আমরা সাধারণত বড়দের কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ে সর্তক থাকতে দেখি, তাও যখন তারা কোন সমস্যায় ভোগেন। সুস্থ থাকলে এসব বিষয়ে কেউ ভাবেও না। কিন্তু সত্য হলো, প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়মিতভাবে প্রতি ৪ থেকে ৬ বছর অন্তর কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত আর ১৮ বছর বয়সের আগে ১/২বার কোলেস্টেরলের পরিমাণ মাপার দরকার হয়, কোন সমস্যা না থাকেলও। কারণ, ছোট থেকে যত বড় হতে থাকবেন, আপনার দেহে কোলেস্টেরল উৎপাদনের পরিমাণও বাড়তে থাকে।এখন প্রশ্ন হল, আপনার দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা কত থাকতে হবে?
কোলেস্টেরলের মাত্রা বয়স, ওজন এবং লিঙ্গ অনুসারে পরিবর্তিত হয়।তাই আপনার বয়স,ওজন এবং লিঙ্গ এর ভিত্তিতে পরিমাপ করা যাবে আপনার দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা কত থাকতে হবে।কোলেস্টেরলকে তিনটি ভাগে ভাগ করে পরিমাপ করা হয়। এগুলো হলোঃ
২.এলডিএল (LDL) বা ‘খারাপ কোলেস্টেরল’;
৩.এইচডিএল (HDL) বা ‘ভাল কোলেস্টেরল’।
অনেক মানুষ প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে উক্ত কোলেস্টেরলগুলোর মাত্রাকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে। মোট কোলেস্টেরলের মাত্রা এবং এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা যত কম রাখা যাবে, তত বেশি এইচডিএল কোলেস্টেরল হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক সহ হার্ট-সম্পর্কিত অসুস্থতা বাড়ার সম্ভবনা থেকে আপনার দেহকে সুরক্ষা দিতে পারে।
কোলেস্টেরলের মাত্রা এবং বয়সঃ
বয়সের সাথে সাথে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়তে থাকে। চিকিৎসকরা অল্প বয়স থেকেই বিপজ্জনকভাবে উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল বৃদ্ধির প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন। বছরের পর বছর নিয়ন্ত্রণবিহীন কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পেলে তার চিকিৎসা করাও সহজ নয়।
বাচ্চাদের কোলেস্টেরলের উচ্চ মাত্রা থাকার সম্ভাবনা থাকে না। তাই তাদের ১৮ বছর বয়সের আগে কেবল ১/২বার কোলেস্টেরলের পরিমাণ মাপার দরকার হয়। তবে, যদি কোলেস্টেরলের উচ্চ মাত্রা শিশুর ঝুঁকির কোন কারণ হয়, তবে তাদের ঘন ঘন পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
সাধারণত, পুরুষদের মধ্যে মহিলাদের তুলনায় সারাজীবন কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকে। তবে, মহিলারা একেবারেই উচ্চ কোলেস্টেরল প্রতিরোধী নন। মেনোপজের (Menopause) সময় একজন মহিলার কোলেস্টেরল প্রায়শই বাড়ে।
এবার জেনে নেওয়া যাক, কোলেস্টেরলের কত মাত্রা আপনার দেহের জন্য গ্রহণযোগ্য?
সুপারিশকৃত কোলেস্টেরলের মাত্রাঃ
কোলেস্টেরলের স্বাস্থ্যকর মাত্রা সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য হয় না। সুপারিশকৃত কোলেস্টেরলের মাত্রায় ভিন্নতার কারণ অন্যান্য শারীরিক স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং আরও অনেক দিক বিবেচনায়-
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কোলেস্টেরলের মাত্রাঃ
★প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মোট কোলেস্টেরলের মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে ২০০ মিলিগ্রামের চেয়ে কম হলে গ্রহণযোগ্য। ২০০ থেকে ২৩৯ mg/dl এর মধ্যে থাকলে তা গ্রহণযোগ্য কোলেস্টেরলের শেষ উচ্চ সীমারেখা এবং ২৪০ mg/dl এবং এর উপরের হলে কোলেস্টেরলের মাত্রা গ্রহণযোগ্য নয়।
★এলডিএল(LDL) কোলেস্টেরলের মাত্রা ১০০ mg/dl এর চেয়ে কম থাকা উচিত। ১০০থেকে ১২৯ mg/dl মাত্রা পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য যদি কোনও স্বাস্থ্য সমস্যা না থাকে। তবে হৃদরোগ বা হৃদরোগের ঝুঁকির কারণ আছে এমন ব্যক্তিদের সচেতন থাকতে হবে এই সীমারেখাতেও। ১৩০ থেকে ১৫৯ gm/dl পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য শেষ উচ্চ সীমারেখা এবং ১৬০ থেকে ১৮৯ gm/dl হলে উচ্চ এবং ১৯০ mg/dl বা তার চেয়ে বেশি হলে কোলেস্টেরলের মাত্রা খুব বেশি হিসেবে ধরা হয়,যা গ্রহণযোগ্য নয়।
★এইচডিএল(HDL)মাত্রা উচ্চতর রাখা উচিত। ৪০ gm/dl এর চেয়ে কম হলে হৃদরোগের জন্য ঝুঁকির কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়। ৪১ থেকে ৫৯ mg/dl পর্যন্ত হচ্ছে শেষ গ্রহণযোগ্য নিম্নসীমা। এইচডিএল এর জন্য সর্বোত্তম মাত্রা হলো ৬০ mg/dl বা তার বেশি।
বাচ্চাদের জন্য কোলেস্টেরলের মাত্রাঃ
শিশুদের মধ্যে শুধু মোট কোলেস্টেরল এবং এলডিএল কোলেস্টেরলের গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ভিন্নতা দেখা যায়।
★শিশুর জন্য মোট কোলেস্টেরলের একটি গ্রহণযোগ্য পরিসর ১৭০ mg/dl এর চেয়ে কম। বাচ্চার জন্য মোট কোলেস্টেরলের সর্বোচ্চসীমা হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৯৯ mg/dl পর্যন্ত এবং ২০০ mg/dl এর বেশি হলে, কোলেস্টেরলের পরিমাণ অনেক বেশি হিসাবে বিবেচিত অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য নয়।
★কোন শিশুর এলডিএল (LDL) কোলেস্টেরলের মাত্রা একজন প্রাপ্তবয়স্কের চেয়ে কম হওয়া উচিত। কোন শিশুর জন্য এলডিএল কোলেস্টেরলের সর্বোত্তম পরিসর ১১০ mg/dl এর চেয়ে কম। গ্রহণযোগ্য উচ্চসীমা ১১০ থেকে ১২৯ mg/dl পর্যন্ত হয়। তবে ১৩০ mg/dl এর বেশি হলে তা খারাপ।
কিছু পরামর্শঃ
শিশুদের ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য কোলেস্টেরলের মাত্রা ব্যালেন্সে রাখতে সর্বোত্তম পরামর্শটি হল স্বাস্থ্যকর এবং সক্রিয় জীবনযাপন করা, এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যকর আহার খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা।
অলস, অতিরিক্ত ওজনযুক্ত শিশুরা, যারা প্রক্রিয়াজাত খাবারযুক্ত উচ্চ ফ্যাটযুক্ত আহার খায় তাদের উচ্চ কোলেস্টেরল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যেসব শিশুদের উচ্চ কোলেস্টেরলের পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে তাদের ঝুঁকিও বেশি হতে পারে।
সাধারণত, প্রথমদিকে যারা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন শুরু করে, তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক থাকে। কোলেস্টেরলের মাত্রা অনেক বেশি হয়ে গেলে তা কমানোও কষ্টকর হয়। তাই, প্রাপ্তবয়স্কদের সক্রিয় থাকতে হবে এবং নিয়মিত অনুশীলন করা উচিত। মেনোপজের মধ্যে দিয়ে যায় এমন মহিলারা এবং যাদের উচ্চ কোলেস্টেরল আছে, তারা ডায়েটের পাশাপাশি ওষুধের গ্রহণের মাধ্যমে কোলেস্টেরলের মাত্রা আরও দ্রুত হ্রাস করতে পারেন।
যে কোন বয়সে উচ্চ কোলেস্টেরল আপনাকে হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। এই ঝুঁকিগুলি সময়ের সাথে সাথে আরও বৃদ্ধি পায়, বিশেষত প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে যারা তাদের কোলেস্টেরল বৃদ্ধি হ্রাস করতে কোন পদক্ষেপ নেয় না। তাই কোলেস্টেরল বৃদ্ধি রোধে প্রথম প্রয়োজন সচেতনতা।
চিকিৎসাঃ
কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করতে এবং তাদের বৃদ্ধিতে বাধা দিতে ব্যবহার করতে পারেন এমন একটি সম্ভাব্য পদ্ধতি হ’ল Therapeutic Lifestyle Changes (TLC), যার মধ্যে ডায়েট, ব্যায়াম এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ অন্তর্ভুক্ত। অন্য একটি বিকল্প হল ড্রাগ ট্রিটমেন্ট, যা কোলেস্টেরল কমায় বা কোলেস্টেরলের শোষণকে হ্রাস করে।
যে কোন বয়সে, আপনার আহারে স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাট যদি কম থাকে এবং দ্রবণীয় ফাইবার ও প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে তা কোলেস্টেরল বৃদ্ধি রোধের জন্য ভাল। আর টিএলসি (TLC) ডায়েট হলো কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং কম ট্রান্স ফ্যাট খাওয়ার পরিকল্পনা। যারা এই ডায়েট অনুসরণ করে তাদের প্রতিদিন স্যাচুরেটেড ফ্যাট থেকে ৭% এর কম ক্যালোরি এবং ২০০ মিলিগ্রামেরও কম ডায়েটারি কোলেস্টেরল গ্রহণ করা উচিত। টিএলসি ডায়েট মানুষকে নিম্নলিখিত খাবারগুলি খেতে উৎসাহ দেয়:
১.ফল;
২.শাকসবজি;
৩.আস্ত শস্যদানা (Whole Grains);
৪.কম চর্বিযুক্ত বা ননফ্যাট দুগ্ধজাতীয় পণ্য;
৫.মাছ;
৬.চামড়া ছাড়া পোল্ট্রি;
৭.চর্বিহীন মাংস;
পাশাপাশি টিএলসি ডায়েট কেবল প্রয়োজনীয় ক্যালোরি গ্রহণের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ওজন বজায় রাখতে এবং ওজন বৃদ্ধি এড়াতে সাহায্য করে। দ্রবণীয় ফাইবার যুক্ত খাবারে মার্জারিন এর মতো কিছু উপাদান থাকে যা ডায়েটের এলডিএলের শক্তি হ্রাস করতে পারে।
টিএলসি ডায়েটের বিভিন্ন বই পাওয়া যায় অনলাইনে, ক্রয় করতে পারেন এবং কোলেস্টেরল কমাতে ডায়েট পরিকল্পনা অনুসরণ করতে আগ্রহীদের সহায়তা করতে পারেন।
সঠিক ওজন নিয়ন্ত্রণ কোলেস্টেরল কমাতে এবং এর বৃদ্ধির প্রতিরোধে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতিরিক্ত ওজনযুক্ত ব্যক্তিরা যদি তাদের ওজন হ্রাস করার চেষ্টা করেন, এতে এলডিএল এর পরিমাণও কমে যাবে। তাদের অবশ্যই ওজন কমাতে চেষ্টা করতে হবে, যাদের
১.ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা উচ্চ
২.এইচডিএল মাত্রা কম
৩.পুরুষদের অতিরিক্ত ওজনসহ কোমরের পরিমাপ ৪০ ইঞ্চির বেশি
৪.মহিলাদের অতিরিক্ত ওজনসহ কোমরের পরিমাপ ৩৫ ইঞ্চির বেশি।
দিনে ৩০ মিনিট নিয়মিত শারীরিক ক্রিয়াকলাপ প্রত্যেকের জন্য বাঞ্ছনীয়। এটি ওজন নিয়ন্ত্রণে যেমন সহায়তা করবে, তেমনি কোলেস্টেরল হ্রাস করতেও সাহায্য করে।
এই পদক্ষেপগুলি কোলেস্টেরল কমাতে পর্যাপ্ত না হলে ওষুধের মাধ্যমেও কমানোর চেষ্টা করার প্রয়োজন হতে পারে। বিভিন্ন ধরণের কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ পাওয়া যায়, এর মধ্যে রয়েছে:
১.স্ট্যাটিনস(Statins): এই ওষুধগুলি লিভারকে কোলেস্টেরল উৎপাদন করতে বাধা দেয়।
২.পিত্ত অ্যাসিড ক্রম (Bile Acid Sequestrants): এই ওষুধগুলি খাবার থেকে শোষিত ফ্যাটের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
৩.কোলেস্টেরল শোষণ নিরোধকঃ এই ওষুধগুলি রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড এর পরিমাণ কমিয়ে দেয় এবং খাদ্য থেকে প্রাপ্ত কোলেস্টেরলের পরিমাণ হ্রাস করে।
৪.কিছু ভিটামিন এবং পরিপূরক; যেমন নায়াসিন, যা লিভারকে এইচডিএল অপসারণে বাঁধা দেয় এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ কমায়।
৫.ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডঃ এই অ্যাসিডগুলি এইচডিএলের পরিমাণ বাড়ায় এবং ট্রাইগ্লিসারাইড কমায়।
কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর সর্বোত্তম সমাধান হলো আপনার জীবনধারা এবং ডায়েট ঠিক রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম করা। আপনার খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা যদি অনেক বেশি বেড়ে যায়, তা কমিয়ে আনার জন্য সর্বোত্তম পরামর্শ হলো, আপনি একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।
অতএব, সুস্থ থাকতে আপনার অতিরিক্ত খাওয়া, অতিরিক্ত অলসতা, অতিরিক্ত ঘুম; অর্থাৎ সব ‘অতিরিক্ত’ বাদ দিতে হবে। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করুন, আর সুস্থ থাকুন।
তানজিনা সুলতানা শাহীন/নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ মেডিনিউজ টু-ডে