এইচ.আই.ভি (HIV) / এইডস- অনেকের কাছেই একটি আতঙ্কের নাম। এটি এমন এক ভাইরাসের কারণে হয় যার ফলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। প্রতিবছর এইচ.আই.ভি তে মারা যায় অসংখ্য মানুষ। এইচ.আই.ভি এর চিকিৎসা করা হয় অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ এর মাধ্যমে, যা শরীরে ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরিতে বাধা দেয় এবং ইমিউন সিস্টেমকে মেরামত করতে এবং আরও ক্ষতি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে এইচ.আই.ভি রোগের চিকিৎসা আগের চেয়ে কম জটিল এবং আরো বেশি কার্যকর হয়ে উঠেছে, কিন্তু তারপরও রোগীকে সারাজীবনের জন্য প্রতিদিন ওষুধ গ্রহণ করে যেতে হয়।
সাধারণত এইচ.আই.ভি আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতিদিন ১ টি থেকে ৪ টি করে ট্যাবলেট গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু কেমন হয় যদি আক্রান্ত ব্যক্তি প্রতি সপ্তাহে ১টি করে ওষুধ বা প্রতি মাসে নিজেই শুধুমাত্র একটি করে ইনজেকশন অথবা প্রতি ৬ মাসে একটি করে ভ্যাক্সিন গ্রহণ করে এইচ.আই.ভি এর মতো মারাত্মক রোগের চিকিৎসা করতে পারে? আশা করা হচ্ছে, আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে এমনটা সম্ভব হবে।
বিজ্ঞানীরা এইচ.আই.ভি প্রতিরোধ বা চিকিৎসায় প্রতিদিন গ্রহণযোগ্য ড্রাগ এর পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি কার্যকরী বিকল্প ড্রাগ উদ্ভাবনে এগিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন দেশেই এইচ.আই.ভি প্রায় মহামারি আকারে দেখা যায়। কিন্তু এখন এমন একটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা সম্ভব যেখানে এইচ.আই.ভি কে মহামারি আকারে নয় বরং সহজে নিরাময়যোগ্য রোগ হিসেবে দেখা যাবে।
গবেষকরা এদের দীর্ঘ কার্যকরী এজেন্ট বলে আখ্যায়িত করছেন। এদের বিভিন্ন রূপে পাওয়া যেতে পারে। ইনজেকশন বা ইমপ্ল্যান্ট বা মুখে গ্রহণ করার মতো সহজ উপায়ও আছে। এসব ওষুধের ডোজ প্রতিদিন প্রয়োজন হবে না, কারো কারো মাসিক ডোজের প্রয়োজন হতে পারে আবার কারো ক্ষেত্রে বছরে কয়েকবার গ্রহণ করলেও চলবে।
দীর্ঘমেয়াদি কার্যকরী ছোট অণু এবং মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিগুলো প্রাথমিক এবং শেষ পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় শক্তিশালী অ্যান্টি-এইচআইভি হিসেবে কাজ করছে বলে দেখা যায়। কোনো ডোজ বাদ পড়লে তার বিষাক্ততা এবং ওষুধের ঘনত্ব হ্রাস করার কৌশল, পাশাপাশি বর্তমান ওষুধ এবং মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিগুলোর প্রাথমিক ও গৌণ প্রতিরোধ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচিত হয়েছে।
যেসব জায়গায় মানুষদের কাছে সাধারণ স্বাস্থ্য পরিসেবা গুলো পৌঁছায় না, তাদের জন্য দীর্ঘকালীন এবং প্রতিদিন ওষুধ সেবন করে এইচ.আই.ভি এর চিকিৎসা সম্ভব নয়। তাই দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর এই চিকিৎসা ব্যবস্থা এইচ.আই.ভি তে মৃত্যু প্রতিরোধে বিপ্লব হতে পারে।
প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এইচ.আই.ভি আক্রান্ত রোগী ভাইরাস কে নিয়ন্ত্রণে রাখেনা। এই বছর সম্মেলনে দীর্ঘমেয়াদি নিয়মাবলির বেশ কয়েকটি গবেষণা উপস্থাপন করা হয়েছে।
একটি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা-ক্যাবেনুভা, প্রতি মাসে যার দুটি করে টিকা দেওয়া হয়, প্রায় তিন বছর ধরে পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বার্ষিক ৩৯,০০০ ডলারেরও বেশি খরচ করতে হয় এই টিকা পেতে। কিন্তু স্বল্প আয়ের দেশগুলোর অনেক রোগীরই নাগালের বাইরে। কিন্তু তাও গবেষকদের দাবি ক্যাবেনুভা– প্রতিদিন গ্রহণ করা ড্রাগের চেয়েও বেশি কার্যকর।
জিএস-6207 একটি নতুন এইচ.আই.ভি ক্যাপসিড ইনহিবিটর যা প্রতি ৩ মাস পর পর সাবকিউটেনিয়াস ইনজেকশন হিসেবে দেওয়া হয়। দীর্ঘ-কার্যকরী Cabotegravir এবং Rilpivirine এর ইন্ট্রামাসকুলার ইনজেকশন একটি অভিনব, দীর্ঘ-কার্যকরী অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এ আর টি) এর সংমিশ্রণ, যা এইচ.আই.ভি আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য কার্যকর দমনমূলক ব্যবস্থা হিসাবে অনুমোদিত হয়েছে। Cabotegravir এবং Rilpivirine এর দীর্ঘমেয়াদি ডোজ প্রতিদিন একবার ওষুধ গ্রহণ থেকে প্রতি মাসে একবার বা প্রতি দুই মাসে একবার ইনজেকশন নেওয়ায় সম্ভব হয়েছে।
শিশুদের জন্য ব্যবহৃত ড্রাগগুলোর ফরমুলা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় ভিন্ন হয়, শিশুদের জন্য উপযোগী পর্যাপ্ত ড্রাগের অভাবে তারা এইচ.আই.ভি চিকিৎসায় পিছিয়ে থাকে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী এই ড্রাগগুলো শিশুদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে কার্যকর, তবে বর্তমানে এইচ.আই.ভি তে আক্রান্তদের মধ্যে মাত্র অর্ধেক সংখ্যক শিশু চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছে।
বেশিরভাগ দীর্ঘস্থায়ী শটগুলোতে তরল আকারে ড্রাগের ন্যানোক্রিস্টাল মিশ্রিত থাকে, যা মুখে খাওয়ার ট্যাবলেটের তুলনায় দ্রুত রক্তে মিশে যায় এবং সহজে কার্যকর হয়।
এইচ.আই.ভি চিকিৎসায় ক্যাবেনুভা প্রতি মাসে গ্লুটিয়াল পেশিতে ইনজেকশন আকারে দেওয়া হয়। এটি চামড়ায় তুলনামূলক কম ক্ষত সৃষ্টি করে। কিন্তু যাদের শরীরে ফ্যাটের পরিমাণ বেশি তাদের পেশিতে ড্রাগ ইনজেক্ট করা কিছুটা কষ্টকর।
দীর্ঘস্থায়ী ওষুধের বিজ্ঞান এবং ক্লিনিক্যাল প্রভাব সম্পর্কে আমরা আশাবাদী হতে পারি। কিন্তু অনেকের কাছেই এটি একটি সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন হয়ে দাঁড়াবে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য উদ্যোগ ইউনিএইড-এর সহায়তায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এটি উপলব্ধ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
তাফহীমা ফেরদৌস / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: এনওয়াই টাইমস, এনসিবিআই