অতীতে পৃথিবীর সমস্ত ভূখণ্ড একত্রে পুঞ্জীভূত ছিলো। এই পুঞ্জীভূত ভূখণ্ডকে বলা হয় সুপারকন্টিনেন্ট বা অতিমহাদেশ। অতীতে এই সুপারকন্টিনেন্ট গুলো বেশ কয়েকবার একত্রিত হয়েছিলো এবং ভেঙ্গে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো বলে বিজ্ঞানীরা প্রমান পায়। সর্বশেষ যখন সমস্ত ভূখণ্ড একসাথে ছিলো, তখন তার নাম ছিলো প্যাঞ্জিয়া সুপারকন্টিনেন্ট (ছবি)। প্রায় ৩৩৫ মিলিয়ন বছর আগে এটি একত্রিত হয়েছিলো এবং প্রায় ১৭৫ মিলিয়ন বছর আগে এটি ভেঙে যেতে শুরু করে। কয়েকটি টেকটোনিক প্লেটে বিভক্ত হয়ে মহাদেশীয় ভূখণ্ডগুলো ছড়িয়ে যেতে থাকে এবং বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছায়।
বর্তমানে পৃথিবীর ভূত্বকটি এক ডজন বৃহৎ, অনিয়মিত আকারের টেকটোনিক প্লেট দ্বারা তৈরি। টেকটোনিক প্লেটগুলো কখনোই স্থির অবস্থায় থাকে না। এগুলো সর্বদাই একে অপরের সাপেক্ষে গতিশীল। কোনো কোনো অঞ্চলে আবার টেকটোনিক প্লেটগুলো ভেঙ্গে আলাদা হওয়ার প্রক্রিয়াও চলমান। পূর্ব আফ্রিকা-র আফার অঞ্চল এমনই এক অঞ্চল, যেখানে আফ্রিকান প্লেট ভেঙ্গে দুটি পৃথক ভূখণ্ডের সৃষ্টি হচ্ছে। এটি পৃথিবীর অন্যতম উষ্ণতম স্থান যেখানে দিনের বেলা তাপমাত্রা প্রায়শই ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকে এবং রাতের বেলা তা ৩৫ ডিগ্রি পর্যন্ত হয়।
এই জনশূন্য অঞ্চল তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত, যেগুলো একে অপর থেকে খুব ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই আফার অঞ্চলকে ভূতাত্ত্বিক পরিভাষায় বলা হয় আফার ট্রিপল জাংশন। বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন যে একটি জটিল ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া অবশেষে আফ্রিকাকে দু’ভাগে বিভক্ত করবে এবং এখন থেকে কয়েক মিলিয়ন বছর পরে একটি নতুন সমুদ্র অববাহিকা তৈরি করবে। আপাতত এর সর্বাধিক সুস্পষ্ট প্রমাণ হলো, ইথিওপীয় মরুভূমিতে ৩৫ মাইল দীর্ঘ ফাটল।
আফ্রিকা মহাদেশের টেকটোনিক ইতিহাস কয়েক দশক ধরে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তবে নতুন স্যাটেলাইট ছবি বিজ্ঞানীদের আরও ভালভাবে বুঝতে সহায়তা করছে যে, এই অঞ্চলে একটি নতুন সমুদ্র সৃষ্টি হওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে এতে অন্তত আরও ৫-১০ মিলিয়ন বছর সময় লাগবে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লিডসের ডক্টরাল শিক্ষার্থী ক্রিস্টোফার মুর বলেছিলেন “পৃথিবীতে এটিই একমাত্র জায়গা যেখানে আপনি বুঝতে পারবেন কীভাবে মহাদেশীয় ফাটল একটি মহাসাগরীয় ফাটলে পরিণত হয়।”
সাম্প্রতিক সময়ে, জিপিএস যন্ত্রগুলি গবেষণার এই ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এর ফলে বিজ্ঞানীরা সময়ের সাথে সাথে এই ভূখণ্ডটি কীভাবে সরে যায় তার সুক্ষ পরিমাপ করতে পারছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক ভূ-তাত্ত্বিক অধ্যাপক কেন ম্যাকডোনাল্ড বলেছিলেন “জিপিএস পরিমাপের সাহায্যে, আপনি প্রতি বছর মিলিমিটার হারে প্লেটগুলোর চলাচলের হার পরিমাপ করতে পারবেন। যেহেতু আমরা জিপিএস থেকে আরও বেশি পরিমাপ পাই, তাই আমরা এখানে কী চলছে তার আরও বৃহত্তর ধারণা পেতে পারি।”
নিউ অরলিন্সের তুলান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূপদার্থ বিশেষজ্ঞ সিনথিয়া অ্যাবিঞ্জার আফার অঞ্চলে অসংখ্য ফিল্ড গবেষণা করেছেন। তার মূল গবেষণা ছিলো ইথিওপীয় মরুভূমিতে ৩৫ মাইলের এক বিশাল ফাটল নিয়ে, যেটি ২০০৫ সালে সৃষ্টি হয়েছিলো। ফাটলটি হঠাৎই কয়েক দিনের মধ্যে অনেক বেশি উন্মুক্ত হয়ে যায়, যা কয়েকশ বছরের টেকটোনিক প্লেট আন্দোলনের সমতুল্য ছিলো। এ্যাবিঞ্জার মনে করেন ভূঅভ্যন্তরের ম্যাগমা থেকে ক্রমবর্ধমান চাপ আফার অঞ্চলের এই বিস্ফোরক ঘটনাকে ত্বরান্বিত করতে পারে। তিনি এই দৃশ্যের সাথে একটি অতিরিক্ত বাতাসযুক্ত বেলুনকে তুলনা করেন, যেটি ভিতর ও বাহিরের বাতাসের চাপের তারতম্যের কারনে ফেটে যায়। অনুরূপ ফাটল কেনিয়া সহ পূর্ব আফ্রিকার সুবিশাল অঞ্চলজুড়ে বিদ্যমান যার অধিকাংশই গভীর লেকের তলদেশে লুকায়িত।
আফার অঞ্চলে প্রতিটি প্লেট বিভিন্ন গতিতে একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ম্যাকডোনাল্ডের মতে, আরবীয় প্লেট প্রতি বছর প্রায় ১ ইঞ্চি হারে আফ্রিকা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এবং আফ্রিকার দুটি প্লেট অর্থাৎ নুবিয়ান প্লেট ও সোমালি প্লেট প্রতি বছর আধা ইঞ্চি থেকে ০.২ ইঞ্চি হারে পৃথক হচ্ছে। ম্যাকডোনাল্ড বলেছেন, “এডেন উপসাগর এবং লোহিত সাগর থেকে পানি আফার অঞ্চল পার হয়ে পূর্ব আফ্রিকান রিফট উপত্যকায় গিয়ে একটি নতুন সাগরের সৃষ্টি করবে এবং পূর্ব আফ্রিকার সেই পৃথকীকৃত অংশটি ছোট মহাদেশে পরিণত হবে।”
রিফটিং প্রক্রিয়া অনেক ধীরগতিতে ঘটে, তবে গবেষকরা বলছেন যে এই পরিবর্তনটি সংঘটিত হওয়ার স্পষ্ট লক্ষণ রয়েছে। “আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মহাসাগরীয় ভূত্বক তৈরি হতে শুরু করেছে, কারণ এটি এর উপাদান এবং ঘনত্বের দিক থেকে মহাদেশীয় ভূত্বক থেকে আলাদা।” এসকল তথ্য, প্রমাণ থেকে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে, আফ্রিকা মহাদেশ ভেঙ্গে পৃথক মহাদেশ সৃষ্টি হবে তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে কয়েক মিলিয়ন বছর!