ছোটবেলায় বইয়ে সৌরজগতের সবগুলো গ্রহের নাম মুখস্থ করানো হয়েছে নিশ্চয়ই। না, এবার আপনার মুখস্থ ক্ষমতা যাচাই করা হবে না৷ উদ্দেশ্য অন্য কিছু। ইউরেনাস, নাম তো শুনেছেন নিশ্চয়ই!
চলুন ধরে নিই, ৫ সেকেন্ডের জন্য চলে গেলাম ইউরেনাসের বুকে, তারপর না হয় আবার ফিরে আসবো! কী হবে এই সময়ের মধ্যে?
আগে থেকেই জেনে রাখুন, ইউরেনাসে ভ্রমণ করা বেশ কষ্টসাধ্য এবং উদ্ভট একটা ভ্রমণ নিঃসন্দেহে। প্রথমত আপনাকে টানা দশ বছর কোনো একটা মহাকাশযানে কাটাতে হবে। ভাগ্য ভালো হলে, পথিমধ্যে দেখা হয়ে যেতে পারে বৃহস্পতি ও শনি’র সাথেও! তাই, পর্যাপ্ত পরিমাণে জ্বালানি এবং খাদ্য সাথে করে নিতে ভুলবেন না৷
এবার, যার বাড়ি যাচ্ছি, সেই ইউরেনাস মামার সম্পর্কেও কিছু জেনে নেওয়া যাক৷ ইউরেনাস কিন্তু পৃথিবীর মতো কঠিন ভূখন্ডের কোনো গ্রহ না৷ এটা বরং নেপচুনের মতো কোনো এক বরফ দৈত্যের বাড়ি! আর আমাদের সৌরজগতে এটা সেই দুটো গ্রহের (আরেকটি শুক্র) একটি যেটা তার নিজের দিকেই আবর্তন করে, সোজা বাংলায় “ঘুরে’! আর এটার ঘুরার গতিও অনেক বেশী। পৃথিবীর সময়ে ১৭ ঘন্টাতে এটিতে একদিন কেটে যায়! ১৭ ঘন্টার হিসেব করে কী হবে, আমরা তো ৫ সেকেন্ড ঘুরেই ফিরে আসবো!
ইউরেনাসের কাছাকাছি আসার পরও আপনার আরও কিছু কাজ করা বাকী থাকবে৷ ইউরেনাসের বলয়ের সাথে হিসেব নিকেশ কষতে হবে৷ হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন৷ ইউরেনাসের বলয় আছে। তাও, এক-দুটো না৷ পুরো ১৩ টা! তবে, শনি’র মতো এতটাও বড় কিংবা গৌরবান্বিত কিছু না৷ বাইরের বলয়গুলো সহজেই দেখা সম্ভব, তবে ভিতরের বলয়গুলো অন্ধকার এবং বেশ সংকীর্ণ। এইসবকিছুই বেশ সতর্কতার সাথে মোকাবেলা করতে হবে৷
আর এসব বলয়কে পরাজিত করে সামনে এগিয়ে গেলে দেখতে পাবেন নীল দুর্দান্ত এক বায়ুমন্ডল। আর, ততক্ষণে ইতিহাস গড়ে এতদূর আসা এখন পর্যন্ত প্রথম ব্যক্তি হয়ে গেলেন আপনি!
কিন্তু, আপনি এখনও অবতরণ করতে পারেননি৷ পারবেনও বা কীভাবে? ইউরেনাসের যে কোনো ভূমি নাই! এটি বিষাক্ত গ্যাসে ভরা এক বল যার কেন্দ্রে আছে এক ছোট বরফের কেন্দ্র!
আচ্ছা, নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, কেন এই গ্যাসগুলো বিষাক্ত?
তার আগে চলুন লাফ দেই ইউরেনাসে। সাথে কোনো রোবট থাকলে ততক্ষণে বলে দিবে আপনার চারপাশের তাপমাত্রা নেগেটিভ, -২২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেহেতু আমাদের পরিকল্পনা ছিলো ৫ সেকেন্ড ইউরেনাসে কাটিয়ে তারপর আবার ফিরে আসা। লাফ দেওয়ার পর ৫ সেকেন্ড ইতোমধ্যে কাটিয়ে ফেলেছি। এবার ফেরার পালা। আপনার স্পেসশ্যুটকে বললেন ফিরে যেতে৷ ধরে নিচ্ছি আপনার স্পেসশ্যুট ইন্টারস্টেলার মুভির সেই রোবট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যে কন্ট্রোল করতে পারে। কিন্তু, হায়, আপনার স্পেসশ্যুট বলছে, ফিরে যাওয়া অসম্ভব। বরং, ৫৪ মিনিটের মধ্যে সেই বরফের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে যাবেন আপনি!
ততক্ষণে ইউরেনাসের বায়ুমন্ডলের গন্ধকে ঘৃণা করতে শুরু করবেন৷ হাইড্রোজেন সালফাইডে বানানো এই বাতাসগুলোর মেঘের গন্ধ অত্যন্ত খারাপ। শুধু যে গন্ধই খারাপ তা না, চরম বিষাক্তও বটে। তাই এখানে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা ভুলেও করবেন না৷ চেষ্টা করলে বেহুঁশ হয়ে সাথে সাথেই মারা যাবেন।
নিচে নামার মূহুর্তে চারপাশে যা থাকবে তা মোটামুটি ৮২ ভাগ হাইড্রোজেন, ১৫ ভাগ হিলিয়াম এবং আরো কিছু মিথেনের যোগফল। আর এই মিথেন গ্যাসই ইউরেনাসকে এই নীল রংয়ের জাদুকরী আবছায়া দেয়৷ ইউরেনাসের বায়ুমন্ডল বেশ ঘন, তাই এটার উপরের অংশ পার করে নিচে নামতে নামতে একটা সময় পর নিচে নামা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন, বরং ভেসে ভেসে সাঁতার কাটা শুরু করবেন।
তারপর আর গভীরে গেলে মনে হবে কেউ যেন জমে যাওয়া গ্যাসের স্ফটিক ছুঁড়ে মারছে আপনার দিকে। তবে, সুখবর হচ্ছে তাপমাত্রা বাড়বে এই পর্যায়ে। আগে ছিলো মাইনাস ২২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখন বেড়ে সেটা হবে মাইনাস ২০৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা মাইনাস ১৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে নিচের বায়ুমন্ডলে। আরেকটু নিচে গেলে দেখতে পাবেন বৃষ্টি, কিন্তু এটা যেমন তেমন বৃষ্টি না, হীরার বৃষ্টি! হ্যাঁ, ইউরেনাসে হীরার বৃষ্টি হয়। এর কারণ হলো ইউরেনাসের বায়ুমন্ডলে মিথেনের উপস্থিতি, একক কার্বনের যৌগ ৷ চরম চাপের কারণে এটি হীরার রূপ নেয়।
কিন্তু, দুঃসংবাদ হলো ইউরেনাস এর বাতাস৷ চারপাশে প্রায় ঘন্টায় ৯০০ কিলোমিটার গতিবেগে বাতাস বইতে থাকবে। আর এটা পৃথিবীর টাইপ ফাইভ হ্যারিকেনের চাইতেও প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশী শক্তিশালী। আর শ্বাস নেওয়া হয়ে যাবে রীতিমতো যেন কোনো সংগ্রাম৷ কারণ ততক্ষণে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের চাপের চেয়েও শতগুণ বেশী চাপের মধ্যে পড়ে গিয়েছেন আপনি।
নিজের রোবট জানিয়ে দিবে যে আপনি নতুন এক আবরণের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছেন যেটা পানি, অ্যামোনিয়া এবং মিথেন আইস দিয়ে বানানো৷ তবে, ইউরেনাসে কঠিন তেমন কিছু না থাকায় মাথা ফাটবে না আশা করা যায়৷ আর, রং তো এতটাই কালো হবে যে… বাদ দেই এই বর্ণনা৷
অত্যধিক পরিমাণের মধ্যাকর্ষণের কারণে নড়াচড়ার জো নেই৷ আর মারাত্মক পরিমাণে ঠান্ডা তো আছে-ই। কিন্তু, তার চেয়েও চিন্তার বিষয় হলো ইউরেনাসের চাপের পরিমাণ। আর যত কেন্দ্রের দিকে যাবেন এটা ততটাই বাড়তে থাকবে প্রতি মূহুর্তে। এটি এতটাই বেশী যে কেন্দ্রে যাওয়ার আগেই আপনাকে চ্যাপ্টা করে ফেলবে।
আর এই চরম পরিমাণের চাপের কারণে আপনার কার্বনের শরীর ততক্ষণে হীরা হয়ে যেতে পারে। প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার পরও আপনি যেতে থাকবেন কেন্দ্রের দিকে।
আর এই একমুখী যাত্রার এখানেই সমাপ্তি। রেস্ট ইন পিস…
হুজায়ফা আহমেদ / অতিথি প্রতিবেদক
+1
1
+1
3
+1
+1
+1
3
+1
+1
1