বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের অব্যাহত ধারা বজায় রাখতে প্রতিনিয়তই স্বপ্নবাজ মানুষেরা কাজ করছেন যা বিজ্ঞানকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনে । এই ধারাবাহিকতার মাঝেই বিজ্ঞানে তাদের অবদান স্বরূপ স্বীকৃতি পাচ্ছেন অনেকেই। তেমনি এক পুরস্কার “ইগ নোবেল পুরস্কার”।
এই পুরস্কার বিজ্ঞানে এমন উদ্ভাবনের জন্যে দেওয়া হয় যা প্রথমে শুনলে আপনি হাসবেন, পরবর্তীতে তা আপনাকে ভাবাবে। “ইগ নোবেল পুরস্কার” নিয়ে বিজ্ঞান ব্লগের ২য় পর্বে থাকছে পুষ্টি, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য সহ আরও কিছু বিষয়।
পুষ্টি
খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি এর স্বাদ পাওয়াও অতি আবশ্যক। শুধু খাবারের স্বাদ নেওয়ার জন্যই নয়, বরং ভালো কিংবা মন্দ খাবার বোঝার জন্যও খাবারের স্বাদ নেয়া জরুরি। সেই কথা মাথায় রেখে হোমেই মিয়াশিতা এবং হিরোমি নাকামুরা পরীক্ষা করেন কীভাবে ইলেকট্রিক চপস্টিক এবং ড্রিংকিং স্ট্র ব্যবহার করে খাবারের স্বাদে পরিবর্তন আনা যায়।
মানুষের শুধু জিহ্বা তে “টেস্ট বাডস” (যার সাহায্যে মানুষ খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করে) রয়েছে। মিয়াশিতা এবং নাকামুরা দুটি ভিন্ন স্ট্র এর মধ্যে পজিটিভ আর নেগেটিভ চার্জযুক্ত ইলেক্ট্রোড (পরিবাহী যা একটি সার্কিটের বর্তনীর অধাতু অংশের সাথে বৈদ্যুতিক যোগাযোগ স্থাপন করতে ব্যবহৃত হয়) প্রবেশ করান এবং তারপর প্রতিটি স্ট্রকে একটি ইলেক্ট্রোলাইট যুক্ত (রাসায়নিক পদার্থ, খনিজ ও লবণ রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন শারীরবৃত্তিক কাজের জন্য প্রয়োজনীয়। এদের ইলেকট্রোলাইট বলা হয়। এদের পানির সাথে দ্রবীভূত করলে তড়িৎ-পরিবাহী দ্রবণ তৈরি করে) পানীয় পূর্ণ দুটি কাপের একটিতে প্রবেশ করান।
যখন এর ব্যবহারকারী পানীয় পান করেন, তখন সার্কিটটি সম্পূর্ণ হয়। অর্থাৎ, বিদ্যুৎ প্রবাহীত হয় এবং স্ট্রটি একটি “বৈদ্যুতিক স্বাদ” তৈরি করতে মুখের কাছে একটি বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা সরবরাহ করে। তারা খাবারের জন্যও একই কাজ করেছেন। ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক চার্জ যুক্ত ইলেক্ট্রোড প্রবেশ করানো চপস্টিক ব্যবহার করেছেন।
স্পষ্টতই, এই বৈদ্যুতিক স্বাদ উপলব্ধি করার ক্ষমতা ভোল্টেজের উপর নির্ভর করে, তাই তারা একটি ভোল্টেজ-সামঞ্জস্য ফাংশন যোগ করেছেন।
তাদের ভাষ্যমতে,
“আমাদের সিস্টেমের লক্ষ্য হল জিহ্বার একটি নতুন স্তর পাওয়া যা এমন ভিন্ন স্বাদ শনাক্ত করতে পারে যেটি আমরা আগে উপলব্ধি করতে পারিনি।”
শিক্ষা
প্রায়ই দেখা যায় ক্লাসে শিক্ষার্থীদের একঘেয়েমি ভাব চলে আসে। এমনকি শুধু শিক্ষার্থীদেরই নয় শিক্ষকদের সাথেও অনেক সময় এমনটা হয়। অর্থাৎ যখন শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আগ্রহ অনুভব করে না তখন বিষয়টা শিক্ষকদের জন্যও একঘেয়ে হয়ে যেতে পারে। এভাবেই একঘেয়েমি ছড়িয়ে পরে।
এই বিষয়টির উপর গবেষণা করে ক্যাটি ট্যাম, সায়ানিয়া পুন, ভিক্টোরিয়া হুই, উইজনান্ড ভ্যান টিলবার্গ, ক্রিস্টি ওং, ভিভিয়ান কোং, গিগি ইউয়েন এবং ক্রিশ্চিয়ান চ্যান পুরস্কার জিতে নেন।
হংকং এর দুটি স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মোট ৪৩৭ জন শিক্ষার্থী এবং তাদের ১৭ জন শিক্ষককে তাদের একঘেয়েমির মাত্রা রেকর্ড করে দুই সপ্তাহের জন্য একটি ডায়েরিতে লিখে রাখতে বলা হয়েছিল।
শিক্ষার্থীদেরকেও রেকর্ড করতে বলা হয়েছিল যে তারা শিক্ষকদের কতটা একঘেয়ে মনে করেছিল এবং তারা প্রতিদিন ক্লাসে কতটুকু অনুপ্রাণিত বোধ করেছিল।
গবেষণার ফলাফলে বেরিয়ে আসে যেসব শিক্ষার্থী ক্লাস কে বেশি বোরিং মনে করেছিল তাদের কাছেই বেশি বোরিং লেগেছিল। পরবর্তীতে তাদের এই পরীক্ষা আরো কয়েকবার চালানো হয় এবং ফলাফল স্বরূপ এটি উঠে আসে যে, যদি পূর্বেই এটা আশা করা হয় যে লেকচার বা ক্লাসটি বোরিং হবে তাহলে লেকচারটি বোরিং লাগার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
জনস্বাস্থ্য
সুস্থ থাকার জন্য প্রতিনিয়ত নানা রকম চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষকে যেতে হয়। চিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের গতিবিধি, রক্ত চলাচল, শ্বাস-প্রশ্বাস ইত্যাদি পর্যবেক্ষণের জন্য নানাবিধ টেস্ট বা পরীক্ষা। কেমন হবে যদি মানুষের নিত্যদিনে করা প্রাকৃতিক কাজের মাধ্যমেই শরীরের বিভিন্ন পরীক্ষা একসাথে করে ফেলা সম্ভব হয়? সিউং-মিন পার্ক নামের এক গবেষক “স্ট্যানফোর্ড টয়লেট” নামক একটি ডিভাইস উদ্ভাবন করেছেন।
এক কথায় এটি একটি স্মার্ট টয়লেট যা ব্যবহারকারী প্রস্রাবের স্রোত ও অন্ত্রের গতিবিধি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে স্বাস্থ্যের অবস্থা ট্র্যাক করতে পারে। স্মার্ট টয়লেটে রয়েছে ইন্টিগ্রেটেড সেন্সর যা হৃৎপিণ্ডের অবস্থা, রক্তচাপ, অক্সিজেনেশন এবং একই সাথে প্রস্রাব এবং মলের নমুনা পরীক্ষা করতে সক্ষম।
তবে স্মার্ট টয়লেটে ব্যবহার করা হয়েছে একটি ইউরিনালাইসিস ডিপস্টিক টেস্ট স্ট্রিপ, মলত্যাগের বিশ্লেষণের জন্য একটি কম্পিউটার ভিশন সিস্টেম, একটি শনাক্তকারী ক্যামেরার সাথে যুক্ত একটি পায়ু-প্রিন্ট সেন্সর এবং একটি টেলিকমিউনিকেশন লিঙ্ক – মানুষ যে বর্জ্য পদার্থ ত্যাগ করে তা নিরীক্ষণ এবং দ্রুত বিশ্লেষণ করার জন্য।
পদার্থবিজ্ঞান:
ওশেন মিক্সিং বা মহাসাগর মিশ্রিত হওয়া একটি বিশেষ প্রক্রিয়াকে বোঝায় যার মাধ্যমে মহাসমুদ্রের পানির বিভিন্ন স্তর একসাথে আলোড়িত বা মিশ্রিত হয়। এ প্রক্রিয়া জলবায়ুকে যেমন প্রবাহিত করে তেমনি সমুদ্রের তাপমাত্রা, লবণ, গ্যাস এবং পুষ্টির মত উপাদানগুলোকেও প্রভাবিত করে। বাতাস এবং ঢেউ এই প্রক্রিয়ার চালনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে কিছু বিজ্ঞানীর পরামর্শ অনুসারে, জুপ্লাংকটন মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণী এই প্রক্রিয়া চালনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে।
কেননা তাদের উপস্থিতি ”বায়োফিজিক্যাল টার্বুলেন্স” তৈরি করতে সক্ষম। বিয়েতো ফার্নান্দেজ কাস্ত্রো, মারিয়ান পেনা ও তাঁদের দল এই গবেষণার জন্য পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়েছে।
ফায়ার ফিজিক্যাল টার্বুলেন্স বলতে এমন একটা টার্বুলেন্স কে বোঝায় যা কোন তরল পরিবেশে ঘটে থাকে, যেমন হতে পারে সেটা মহাসাগর কিংবা বায়ুমণ্ডল। জীব ও তরলের ভৌত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার ফলে এই বিশেষ টার্বুলেন্সের উৎপন্ন হয়।
সাইকোলজি
তিনজন বিজ্ঞানী স্ট্যানলি মিলগ্রাম, লিওনার্ড বিকম্যান এবং লরেন্স বারকোভিট সাইকোলজিতে এবার এই পুরস্কারটি পেয়েছেন তাদের একটি হিউম্যান সাইকোলজি পরীক্ষার জন্য। যেখানে তারা পরীক্ষা করেন যে শহরের রাস্তায় চলাচলের সময় অপরিচিত কাউকে হঠাৎ উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আশেপাশে থাকা পথচারীরা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখান।
অর্থাৎ রাস্তায় চলাচলের সময় অপরিচিত কাউকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে উপরে তাকিয়ে থাকতে দেখলে আশেপাশের চলাচলকারীরা তার এই আচরণ দ্বারা কীভাবে প্রভাবিত হয়।
তারা এই এক্সপেরিমেন্টটি করার জন্য রাস্তার একপাশে তারা নিজেদের ১,২,৩, ৪,৫, ১০ কিংবা ১৫ জনের একটি ভিড় প্রবেশ করান এবং রাস্তার অপর পাশে একটি অফিস ভবনের ছয় তলা থেকে জানালা দিয়ে তাদেরকে সংকেত দেওয়া হয়।
ভিড়ে থাকা লোকদের বলা হয় যখন জানালা থেকে সংকেত আসবে তখন তারা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়বে এবং পুরো এক মিনিট সেই জানালার দিকে তাকিয়ে থাকবে। পরবর্তী সংকেত আসলে তারা সেখান থেকে হেঁটে চলে যাবে। এভাবেই পরীক্ষাটি ঠিক কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করা হয়।
পরবর্তীতে তাদের রেকর্ড থেকে বিশ্লেষণ করা হয় যে, তাদের পাশ দিয়ে যাওয়া মোট ১,৪২৫ জন পথচারীর মধ্যে কতজনের আচরণকে প্রভাবিত করেছে অর্থাৎ কতজন তারা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
সাইকোলজিস্টরা তাদের ফলাফল থেকে দেখেন যে, ১৫ জনের ভিতরে যখন তাদের পাঠানো ব্যক্তি উপরের দিকে তাকিয়ে ছিল সেখানে ৪০% লোক দাঁড়িয়ে উপরের দিকে দেখতে থাকে।
তারা আরও একটি জিনিস লক্ষ্য করেন, ১৫ জনের ভিড়ে ৮২% এমন পথচারী রয়েছে যারা হয়ত দাঁড়িয়ে অথবা না থেমে অর্থাৎ চলতে চলতে একজন পথচারী উপরের দিকে তাকিয়ে থাকলে তারাও একই প্রতিক্রিয়া দেখানোর সম্ভাবনা ৪২ শতাংশ।
প্রতিবছরের মতো এবারও ইগ নোবেল পুরস্কার যেমন মানুষকে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নিয়ে আনন্দের খোরাক জুগিয়েছে, ঠিক তেমনি মানুষকে ভাবিয়েছে। সেই সাথে নতুন উদ্ভাবনকে দিয়েছে স্বীকৃতি। গবেষণার প্রতি মানুষের অগ্রযাত্রাকে করেছে ত্বরান্বিত।
পুরস্কার প্রাপ্ত গবেষকরা এবছরের নভেম্বরে ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজে ইগ নোবেল কর্তৃপক্ষের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাবেন। এভাবে বিজ্ঞান এগিয়ে যাক উদ্ভাবনশীল মানুষের হাত ধরে।
জুম্মান আল সিয়াম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, উইওন, সিএনএন