পারমাণবিক পর্যায়ে যে সকল কণা নিয়ে আলোচনা করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো ইলেকট্রন। বিদ্যুৎ পরিবহন থেকে শুরু করে নতুন যুগের কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ইলেকট্রনের ভূমিকা রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই কণা যেমন অন্যান্য কণা নিয়ে গবেষণার কাজে ব্যবহার হয়, তেমনি ইলেকট্রন নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। সময়ের সাথে সাথে ইলেকট্রন নিয়ে নতুন সব তথ্যের জন্য একদল উদ্ভাবনী মানুষ সব সময় পিপাসু থাকেন।
সেই ইলেকট্রন নিয়ে এক অভাবনীয় গবেষণা চালালেন বিজ্ঞানের স্বর্গক্ষ্যাত এমআইটি বা ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি এর একদল গবেষক। প্রথমবারের মতো ইলেকট্রন কে কেলাস আকৃতির হাতের মাঝখানে আটকানো সম্ভব হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই কাজ বিজ্ঞানের জগতের একটি মাইলফলকই বলা চলে।
ইলেকট্রনের নিজস্ব শক্তি রয়েছে। যখন কোন পরিবাহীর মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রন চলাচল করে তখন ইলেকট্রন এই শক্তি কাজে লাগিয়ে চলাচল করে। যখন কোন ইলেকট্রন পরিবাহীতে আটকা পড়ে তখন ইলেকট্রনের শক্তি একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় আটকে যায়। এ অবস্থাকে পদার্থবিদরা ফ্ল্যাট ব্যান্ড বলেন।
ফ্ল্যাট ব্যান্ড হলো এমন একটি অবস্থা যখন ইলেকট্রনের শক্তি ইলেকট্রনের ভরবেগের উপর নির্ভরশীল থাকে না। এর মানে হলো ইলেকট্রন কোন পরিবাহীর মধ্য দিয়ে অবাধে চলাচল করতে পারেনা। এই ধরনের ঘটনা শক্তিশালী বৈদ্যুতিক মিথস্ক্রিয়া সম্পন্ন পরিবাহীতে ঘটে। যেমন উচ্চ তাপমাত্রা সম্পন্ন সুপারকন্ডাক্টর (অতিপরিবাহী)।
এরূপ ফ্ল্যাট ব্যান্ড পরিস্থিতি বজায় রাখতে পারলেই ইলেকট্রন কে এক জায়গায় থামিয়ে রাখা যাবে। সহজভাবে, ইলেকট্রনকে বন্দী অবস্থায় রাখা যাবে।
ইতোপূর্বে এ ফ্ল্যাট ব্যান্ড পদ্ধতি ব্যবহার করে ইলেকট্রন কে আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তা সফল হয়নি। কেননা তখন দ্বিমাত্রিক পদার্থ (পরিবাহী) ব্যবহার করে এই চেষ্টা চালানোর হয়। ফলে পদ্ধতিটি সফল হয়নি। কেননা এখানে পরিবাহীর আকার আকৃতি টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এমআইটির পদার্থবিদ্যার সহযোগী অধ্যাপক জোসেফ চেকেলস্কির নেতৃত্বে একটি গবেষণা দল পরামর্শ দিয়েছিল যে ফ্ল্যাট ব্যান্ড স্টেট অর্জন করা অধিকতর সহজ হবে যদি ত্রিমাত্রিক (ক্রিস্টাল বা কেলাস) আকৃতির কোনো পদার্থ ব্যবহার করা হয়। তাদের ব্যবহার করা ক্রিস্টাল অনেকটা জাপানি ঝুড়ি ‘কাগোমা’ বা ‘কাগোমে’ আকারের। এই আকৃতি “ফ্ল্যাট ব্যান্ড” অবস্থা বজায় রাখতে বিশেষ কার্যকর।
এমআইটি এই দলটি গবেষণা করে দেখেছে এই প্লাইরোক্লোর ব্যবহার করা যায়। প্লাইরোক্লোর হলো একটি খনিজ পদার্থ। কেলাস এই খনিজ পদার্থের বিশেষত্ব হলো এর পরমাণুগুলো সুষমভাবে বিন্যস্ত থাকে। ত্রিমাত্রিক আকার ঘটনে এই খনিজ একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন মেনে গঠন তৈরি করে।
গবেষণা দলটি তাদের এই অনুমান পরীক্ষা করে দেখার জন্য নিকেল এবং ক্যালসিয়াম এর সাথে পাইরোক্লোর এর সংশ্লেষ করে।
জোসেফ চেকেলস্কি বলেন,
“নিকেল এবং ক্যালসিয়াম গলিয়ে পরবর্তীতে ঠান্ডা করা হয়। এতে এরা নিজেরাই কেলাস আকার ধারণ করে।”
ইলেকট্রন ফ্ল্যাট ব্যান্ড কোথাও আছে কিনা তা দেখার করার জন্য ফটোএমিশন বা আলোক-নিঃসরণ পরীক্ষা চালানো হয়। এই ফটোএমিশন পরীক্ষার মাধ্যমে ফটোন কণা ব্যবহার করে ইলেকট্রনের শক্তি পরিমাপ করা হয়। যাতে বোঝা যায় ফ্ল্যাট ব্যান্ড অবস্থা বজায় আছে।
ফটোএমিশন পরীক্ষা চালানোর জন্য ARPES নামে একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলো। কারণ ত্রিমাত্রিক ব্যবস্থার ভেতরে থাকা ইলেকট্রনের শক্তি পরিমাপে এই পদ্ধতি ছিল কার্যকর। ARPES বা Angle-resolved photoemission spectroscopy হলো এমন এক পদ্ধতি যা ব্যবহার করে ঘন আকৃতির কোন পদার্থে ইলেকট্রনের শক্তি পরিমাপে ব্যবহার করা হয়।
সহজভাবে বললে ফ্ল্যাট ব্যান্ড পদ্ধতি বজায় রাখার মাধ্যমে একটি ইলেকট্রন কে পদার্থের মধ্যে বন্দী করে রাখা যায়।
প্লাইরোক্লোর এর সাথে নিকেল এর পরিবর্তে রোডিয়াম এবং রুথেনিয়াম ও ব্যবহার করা হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, গবেষক দলটি দেখেছে এই পদ্ধতি ব্যবহারে ক্লাসের জ্যামিতিক আকার বজায় থাকবে ঠিকই কিন্তু ইলেকট্রনের শক্তি শূন্যে নেমে আসে, ফলে ব্যবস্থাটি একটি সুপারকন্ডাক্টরে (অতিপরিবাহী) রূপ নেয়। ঠিক যেমনটা তারা পূর্বে আশা করেছিল।
পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক রিকার্ডো কমিন এর মতে,
“এই পদ্ধতিটি নতুন সব কোয়ান্টাম উপকরণ খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।”
আশা করা যায়, সামনে দিনগুলোতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সহজেই ইলেকট্রন নিয়ে আরো গবেষণা এবং উদ্ভাবনী কাজ চালানো যাবে।
জুম্মান আল সিয়াম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: নিউজ.এমআইটি.এডু, ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক এক্সপ্লোরিস্ট