হেডলাইন দেখে আপনার মনে হয়তো বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কোনো নদীর ধারাবাহিক চিত্র ফুটে উঠেছে যেখানে ঐ বড় নদীটি ক্রমে বিভক্ত হয়ে কিছু শাখানদী এবং উপনদীতে পরিণত হয়। আলোক তরঙ্গের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা দৃশ্যমান এবং যখন আলোক তরঙ্গগুলি নির্দিষ্ট মাধ্যমে বাহিত হতে থাকে, তখন তাদের মূলপথ বিভক্ত হয়ে গাছের শাখা-প্রশাখার মত ছোট ছোট গতিপথে উপনীত হয়।
একে সাধারণত আলোক তরঙ্গের “শাখা প্রবাহ” বলা হয়ে থাকে, এমনকি এটি ইলেকট্রনিক প্রবাহ, সামুদ্রিক ঢেউয়ের প্রবাহ এবং শব্দ তরঙ্গের প্রবাহের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো এ ঘটনাকে দৃশ্যমান আলোকে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং উক্ত ঘটনাটিকে তারা লেজার রশ্মি এবং সাবানের সামান্য বুদবুদ দিয়ে পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন।
মূলত আলোর চলন মাধ্যমের কাঠামোর উপর ভিত্তি করে আলোর গতিপথে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হতে পারে; এই যেমন তরঙ্গ সংখ্যা কমে যেতে পারে, একদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে, বাঁকাতে পারে কিংবা প্রবাহিত হতে পারে। তবে “শাখা প্রবাহ” ঘটবার জন্য কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে আলোক মাধ্যমের কাঠামো অমসৃণ হলে ভালো হয় এবং মাধ্যমের গতিপথের প্রবাহ ঐ নির্দিষ্ট আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে বড় হতে হবে এবং এটিও যেন নিখুঁতভাবে পরিবর্তিত হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
যদি উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান থাকে, তবেই মাধ্যমের অভ্যন্তরে তরঙ্গের ছোট ছোট ঢেউ এবং আলোর গতিপথের ওঠানামা পুরো আলোক প্রবাহকে ছড়িয়ে দিতে পারে, যার ফলেই মূলত আলো বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়।
যদিও তরঙ্গের এমন বৈশিষ্ট্য সকলের কাছেই পরিচিত, তবে ব্যাপারটিকে ক্ষুদ্রভাবে বিবেচনা করাটা আসলেই চ্যালেঞ্জিং। আর তাই টেকনিয়ান-ইজরায়েল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পদার্থবিজ্ঞানীর একটি দল সাবানের সামান্য বুদবুদকে মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহার করে পুরো আলোক বিচ্ছুরণের ঘটনাটি পরীক্ষাকারে তুলে ধরেছেন।
আরেকটু সূক্ষ্মভাবে বিষয়টি নিয়ে বিবেচনা করা যাক, সাধারণত সাবানের বুদবুদের মেমব্রেন(ঝিল্লি) এর অণুগুলোর অন্তর্গত দুটি স্তরের মধ্যে তরল বাইলেয়ারের খুব পাতলা একটি প্রাচীর নিয়ে গঠিত। এই প্রাচীরটির পুরুত্ব প্রায় পাঁচ ন্যানোমিটার থেকে কয়েক মাইক্রোমিটার পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে। মূলত এই পরিবর্তনের কারণেই সাবানের বুদবুদগুলির ঝিল্লিতে বিভিন্ন বর্ণিল নিদর্শন দেখা যায়। তবে এটা বিশ্বাসযোগ্য যে, প্রবাহীতে আলোক রশ্মির প্রতিবিম্ব সৃষ্টির প্রবণতার দরুন সেই প্রবাহ বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হতে পারে।
যদিও পুরো ব্যাপারটা বাস্তবে আনা অতটা সহজ নয়। আবশ্যিক শর্ত হিসেবে বুদবুদের দুটি তরল স্তরের মধ্যে লেজারের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে হবে; অনেকটা সরু কোনো ছিদ্রপথে একটি ফাইবার তন্তু ঢুকিয়ে দেবার মত। পরবর্তীতে গবেষকরা ঝিল্লির উপরিভাগ জুড়ে সাবানের বুদবুদে লেজার রশ্মির উজ্জ্বলন পর্যবেক্ষণ করেন; যেভাবে আলোকদীপ্তি বিভক্ত হয়েছিল ঠিক সেভাবে। এরপর যখন তারা খানিক ফিকে সাদা আলো দিয়ে বুদবুদের ঝিল্লি আলোকিত করেন, তখন তারা এতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কিছু বিভক্ত নালি দেখতে পান যা রঙের বিভিন্নতাকেই নির্দেশ করে, আর এটাই পুরো আলোক রশ্মিকে শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত করেছে।
অন্যদিকে, সাবানের একটি বুদবুদের ঝিল্লির চারপাশে বায়ু প্রবাহ আলোর বিচ্ছুরণের মাত্রাকে দারুণ প্রভাবিত করে, ফলে পরবর্তীতে এর দিকমুখিতাও বিভিন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু যদি ঝিল্লিটিকে বায়ুপ্রবাহ থেকে আলাদা রাখা যায়, তখন আলোর রঙের মাত্রা কয়েক মিনিট স্থিতিশীল থাকতে পারে। আর তাই বিজ্ঞানীরা এই মাত্রা স্থির এবং চলমান দুটি অবস্থাতেই বুদবুদের ঝিল্লি প্রাচীরে তাদের লেজার রশ্মির পরীক্ষা করেন।
এই গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল সত্যিকার অর্থেই খুব আশানুরূপ ছিল। বুদবুদকে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করার ফলে এতে অপ্টোফ্লুডিক্সের কিছু নীতি কার্যকরী হয়েছে যা তরল মাধ্যমে আলোর গতিপথের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক এই সেটআপটি অন্য যেকোনো এক্সপেরিমেন্টেও ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এই সেটাপের মাধ্যমে কীভাবে অপটিক্যাল তরঙ্গ শাখা প্রবাহকে প্রভাবিত করে তাও পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।
হাসান সৈকত/ নিজস্ব প্রতিবেদক
+1
+1
1
+1
1
+1
1
+1
+1
+1