জে পাখি নিয়ে একটি পরীক্ষণ তৈরি করে। পাখিগুলোকে প্রথমে চারটি একই রকম দেখতে কাপ দেখানো হয় যার কোনো একটির নিচে খাবার লুকানো ছিল। তাদেরকে একটা লাইনে কাপগুলোর অবস্থান অনুযায়ী লুকিয়ে রাখা খাবার শনাক্ত করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপরে, দলটি প্রতিটি কাপে ভিজ্যুয়াল মার্কার দিয়ে চিহ্ন দিয়ে একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করে। কিন্তু পরীক্ষণের এই ধাপে এমনভাবে কাপগুলোকে সাজানো হয় যেন মার্কারের চিহ্ন খাদ্যের অবস্থানের উপর কোন প্রভাব না ফেলে। ফলে পাখিরা কার্যকরভাবে এই তথ্য উপেক্ষা করতে শিখে।
এরপর শুরু হয় আসল পরীক্ষা। এই ধাপে গবেষকরা আবারো পাখিদের দেখিয়ে কাপের নিচে খাবার লুকিয়ে রাখে এবং পরবর্তী ১০ মিনিটের জন্য পাখিগুলোকে সেই স্থান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। উল্লেখ্য, এই ধাপেও আগের কাপগুলোই ব্যবহার করা হয় অর্থাৎ কাপে মার্কার দিয়ে চিহ্ন দেয়া ছিল। পাখিদেরকে সরানোর পর কাপের অবস্থান আবারো পরিবর্তন করা হয়। ১০ মিনিট পর পাখিদের ফিরিয়ে এনে আবারো খাবার সহ কাপ শনাক্ত করতে দেয়া হয়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, মার্কারের চিহ্ন অনুসরণ করে ৭০% সময় পাখিরা সঠিক কাপ শনাক্ত করে!
গবেষণার প্রধান লেখক জেমস ডেভিস বলেন,
“যেহেতু জে-রা এমন কিছু ডিটেইলস মনে রাখতে পেরেছিল যেগুলোর মেমরি তৈরির সময় কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছিল না, সেহেতু এটি ইঙ্গিত দেয় যে তারা অতীতের কোনো ঘটনার আনুষঙ্গিক তথ্য রেকর্ড করতে, স্মরণ করতে এবং অ্যাক্সেস করতে সক্ষম। এটি এমন একটি ক্ষমতা যা মানুষের স্মৃতির ধরণকে চিহ্নিত করে, যার মাধ্যমে আমরা মানসিকভাবে অতীতের কোনো ঘটনা ‘পুনরুজ্জীবিত’ করি, যা ‘এপিসোডিক মেমরি’ হিসেবে পরিচিত।”
নিউজিল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েলিংটনের জীববিজ্ঞানী রেচেল শ, যিনি ইউরেশিয়ান জে-র মানসিক ক্ষমতা নিয়ে কাজ করেছেন, বলেন যে করভিড পরিবারের সকল পাখিরই যদি এপিসোডিক মেমোরি থাকে তাহলেও তিনি অবাক হবেন না।
“আমি মনে করি সমস্ত প্রমাণ তাই নির্দেশ করছে। এটা (পাখিদের এপিসোডিক মেমোরি) কি ঠিক মানুষের মতই? আমার মনে হয় না তা কখনো জানা সম্ভব।”
মানুষের এপিসোডিক মেমরি বেশ নমনীয় – এটি এমন পরিস্থিতিতেও প্রযোজ্য যার সাথে খাদ্য সংগ্রহ বা বেঁচে থাকার কোন সম্পর্ক নেই। তাই গবেষকরা পরামর্শ দেন ইউরেশিয়ান জে-র স্মৃতিশক্তি খাবার ছাড়া অন্যান্য পরিস্থিতিতেও তীক্ষ্ণ কিনা তা খুঁজে বের করার। তবে আপাতত এই গবেষণার ফলাফল আমাদেরকে সুন্দর পাখিগুলোর প্রশংসা করার আরও একটি সুযোগ করে দিচ্ছে।
শাহলীন রাহনুমা / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: অ্যাডভান্সড সায়েন্স নিউজ, সায়েন্টিফিক আমেরিকান