আগ্নেয়গিরি ও অগ্নুৎপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা মাঝে মাঝে এমন ভয়ংকর হয়ে ওঠে যে পৃথিবী নির্বাক হয়ে যায়। তাই, এসম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভবিষ্যদ্বাণী সবচেয়ে বেশি কাজের। যদিও অগ্ন্যুৎপাত হুটহাট আঘাত হানে, তবুও এর ভবিষ্যদ্বাণী সকলকে সচেতন রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে।
আগ্নেয়গিরি বিষয়ক বিজ্ঞান (ভলকানোলজি) হ’ল আগ্নেয়গিরিগুলির উপর গবেষণা, তাদের গঠন এবং ইতিহাস নিয়ে পর্যালোচনা। যেসকল ভূ-তাত্ত্বিকরা আগ্নেয়গিরির ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ এবং সক্রিয় সাইটগুলি পরিদর্শন করার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ তারা আগ্নেয় বিশেষজ্ঞ (ভলকানোলজিস্ট) হিসাবে পরিচিত।
আগ্নেয়গিরির উপর নানা রকম গবেষণা যেমন: ভূমিকম্পের ক্রিয়াকলাপ, আগ্নেয়গিরির তাপমাত্রা ও রাসায়নিক পরিবর্তনের ডেটা সংগ্রহ ইত্যাদি বিস্ফোরণের পূর্বাভাস দিতে ও অনেক প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি আর মানুষের জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এখন প্রথমে আমাদের জানতে হবে আগ্নেয়গিরি কি?
আগ্নেয়গিরি হলো বিশেষ ধরনের পাহাড় যার ভেতর দিয়ে ভূ-অভ্যন্তরের উত্তপ্ত ও গলিত পাথর, ছাই এবং গ্যাস বেরিয়ে আসতে পারে। ভূস্তরের কোনো ফাটল বা ছিদ্রপথ দিয়ে ভূগর্ভস্থ গরম বাতাস, জলীয় বাষ্প, গলিত শিলা, কাঁদা, ছাই, গ্যাস প্রবল বেগে বেরিয়ে আসে। আগ্নেয়গিরি থেকে ভূগর্ভস্থ পদার্থের এই নির্গমনকে বলা হয় অগ্ন্যুৎপাত। আগ্নেয়গিরি সাধারণত মোচাকৃতির হয়, কারণ ভূ অভ্যন্তর থেকে নির্গত উত্তপ্ত লাভা ভূপৃষ্ঠের শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে দ্রুত ঠান্ডা হয়ে কঠিন আকার ধারণ করে যা ফাটলের চারপাশে এসে ধীরে ধীরে জমা হয়।
প্রায় ৮০% সক্রিয় স্থলজ আগ্নেয়গিরি পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের (ভূত্বকীয় পাত) সীমানায় পাওয়া যায়। প্লেটগুলি ভূত্বক বা ক্রাস্ট এবং তার নীচে আস্তরণের অনমনীয় অংশ থেকে তৈরি হয়, যা লিথোস্ফিয়ার হিসাবে পরিচিত। যেখানে প্লেটগুলি একটি অন্যটির উপর উপরিপাতিত হয়- এই অঞ্চলগুলিকে সাবডাকশন অঞ্চল বলা হয়।
আগ্নেয়গিরি বিভিন্ন আকার এবং আকৃতির হয়। সিলিন্ডার কোণ (বা)শঙ্কু হ’ল সবচাইতে সরল ধরনের, এটি তখন তৈরি হয় যখন একটি ভেন্ট বিস্ফোরিত হয়ে ম্যাগমা নির্গত হয়। স্ট্রোটোভলকানোস বা যৌগিক আগ্নেয়গিরিগুলি হ’ল লম্বা, খাড়া আগ্নেয়গিরির পাহাড় যা আমরা প্রায়শই দেখতে পাই অর্থাৎ, আগ্নেয়গিরি বলতে আমাদের মাথায় এদের চিত্রই ভেসে ওঠে, যেমন: জাপানের মাউন্ট ফুজি বা ওয়াশিংটনের মাউন্ট সেন্ট হেলেন্স। এগুলি অনবরত লাভা প্রবাহ, ছাই এবং আগ্নেয়গিরির বোমা (গরম শিলা ধ্বংসাবশেষ যাকে টেফ্রাও বলা হয়) থেকে গঠিত হয়।
আগ্নেয়গিরি বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেন কখন ভেন্ট সক্রিয় বা কখন অগ্নুৎপাত হতে চলেছে। তারা ভূগর্ভস্থ ক্রিয়াকলাপগুলো যেমন ম্যাগমা মুভিং, গ্যাস নির্গমন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা ভূগর্ভস্থ জলবাহী মাধ্যমে প্রবাহিত ম্যাগমা দ্বারা সৃষ্ট পৃষ্ঠের বিকৃতি হিসাব করে ভূগর্ভস্থ ক্রিয়াকলাপ রেকর্ড করতে সিসমোগ্রাফিক তথ্য ব্যবহার করেন।
প্রতি বছর প্রায় ৬০টি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটে।
মূলতঃ তিন ধরনের আগ্নেয়গিরি রয়েছে, যেমন:
১) জাগ্রত (Active)– যেসব আগ্নেয়গিরির মুখে সদাই নিয়মিত ভাবে ধোঁয়া, ছাই, গলিত লাভা, গ্যাস থাকে, সেসকল আগ্নেয়গিরিকে জাগ্রত আগ্নেয়গিরি বলে। যেমন- মাউণ্ট এটনা
২) সুপ্ত (Dorment)– যেসকল আগ্নেয়গিরির আগে উদগীরণ হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে সক্রিয় অবস্থায় নাই, কিন্তু যেকোনো সময় উদগীরণ হবার সম্ভাবনা আছে, সেসব আগ্নেয়গিরিকে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি বলে। যেমন – জাপানের ফুজিয়ামা ৷
৩) লুপ্ত (Extinct)– যেসসব আগ্নেয়গিরি কোন এক সময় জাগ্রত ছিল কিন্তু আগামীতে বা ভবিষ্যতে এর অগ্ন্যুৎপাত হবার কোনো সম্ভাবনা নাই, সেসকল আগ্নেয়গিরিকে লুপ্ত আগ্নেয়গিরি বলা হয়। যেমন – আফ্রিকার কিলিমাঞ্জারো
এর মধ্যে জাগ্রত আগ্নেয়গিরি ভয়াবহ। এই ধরনের আগ্নেয়গিরির থেকে সবচেয়ে বেশি অগ্নুৎপাত হয়। তারপরেই সুপ্ত আগ্নেয়গিরি অবস্থান। কখনো কখনো লুপ্ত ও সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মুখে পানি জমা হয়ে হ্রদের সৃষ্টি হয়। এ ধরণের হ্রদকে আগ্নেয়গিরি হ্রদ বলে।
সুপারভলক্যানোগুলো কিছু অঞ্চলের জন্য উদ্বেগের বিষয়, কিন্তু সুপার ভলক্যানো কারা?
অগ্ন্যুৎপাত আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ সূচক (ভিইআই) দিয়ে মাপা হয় এবং মাউন্ট টাম্বোরা এক থেকে আট স্কেলের সূচকে সপ্তম ভয়াবহ আগ্নেয়গিরি। তবে আরো অনেক ভয়াবহ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা অতীতে ঘটেছে, যারা সুপার ভলক্যানো হিসাবে পরিচিত ও মহাদেশীয় বিধ্বস্ততা তৈরি করতে পারে এমনকি সম্পূর্ণ ধ্বংসও এনে দিতে পারে। কিন্তু, বিজ্ঞানীরা বলেছেন, তারা নিয়মিত এসব আগ্নেয়গিরিকে মনিটর করছেন এবং এর ফলে হয়তো এমন কোন উপায় বের হতে পারে যা আমাদের এইসকল সুপার ভলক্যানো হতে রক্ষা করবে।
জাকিয়া খানম তিশা/ নিজস্ব প্রতিবেদক