আজ থেকে ঠিক ১oo বছর পূর্বে জার্মান পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন বিজ্ঞান জগৎ কে আলোকিত করেছিলেন তড়িৎ ক্রিয়ার প্রভাব আবিষ্কার করে। তিনি আলোকে কণা এবং তরঙ্গ উভয় হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। তার এই অবদানের জন্য ১৯২১ সালে তাঁকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়। এর পর বিজ্ঞানী আইনস্টাইন নিউক্লিয়ার ফিউশন এবং ফিশান তত্ত্বে অবদান রাখেন। বিভিন্ন তর্কবিতর্ক উপেক্ষা করে তিনি পারমাণবিক শক্তির পথ সুগম করার জন্য, পারমাণবিক অস্ত্র বিস্ফোরণ কিভাবে হয় তা উদ্ভাবন করেন।
৬৯ বছর পূর্বে প্রথম যখন পারমাণবিক বিস্ফোরণের রাসায়নিক ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করা হয়েছিল, তখন ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত উপাদানটি সকলের কাছেই অজানা ছিল। তাই বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের পারমাণবিক বিস্ফোরণ তত্ত্বের ধারণা পাওয়ার পরে সকল বিজ্ঞানীর সম্মতিতে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের নাম অনুসারে নতুন আবিষ্কৃত উপাদানটির নাম রাখা হয় আইনস্টানিয়াম এবং উপাদানটিকে মৌলের পর্যায় সারণিতে স্থান দেওয়া হয়।
আইনস্টাইনের নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার ১oo বছর পরে রসায়নবিদরা আইনস্টানিয়ামের রাসায়নিক আচরণ সন্ধান করতে সক্ষম হন।
পর্যায় সারণির ৯৯ তম উপাদানটির নাম আইনস্টানিয়াম- Einsteinium. এটি ১৯৫২ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয় প্রশান্ত মহাসাগরের এলুগেলাব দ্বীপে ‘আইভি মাইক‘ নামক একটি থার্মোনিউক্লিয়ার ডিভাইস বিস্ফোরণের মাধ্যমে। হাইড্রোজেন বোমার প্রথম প্রদর্শন ছিল ‘আইভি মাইক’ বিস্ফোরণ। এই ধরণের বিস্ফোরণ পারমাণবিক বোমার চেয়েও ৪ গুণ বেশি শক্তি তৈরি করে (যেমন-১৯৪৫ সালে জাপানে যে পারমাণবিক বোমা পড়েছিল) এই ধরণের বিস্ফোরণ একই পরিমাণ কয়লা পোড়ানোর চেয়েও ৪ মিলিয়ন গুন বেশি শক্তি তৈরি করে।
‘আইভি মাইক’ বিস্ফোরণের ফলস্বরুপ, প্রথমবারের মতো রাসায়নিক ধ্বংসাবশেষ থেকে ৯৯ পারমাণবিক সংখ্যা বিশিষ্ট মৌলের উপাদান পাওয়া যায়। আইনস্টানিয়াম খুব দুর্লভ একটি মৌল। কারণ, দীর্ঘ ৯ বছর বিজ্ঞানীরা পরিশ্রম করে ১৯৬১ সালে ৯৯টি উপাদান সংশ্লেষণ করার সাফল্য অর্জন করেন। ‘পান্ডা ‘নামক একটি দল ‘আইভি মাইক‘ প্রকল্পটি পরিচালনা করেন। তাই গবেষকরা প্রথমে দলটির নাম অনুসারে উপাদানটির নাম ‘পান্ডোমোনিয়াম’ রাখার চিন্তা করেন। তবে শেষ পর্যন্ত তারা আলবার্ট আইনস্টাইনকে সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং আইনস্টানিয়াম- Einsteinium নামকরণ করেন। কিন্তু সেই সময়, ‘আইনস্টানিয়াম’ সম্পর্কে মানুষের ধারণা ও খুব কম ছিল।
আইনস্টানিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা অনেক বেশি এবং তাপীয় বিস্ফোরণের সাথেও এটি জড়িত। তাই সেই সময় এই উপাদানটির পরীক্ষা করাও ছিল খুব কঠিক কাজ। আপনি শুনলে সত্যি খুব অবাক হবেন, মাত্র ১ গ্রাম আইনস্টানিয়াম- Einsteinium ১ হাজার ওয়াট শক্তি উৎপাদন করে। পাশাপাশি এটি ক্ষতিকর গামা রশ্মি ও নির্গত করে। তাই উপাদানটি নিয়ে কাজ করার সময় গবেষকদের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
আইনস্টানিয়াম পরমাণুর নিউট্রন সংখ্যার উপর ভিত্তি করে এর নামকরণ করা হয় ES-253। এর অর্ধায়ু মাত্র ২o দিন অর্থাৎ ২o দিন পর উপাদানটির আয়ু অর্ধেক কমে যায়। কয়েক মাস পর বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন, যেসকল কাজে এটি ব্যবহারিকভাবে ব্যবহৃত হয় সেখানে তার কিছু পরিমাণ ও অদৃশ্য হয়ে যায়। আপনি শুনলে অবাক হবেন, উপাদানটির রহস্য আবিষ্কার করার জন্য প্রায় ৭o বছর সময় লাগে।
তবে, এখন বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি এবং বার্কলেতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল প্রাথমিকভাবে আইনস্টানিয়ামের উপর গবেষণা করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আইনস্টানিয়াম সরিয়ে নিয়েছেন। গবেষকরা তাদের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন, তারা আইনস্টানিয়াম গবেষণা করার জন্য ES-254 এর মাত্র ২oo ন্যানোগ্রাম ব্যবহার করেন (এক ন্যানোগ্রাম ১ গ্রামের ১ বিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ) অর্থাৎ এই পরীক্ষাটি খুব ছোট স্কেলে করা হয়।
স্ট্যানফোর্ড সিনক্রোট্রন রেডিয়েশন লাইটোর্সসের অধীনে গবেষক দলটি আইনস্টানিয়াম কিভাবে অন্যান্য উপাদানের সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে এবং উচ্চ শক্তির আলোক রশ্মির মাধ্যমে তাদের কাঠামো প্রকাশ করতে সক্ষম হয় তা দেখিয়েছেন। অন্যান্য পরমাণুর সাথে আইনস্টাইন পরমাণুর বন্ধন দূরত্ব জানার মাধ্যমে গবেষকরা ধারণা করতে পারেন যে আইনস্টানিয়ামযুক্ত অন্যান্য যৌগগুলোর সংমিশ্রণ কেমন হবে।
গবেষকরা আইনস্টানিয়ামের শেষ কক্ষপথের ব্যাসার্ধ পরিমাপ করতেও সক্ষম হন। এটি মহাবিশ্বের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য। কারণ, মহাবিশ্ব যে বিল্ডিং ব্লক গুলো থেকে তৈরি হয়েছে, এটি তার আকার নির্ণয় করতে সহায়তা করে।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভারী রাসায়নিক উপাদানটি হচ্ছে আইনস্টানিয়াম- Einsteinium. এটি পরীক্ষা করার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন ভবিষ্যতে একইভাবে অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানগুলো সংশ্লেষণ করার পাশাপাশি আরো নতুন কোনো রাসায়নিক মৌল/ যৌগ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হবেন।
আমেনা আঁখি/নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ theconversation.com, দ্যা স্প্রিঙ্গার, ন্যাচার