ইগলু, এটি তুষার ঘর নামে পরিচিত। ইগলু মূলত শিকারী গোষ্ঠীগুলো তৈরী করে থাকে অত্যাধিক ঠান্ডা থেকে বাঁচতে এবং ছোট গ্রাম হিসেবে শীতকালের সময় কাটাতে। একটি ছোট ইগলু সাধারণ পরিস্থিতিতে কয়েকজন শিকারী আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টার মধ্যে তৈরী করতে পারে। শুধু তাপমাত্রা বাদেও ইগলু নিয়ে অনেক মজার বিষয় আছে !
সেইসব এলাকায় যেখানে তাপমাত্রা -৫০° সেলসিয়াসের নিচে থাকলেও, আপনি ইগলুর মধ্যে বাহিরের চেয়ে ২০-৭০° সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা অনুভব করবেন! অনেক সময় এই তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৫০-৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত পৌছাতে পারে।
কিন্তু এই উচ্চ তাপমাত্রা বেশি সময় বজায় থাকে না, কারণ, এতে তুষার গলে যায়। ভিতরের তাপমাত্রা ২০-৩০° হলে ইগলু দীর্ঘ সময় টিকে থাকে। আপনি যখন এই তাপমাত্রায় চামড়ার ও পশমের গরম পোষাক পরিধান করবেন, তখন ইগলুর বাসিন্দা হিসেবে যথেষ্ট আরামে থাকবেন।
অন্তরণ- তুষার যখন অপরিবাহী হিসেবে কাজ করেঃ
একটি ইগলুর ভেতরের তাপমাত্রা গরম হওয়ার কারণ হলো, তুষারে থাকা ছোট ছোট বায়ু কুঠুরী অন্তরণ হিসেবে কাজ করে। যদি শক্ত বরফ দিয়ে তৈরী হত তবে, ইগলু তুলনামূলক অনেকটাই ঠান্ডা হত! সাধারণভাবে ধারণা করলে বোঝা যায় ইগলু গরম হয় না। এর মধ্যে অনেক উত্তাপ সৃষ্টি হওয়ার উৎস আছে যেগুলো ইগলুর মধ্যে তাপের বিস্তার ঘটায়!
ইগলুতে উত্তাপ সৃষ্টির উৎসঃ
-
- মানুষের শরীরের তাপমাত্রা, এইটাই বেশিরভাগ ইগলুতে উত্তাপ সৃষ্টির প্রাথমিক কারণ
- বাতি, যেটায় সিল, তিমির চর্বির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়
- ছোট রান্নার আগুন, যদিও বেশির ভাগ মাংস কাঁচা খাওয়া হয়
একটি বাতি, যেইটা সাধারণত পাথর বা মাটির পাত্র এবং এর সাথে জ্বালানোর জন্য সিলের চর্বি এবং একখন্ড মস, যা রান্না, আলো এবং হালকা তাপমাত্রার জন্য ব্যবহার করা হয়! অর্ধচন্দ্রাকৃতির পাথর, যার কিনারা ধারালো তা রান্নায় ভালো ছুরি হিসেবে ব্যবহার করা হয়!
ইগলুতে কি বিছানা আছেঃ
চামড়ার কাপড় বা তোষক। সাধারণত অনেকগুলো পশমকে একসাথে করে সেলাই দিয়ে তৈরী করে বিছানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই সময় প্রথমে বিশেষ কিছু ডালপালা বিছানো হয়, এরপর পশমী তোষক এর উপর দেওয়া হয়,যা জাজিম এর মতো হয়। অনেক সময় পশমের তোষক গুলো শুধুমাত্র শক্ত বরফের উপর বিছানো হয়।
শিকারের আশ্রয়কেন্দ্র এবং গ্রামসমুহঃ
ইগলু হলো শিকারীগোষ্ঠীদের অত্যাধিক শীতের হাত থেকে বেঁচে থাকার জন্য অস্থায়ী আবাস। তারাই এটা তৈরী করে অন্যান্য শিকারীগোষ্ঠীদের থেকে দূরে থাকা। তারা দল হিসেবে থেকে ছোট গ্রামও তৈরী করে। এই গ্রামগুলো মৌসুমী হয় কারণ শিকারীদের জীবনযাত্রা এবং শিকার করার মৌসুমগুলোতে খাদ্য সংগ্রহের জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যেতে হয়!
একটি “আদর্শ ইগলু” দেখতে কেমন হয়?
এর প্রধানত চারটি অংশ থাকেঃ
১. থাকার জায়গা ২. প্রবেশ এলাকা, ৩. জানালা, ৪. ফাঁকা জায়গা বা ভেন্ট
এলাকাঃ
প্রাকৃতিকভাবে একটি ভালো এলাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ!
জায়গাটি এমন হবে যেখানে ভালো তুষার আস্তরণ থাকবে যা ইগলু তৈরীতে ব্যবহার হবে। এই তুষার খুব ভেজা বা ভারী হবে না এবং খুব বেশি গুঁড়োও হবে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক খেয়াল রাখতে হবে যেন কাছাকাছি ভালো শিকার থাকে, কাউকে যেনো বেশি দূরে ভ্রমণ করতে না হয় খেলার বা মাছ ধরার জন্য!
সামনের দরজাঃ
ইগলুর ভেতরে ঢোকার জন্য সুবিধাজনক আকৃতির দরজা তৈরি করা হয় যাতে হাটু গেড়ে হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে যাওয়া যায়! দৈর্ঘ্যে ৬–১০ ফুট তার সাথে যথাযথ একটি কোণ, হয়ে গেলো পারফেক্ট একটি দরজা।
ইগলুর দরজা এর ফ্লোর সমতলের কিছুটা গভীর করে তৈরি করাটাই সবচেয়ে ভালো। যেহেতু ঠান্ডা বাতাস উষ্ণ বাতাসের তুলনায় হাল্কা, তাই কিছুটা গভীর করে দরজাটা তৈরি করা হলে বাহিরের ঠান্ডা বাতাস আর ইগলুর ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনা।
স্লিপ্ট লেভেলঃ
একটি মেঝের স্লিপ্ট লেভেল পরিকল্পনা থাকা অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ।
এর ফলে শোয়ার জায়গা অনেকটাই উপরে হবে, ফলে আবার, ঠান্ডা বাতাস নিচে যাবে, এবং গরম বাতাস উপরে আসবে। যার কারণে ঘুমানোর জায়গার তাপমাত্রা কিছুটা গরম হবে!
জানালাঃ
গরমের সময় জানালা থাকাটা ভালো। তবে, সবগুলো ইগলুতে জানালা থাকে না, সামান্য কিছুতে থাকে। একটি আদর্শ জানালাতে সিলের চামড়া বা তোষক বা সিলের স্বচ্ছ অবশিষ্টাংশ দিয়ে ঢাকা থাকে যা আলো আসার সুযোগ করে দেয় কিন্তু বাতাস আসা প্রতিহত করবে। মাঝেমধ্যে একটি স্বচ্ছ বরফের খন্ড জানালা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
নির্মাণঃ
শুকনো এবং সংকুচিত কঠিন তুষারের বড় ব্লক দেখা যায় ইগলুতে। এগুলো ২ফুট*৪ফুট এর ব্লক এবং ৮ ইন্ঞি পুরু হয়। আবার অনেকসময় বিভিন্ন আকৃতিরও হতে পারে। ইগলুটি বাঁকা/ বৃত্তাকার করার জন্য প্রতিটি ব্লকের আকৃতি শীর্ষের সাথে একটি বৃত্তাকার প্যাটার্নে অল্প কৌণিক আকৃতি দেওয়া হয়!
ব্লকগুলো ঠিকমত স্থাপন করার পর, ভিতরের মেঝে খুঁড়ে ফেলা হয়। সাধারণত, ব্লকগুলি শেষ হয় একটি গর্তের চারপাশে যা বেশ কয়েক ফুট গভীর খনন করা হয়।
তৈরী হওয়ার পর এবং সেখানে বসবাস করার আগে একটি ছোট মোমবাতি বা বাতি ইগলুর মধ্যে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, যেন ইগলুর অভ্যন্তরের তুষারের পাতলা স্তর গলিয়ে দিতে পারে। এরপর বাতিটি নিভিয়ে দেওয়া হয়, এবং ইগলুর মধ্যে তুষার ব্লকে একটি পাতলা বরফের স্তর তৈরী হয়।
এটি ব্লকগুলোকে কাঠামোগত ভাবে শক্তিশালী করে এবং সাধারণত এতোটা শক্ত হয় যে, একজন মানুষ ইগলুর উপর দাঁড়িয়েও থাকতে পারে তা না ভেঙেই!
ইগলুর অভ্যন্তর প্রায়ই স্তর বিশিষ্ট হয়, উপরের স্তর ঘুমানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। ঠান্ডা বাতাস গরম বাতাসের চেয়ে ভারী হওয়ার কারণে, বিছানা উপরে করা হয়ে থাকে যেন গরম থাকে। এবং ইগলুর মাথায় ছোট একটি ফুটো থাকে ভেন্টিলেশনের জন্য এবং রান্নার আগুনের ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য।
আরও পড়ুনঃ ১। বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে নরওয়েতে বরফ গলে আবিষ্কৃত হলো প্রাচীন নিদর্শন ২। লিপ ইয়ারঃ ইতিহাস ও অজানা ফ্যাক্টস ৩। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ৬ টি ভিন্ন রকম উপায় |
কার্বন মনোক্সাইড সমস্যাঃ
কোনো কার্বন মনোক্সাইড ডিটেক্টর এর দরকার হয় না, কিন্তু কিছু ইগলুতে একটি ছোট ফুটো করা হয় কোনো পাশের তুষার ব্লকগুলোতে যাতে কিছু বাতাস এর মধ্য দিয়ে ঢুকতে পারে এবং উপরের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। এটি কার্বন মনোক্সাইড নিঃসরণ এ সহায়তা করে।
সরঞ্জামঃ
সরঞ্জামাদি মুলত তৈরী করা হয় হয় তিমির হাড় দিয়ে যা তারা শিকার করে থাকে। যদি তারা কিছু গাছের সন্ধান পেয়ে যায় তবে গাছের ডালপালা দিয়ে কিছু সরঞ্জাম তৈরী করে থাকে। আবার, ভালো গাছের গুড়ি গ্রীষ্মের সময় তাবু তৈরীতে ব্যবহার করা হয়। কুকুরের স্লেড তৈরীতেও কাঠ ব্যবহার করা হয়।
গ্রীষ্মকালঃ
গ্রীষ্মকালে ইগলু গলে যায় বা ভেঙে পড়ে। তখন তাবু বেশি ব্যবহার করা হয়। তাবুগুলো কাঠদন্ড এবং চামড়া দিয়ে আচ্ছাদন করা হয়।
শেষ কথাঃ
ইগলু যাযাবর জাতি এস্কিমো এবং অন্যদের অত্যাধিক ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে এবং টিকে থাকতে সহায়তা করে। বর্তমান দিনের অনেক নির্মাণকার্য এবং এনার্জি নীতি ইগলু থেকে প্রবর্তিত করা হয়েছে।
রওনক শাহরিয়ার/ নিজস্ব প্রতিবেদক