প্লাস্টিক আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অনন্য উপাদান হলেও পরিবেশের ক্ষতি করার ক্ষেত্রে এর জুড়ি নেই। তাই যতই সহজলভ্য হোক না কেন বিজ্ঞানীরা সবসময়ই প্লাস্টিকের বিকল্প খুঁজে বেঁড়ান এবং এক্ষেত্রে তারা অনেকাংশেই সফল। সাম্প্রতিক সময়ে স্পেনের কর্ডোবা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জিরোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক অ্যাভোকাডো গাছের বর্জ্য বা অবশিষ্টাংশ থেকে পরিবেশবান্ধব ফুড প্যাকেজিং তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। এইসব অবশিষ্টাংশ বায়োমাসের উৎস হিসেবে কাজ করে। এই উদ্যোগটি স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় আন্দালুসিয়া অঞ্চলে হয়েছিল, যা প্রচুর পরিমাণে ফলের গাছ, বিশেষ করে অ্যাভোকাডোর জন্য পরিচিত।
কর্ডোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্টের সহকারী অধ্যাপক এডুয়ার্ডো এস্পিনোসা বলেন,
“অন্যান্য অ্যাভোকাডো উপজাতের তুলনায় অ্যাভোকাডো গাছের অবশিষ্টাংশে সেলুলোজ উপাদানের আধিক্য রয়েছে, যা অন্যান্য কৃষি গাছের প্রজাতির মতোই।“
সেলুলোজ, উদ্ভিদে পাওয়া একটি বায়োপলিমার (প্রাকৃতিক পলিমার যা জীবিত প্রাণীর কোষ থেকে উৎপাদিত হয়), ফুড প্যাকেজিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা পলিইথিলিনের মতো কৃত্রিম পদার্থকে শক্তিশালী করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে এবং এই উপাদানটিই অ্যাভোকাডো গাছের অবশিষ্টাংশ থেকে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
যাইহোক, পলিথিন সাধারণত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে পাওয়া যায় এবং এটি বায়োডিগ্রেডেবল (পচনশীল) নয়, তাই এটিকে টেকসই বলা চলে না। তাই বায়োইথানল বা উদ্ভিদ-ভিত্তিক উৎস থেকে উৎপাদিত পলিথিন একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। কারণ উদ্ভিদভিত্তিক উপাদান সেলুলোজ থেকে তৈরিকৃত মোড়ক অবশ্যই পচনশীল হবে। ফলে এটি পরিবেশের তেমন ক্ষতিও করবে না।
পলিথিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধিকরণ
এস্পিনোসা এবং তার সহকর্মীরা আশা করেছিলেন অ্যাভোকাডো ছাঁটাইয়ের অবশিষ্টাংশ থেকে প্রাপ্ত ফাইবারগুলোর সাথে বায়ো-পলিইথিলিনকে আংশিকভাবে প্রতিস্থাপন করে একটি পরিবেশ বান্ধব ফুড প্যাকেজিং তৈরি করতে পারবেন।
এ লক্ষ্যে তারা লিগনোসেলুলোসিক (বায়োমাসের আরেকটি প্রধান উপাদান যা উদ্ভিদের কোষ প্রাচীরে পাওয়া যায়। উদ্ভিদের কোষগুলোকে শক্তি, স্থিতিশীলতা এবং রক্ষা প্রদান করে) ফাইবার তৈরি করার জন্য অ্যাভোকাডো ছাঁটাইয়ের অবশিষ্টাংশকে একটি সিকোয়েন্সে একত্রিত করেছিল এবং ফাইবারগুলোকে আলাদা করার মাধ্যমে লিগনিন সংরক্ষণ করেছিল।
“এর বৈশিষ্ট্য বেশ মজাদার কারণ, লিগনিনের অবশিষ্ট উপাদান সেলুলোজ ফাইবার এর সাথে যুক্ত করতে পারলে এর ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে,” স্পিনোসা ব্যাখ্যা করেছিলেন। গবেষকরা তারপর একটি উচ্চ কার্যক্ষমতা সম্পন্ন মিক্সচার ব্যবহার করে বায়ো-পলিথিন এবং লিগনোসেলুলোসিক ফাইবার থেকে একটি সংমিশ্রণ প্রস্তুত করেন।
কিন্তু দুটি উপাদানের মধ্যে মিথস্ক্রিয়াকে শক্তিশালী করার জন্য একটি প্রভাবক প্রয়োজন, যা তাদের রাসায়নিক কাঠামোর ভিন্নতার জন্য স্বাভাবিকভাবেই বেমানান।
পলিথিন হল হাইড্রোফোবিক (জল-ঘৃণাকারী-পানির সাথে সহজে মেশে না) এবং ফাইবার হল হাইড্রোফিলিক (জলপ্রেমী-অতি সহজেই পানি শুষে নেয় বা পানির সাথে মিশে যায়)। এক্ষেত্রে তারা ম্যালিক অ্যানহাইড্রাইড ১ নামক যৌগ ব্যবহার করেন।
এটি তীব্র গন্ধ সহ একটি বর্ণহীন বা সাদা কঠিন পদার্থ। ফলে হাইড্রোফোবিক পলিথিন এবং হাইড্রোফিলিক ফাইবারগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করে একটি শক্তিশালী এবং আরও বায়োডিগ্রেডেবল যৌগ তৈরি হয় এবং তারা ম্যালিক-অ্যানহাইড্রাইড-গ্রাফটেড পলিথিন তৈরি করতে সক্ষম হয়।
এছাড়াও দৃঢ়তা বাড়ানোর জন্য প্রাকৃতিক তন্তুগুলোকে থার্মোপ্লাস্টিক ম্যাট্রিক্স, যেমন বায়ো-পলিথিলিনের সাথে একত্রিত করা যেতে পারে। থার্মোপ্লাস্টিকগুলো তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে নরম করা যায়, যা তাদের প্রাকৃতিক তন্তুগুলোর সাথে মিশ্রিত করার প্রক্রিয়া সহজ করে তোলে।
বায়োকম্পোজিট এর সুবিধাসমূহ
যৌগটি শুধু সাধারণ পলিথিনের চেয়ে বেশি পচনশীল নয় বরং শক্তিশালীও, কিছুটা ম্যালিক অ্যানহাইড্রাইডের এবং প্রাকৃতিক ফাইবারের সমন্বিত শক্তির কারণেই এমন হয়েছে।
এখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, আচ্ছা এত কষ্ট করে যে এই প্রাকৃতিক পলিথিন তৈরি করছি এগুলো কি বর্তমানে ব্যবহৃত পলিথিনের চেয়ে বেশী কার্যকরী হবে?
এর উত্তরেই যেন এস্পিনোসা ব্যাখ্যা করেছেন,
“প্রাকৃতিক তন্তুগুলোর শক্তিশালী যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যখন এই ফাইবারগুলোকে বায়ো-পলিথিলিনের মতো থার্মোপ্লাস্টিক ম্যাট্রিক্সের সাথে একত্রিত করা হয়, তখন এগুলো প্লাস্টিক ম্যাট্রিক্সের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং বন্ধন গঠন করে, যখন উপাদানটিতে বাহ্যিক চাপ তৈরি হয় তখন এ চাপ স্থানান্তরে সহায়তা করে।”
মূলত উচ্চ শক্তি, অনমনীয়তা এবং কম ঘনত্বের জন্য তৈরিকৃত এই পলিথিনের বাহ্যিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
“জৈব সংমিশ্রণ উৎপাদনের জন্য কৃষি বর্জ্য ব্যবহার করা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পাবে,” তিনি যোগ করেন।
এস্পিনোসা আরও উল্লেখ করেন যে তাদের গবেষণায় জৈব-পলিথিনের যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে প্রসারণ ক্ষমতা, তাপ সহনীয়তা এবং বাহ্যিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে।
“যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং ৫০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় পরিমাপ করা হয়েছিল, যা সাধারণত খাদ্য সংরক্ষণের জন্য অনুকূল নাও হতে পারে,” তিনি বলেছিলেন।
“লিগনোসেলুলোসিক ফাইবার থেকে সম্পূর্ণরূপে খাদ্য প্যাকেজিং তৈরি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ,” তিনি জানান।
“খাদ্য প্যাকেজিং তৈরিতে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নজরে রাখতে হয়, বিশেষ করে যান্ত্রিক শক্তি এবং টান সহনীয়তা,” তিনি আরও বলেন।
“যেহেতু সেলুলোজ ফাইবারগুলো অত্যন্ত হাইগ্রোস্কোপিক, (বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প শোষণ করে) তাই এসব ফাইবার রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ফুড প্যাকেজিং তৈরি করা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়।”
ভবিষ্যতের অ্যাভোকাডো বর্জ্য থেকে প্রাপ্ত উপাদান ব্যবহার করে নির্দিষ্ট খাদ্য পণ্যের জন্য পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব মোড়ক তৈরি করা সফল হবে বলে গবেষকরা আশা করছেন এবং আজ হোক বা কাল, গবেষণাটি সম্পূর্ণরূপে সফল পলিথিনের ব্যবহার অনেকাংশেই কমানো যাবে। এর ফলে টেকসই উন্নয়নে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে মানবজাতি। এছাড়াও প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত কাঁচামাল থেকে ফাইবার ব্যবহার করে পলিথিনের আরও বিকল্প খুঁজে বের করা যাবে।
আমিনুল ইসলাম সিয়াম/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: অ্যাডভান্সড সায়েন্স নিউজ, টেকনোলজি টাইমস.পিকে