শিরোনাম পড়ে হয়ত অবাক হয়েছেন অনেক। ভাবছেন, নারীদের শারীরবৃত্তীয় এই মাসিক/ ঋতুস্রাব চক্রের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের এই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি-র সম্পর্ক কী!
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদী অধ্যুষিত এই নিচু ব-দ্বীপ অর্থাৎ, বাংলাদেশকে পড়তে হচ্ছে চরম বিপর্যয়ে। বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি হওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি সুন্দরবন এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট তৈরি করছে এবং এই সংকট সেসব এলাকার নারী এবং মেয়েদের জন্যও এক মর্মান্তিক পরিণতির সৃষ্টি করেছে।
২০২২ সালের জুলাই মাসে ইউএস-ভিত্তিক অলাভজনক সংরক্ষণ প্লাটফর্ম Mongabay কর্তৃক প্রকাশিত এক নিবন্ধের মাধ্যমে জানা যায়, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সুন্দরবন এবং বঙ্গোপসাগরের কাছে সাতক্ষীরার গ্রামগুলোতে মিঠাপানির উৎসসমূহে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে। যার কারণে মিঠা পানির সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে এসব এলাকার মহিলা এবং মেয়েদের যখন মাসিক হয় তখন এই সময়ে তারা যে ন্যাকড়া ব্যবহার করে থাকেন তা পরিষ্কার করতে নোংরা লবণাক্ত পানি ব্যবহারে বাধ্য হন। ফলে তারা বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হন। এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে এই এলাকার মহিলা এবং মেয়েরা মাসিক বন্ধের জন্য বিবাহিত নারীদের কাছ থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন করে থাকেন।
আরোও পড়ুনঃ মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণির পিরিয়ড হয় কি?
বাংলাদেশে প্রতিবছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা সাত থেকে আট মি.মি. করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলাফল ভয়াবহ বন্যা। আর এই বন্যার কারণেই প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ তাদের বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেলের মতে যদি বর্তমান হারে বৈশ্বিক উষ্ণতা অব্যাহত থাকে তাহলে আগামী দশকে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ লোককে অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় বেশ ভয়াবহভাবে স্বাদুপানির সংকট দেখা দিয়েছে। এর পিছনের মূল কারণ হলো লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে চিংড়ি চাষ। ফলে এসব এলাকার বসবাসকারীদের যখন বিশুদ্ধ পানি পানের জন্যই লড়াই করতে হয়, তখন মাসিক চক্রের সময় প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া তো অমাবস্যার চাঁদের ন্যায়।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী ৫০০ মিলিয়ন মহিলা এবং মেয়েরা মাসিক দারিদ্রের শিকার অর্থাৎ, তারা মাসিকের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি পণ্যগুলো বহন করতে পারে না, যা শুধুমাত্র তাদের প্রজনন স্বাস্থ্যকেই হুমকির মুখে ফেলে না বরং তাদের লালন পালন এবং জীবিকাকেও প্রভাবিত করে।
বাংলাদেশে নারীদের মাসিকের জন্য প্রয়োজনীয় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের সচেতনতা এখনও খুব বেশি নয়। শহরে কর্মরত নারীরা যদিও এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে কিন্তু গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় ৮০ ভাগ নারী আগের প্রথা অনুসারে এখনও পুরোনো কাপড়ের ন্যাকড়া ব্যবহার করছে। যদিও এসব এলাকায় স্যানিটারি প্যাডের বেশ মজুদ রয়েছে, কিন্তু সমস্যা হলো বেশিরভাগ নারীই এই প্যাড কেনার সামর্থ্য রাখে না। ২০১৮ সালে “The Impacts of Climate Change on Water Resources and Human Health” নামক গবেষণায় জানা যায় যে, বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকার নারীরা মাসিকের সময় যে ন্যাকড়া ব্যবহার করেন তা আবার ব্যবহারের জন্য লবণাক্ত পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখেন।
বাংলাদেশে ঋতুস্রাব বা মাসিক নিয়ে বেশ কিছু সামাজিক কুসংস্কারও রয়েছে এবং মেয়েদের মধে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে শিক্ষার অভাব রয়েছে। অনেকেই মাসিককে অসুস্থতা বলে মনে করেন, ফলে মাসিক হলে বেশিরভাগ সময়ই তারা এ বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করেন। মহিলারা তাদের মাসিকের জন্য ব্যবহৃত ন্যাকড়া পুরুষদের সামনে পরিষ্কার করতে বিব্রতকর বলে মনে করেন, এমনকি ঠিক একই কারণে অনেকে তাদের মাসিকের জন্য প্রয়োজনীয় স্যানিটারি প্যাডও দোকান থেকে কিনতে পারেন না।
Mongabay রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, কিছু মেয়ে তাদের ঋতুস্রাব বা মাসিক চক্র বন্ধের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন করছেন যাতে তাদের মাসিকের জন্য ব্যবহৃত ন্যাকড়া আর লবণাক্ত পানিতে নিয়ে ধুতে না হয়। লবণাক্ত পানিতে পরিষ্কার করা ন্যাকড়া আবার ব্যবহারে ঐ এলাকার প্রবীণদের মধ্যে ত্বক এবং জননাঙ্গের সংক্রমণ ঘটছে যার কারণে মেয়েরা খুব সম্ভবত এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি তাদের স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে এবং রক্ত জমাট বাঁধা, স্তন ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন জরিপ (২০১৪) দেখায় যে, ৪০ শতাংশ ছাত্রীরা মাসিকের কারণে গড়ে তিন দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। মহিলাদের মাসিকের ব্যাপারটি গোপন রাখতে শেখানো হয়। ফলে স্যানিটারি প্যাড এলাকা থেকে কেনা তাদের পক্ষে সম্ভবপর হয় না। স্থানীয় একটি স্যানিটারি প্যাড কোম্পানি সাতক্ষীরায় একটি সামাজিক প্রচারণা চালু করেছেন, যার মধ্যে নারীদের জন্য মিঠা পানির ট্যাংক স্থাপন এবং তাদের মাসিক সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। কিছু স্থানীয় NGO সাশ্রয়ী মূল্যের মাসিক স্বাস্থ্যবিধি পণ্য তৈরি শুরু করেছেন। তবে দেশের ৮৩ মিলিয়নেরও বেশি মহিলার জন্য এই পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজের অধিকাংশ মানুষ নিরাপদ স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে আলোচনা করতে রাজি নন। ২০১৫ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশ দেয় যে, বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুলে ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম একটি টয়লেটের ব্যবস্থা করা হবে, যা এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি। বাংলাদেশে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে গণসচেতনতা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এক বাহ্যিক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে যার সমাধান বাংলাদেশ একা দিতে পারবে না।
দিদারুল ইসলাম/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: গ্লোবাল ভয়েজ